সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে ছেড়ে আসা বিজি ৩৩৬ নম্বর ফ্লাইটে প্রশিক্ষণার্থী পাইলটকে ককপিটে রেখে পাইলট দিলদার আহমেদ তোফায়েল ক্রু রেস্ট বাঙ্কে অবস্থানের অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে নিয়ম ভেঙে ওই ফ্লাইটে প্রশিক্ষণের পর্যবেক্ষক বেবিচকের ফ্লাইট অপারেশনাল ইন্সপেক্টর (এফওআই) ক্যাপ্টেন (লাইসেন্সহীন) মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামান বসেছেন পাইলট সিটে।
আরও অভিযোগ উঠেছে, সেই ফ্লাইটে কবির আহমেদ নামের একজন বাংলাদেশি প্রবাসী হার্ট অ্যাটাক করেন। কিন্তু তার দ্রুত চিকিৎসার জন্য কোথাও জরুরি অবতরণ করা হয়নি। ঢাকায় আসার পরও কবিরকে হাসপাতালে নেওয়া হয় দেরিতে। অনেকক্ষণ পর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিমান কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কবীর আহমেদের মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে বিচার দাবি করেছেন কবির আহমেদের স্বজনরা।
সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সময় জেদ্দা থেকে আসা বিজি ৩৩৬ ফ্লাইটে পাইলট হিসেবে ক্যাপ্টেন ইরফানুল হকের ইনিশিয়াল রুট চেক (আইআরসি) ছিল। ফ্লাইটটিতে পাইলট ইন কমান্ড (পিআইসি) এবং ট্রেইনি এক্সামিনার ছিলেন ক্যাপ্টেন দিলদার আহমেদ তোফায়েল (জি-৫২৪৫৯)। ফ্লাইটে পর্যবেক্ষণের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর (এফওআই) ছিলেন ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামান। তবে ৭৩ বছর বয়সী ফরিদ উজামানের বর্তমানে পাইলট লাইসেন্স নেই। ফ্লাইটে ক্যাপ্টেন ইরফানুল হককে ককপিটে রেখে ক্রু রেস্ট বাংকে চলে যান দিলদার আহমেদ। এ সময় ককপিটে পাইলটের সিটে বসেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামান।
উল্লেখ্য, বিমান বাংলাদেশের ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজে এই ফ্লাইট পরিচালিত হয়। ‘অরুন আলো’ নামের উড়োজাহাজটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএফপি, ম্যানুফ্যাকচারাল সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২৩। ৩৫টি বিজনেস ক্লাস ও ৩৮৪টি ইকোনমিক ক্লাস আসনের উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম-মদিনা, ঢাকা-মদিনা, ঢাকা-জেদ্দা রুটে বেশি ব্যবহৃত হয়।
এভিয়েশন খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘একজন প্রশিক্ষণার্থী পাইলট ও একজন লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তির দ্বারা ফ্লাইট পরিচালনা বিমান চলাচলের নীতিবহির্ভূত। এ ঘটনায় বিমানটি বিপজ্জনকভাবে পরিচালিত হয়েছে। অননুমোদিত ব্যক্তির দ্বারা ফ্লাইট পরিচালনা অবৈধভাবে পরিচালিত হিসেবে গণ্য। এ ঘটনা বেসামরিক বিমান চলাচলের প্রচলিত বিধিবিধানের পরিপন্থী এবং বেসামরিক বিমান চলাচল আইন, ২০১৭-এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধ।’
এয়ারক্রাফট এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিটি অব বাংলাদেশের প্রধান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, ‘লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তি কখনোই ককপিটে পাইলটের সিটে বসতে পারেন না। একই সঙ্গে ইনিশিয়াল রুট চেকে ট্রেইনি পাইলটকে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে রেখে এক্সামিনার পাইলটের ককপিট ত্যাগ করা অনুচিত।’
অভিযোগ রয়েছে, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামান বেবিচকে যোগদানের আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পাইলট হিসেবে চাকরি করেছেন। সেই সুবাধে বিমানের পাইলটদের সঙ্গে সখ্য থাকায় বিধিবহির্ভূত সুবিধা দেন। ওই ফ্লাইটের পরও তিনি বিমানের বিজি ৩৮৬ ও বিজি ৩৮৭ ফ্লাইটে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে ইনিশিয়াল রুট চেক (আইআরসি) ফ্লাইটে ‘ফ্লাইট অপারেশন ইন্সপেক্টর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তবে এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পাইলট যে বাঙ্কে গিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন, এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ বাঙ্কে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়নি, তবে যতটুকু জানি, হয়তো ওয়াশরুমে জামা-কাপড় চেঞ্জ করে আবার আসেন, কিন্তু গিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন, এ ধরণের সুযোগ নেই। আর ফ্লাইটে যদি ট্রেইনি থাকে, তাহলে তো প্রশ্ন ওঠে না।’
মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা তো আদৌ জানি না তিনি (ফরিদ উজ্জামান) পাইলটের সিটে বসেছিলেন কি না, কন্ট্রোল প্যানেলে হাত দিয়েছিলেন কি না। তার যদি কোনও দোষ থাকে, তাহলে সিভিল এভিয়েশন দেখবে। আর ফ্লাইটে তো ম্যানুপুলেশনের কোনও সুযোগ নেই। ওনার একসময় এই উড়োজাহাজের রেটিং ছিল, এখন ওনার বয়স বেশি হওয়ার কারণে পাইলট লাইসেন্স নেই। এ উড়োজাহাজের যেকোনও বিষয়ে ওনি ভালো জানেন।’
এ বিষয় তদন্ত হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও জানেন। বিমান ম্যানেজমেন্ট কিছু একটা করবে। আশা করি এটা নিয়ে অনুসন্ধান হবে।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সদস্য- ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন্স) এয়ার কমডোর শাহ কাওছার আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বিমানকে বলা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজন হলে পরে আমরাও তদন্ত করবো।’
যেভাবে সৌদি প্রবাসীর মৃত্যু
সূত্র জানায়, গত ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সময় জেদ্দা থেকে ছেড়ে আসা বিজি ৩৩৬ ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন প্রবাসী কবির আহমেদ।
ফ্লাইটটি ছাড়ার আড়াই ঘণ্টা পর অসুস্থ বোধ করেন কবীর আহমেদ। তখন ফ্লাইটের ফ্লাইট পার্সার জয়াসহ অন্যান্য কেবিন ক্রুরা তার প্রাথমিক চিকিৎসার প্রস্তুতি নেন। ফ্লাইট অপারেশনের নিয়ম অনুযায়ী ফ্লাইটে কোনও চিকিৎসক আছেন কি না ঘোষণা করা হয়। এ সময় যাত্রী ডা. এ বি এম হারুন সাড়া দিয়ে কবীর আহমেদের চিকিৎসায় সহায়তা করেন। ডা. হারুন শমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও।
এ বিষয়ে ডা. হারুন বলেন, ‘যাত্রী কবির আহমেদের অসুস্থতা ঘোষণা শুনে আমি রেসপন্স করি। তাকে চেক করে দেখি তার হার্ট ফেইলর হয়েছে। ফ্লাইটে থাকা মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট ও ওষুধ দিয়ে রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাকে নেবুলাইজার ও অক্সিজেনও দেওয়া হয়।’
সূত্র আরও জানায়, বিজি ৩৩৬ ফ্লাইটের বাংলাদেশে আসতে ফ্লাইং আওয়ার ছিল ৬ ঘণ্টা। আড়াই ঘণ্টার মাথায় কবীর আহমেদ অসুস্থ হন। বাংলাদেশে পৌঁছা পর্যন্ত বাকি সাড়ে তিন ঘণ্টা ফ্লাই করে বিমানটি। কিন্তু কবির আহমেদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় তাকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কাছের কোনও বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন ডা. এ বি এম হারুন।
পাইলট ইরফানুল হক যাত্রীর হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে ক্রুদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ইরফানুল হক কাছাকাছি কোনও বিমানবন্দরে অবতরণ করার প্রস্তাব দিলেও ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামানের সম্মতি পাননি।
ডা. হারুন বলেন, ‘যাত্রীকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ারে বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। তখন পাইলটরা জানালেন তারা এখন ভারতে আছেন, সেখানে নামতে জটিলতা আছে, আর কিছু সময় ফ্লাই করলে ঢাকায় নামা যাবে। পরে নামার সময়ও দেখেছি যাত্রী বেঁচে ছিলেন।’
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে ওমানের মাস্কাট থেকে ঢাকায় আসার পথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট নওশাদ আতাউল কাইউম অসুস্থ বোধ করায় ওই ফ্লাইটটি ভারতের নাগপুর বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেছিল। পরে তাকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যদিও চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
প্রবাসী কবিরের চিকিৎসার জন্য কেন কাছের কোনও বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করা হলো না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আসলে সবকিছু ডিপেন্ড করে ওই সিচুয়েশনটা কেমন, তার ওপর। আমি ডিটেইল জানি না সেখানে কী হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় ফ্লাইট অবতরণের সময়ও যাত্রী বেঁচে ছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা গিয়েছেন।’
সূত্র জানায়, ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণ করে ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে। তার আগে জরুরি ভিত্তিতে আম্বুলেন্স, অ্যাম্বুলিফট ব্যবস্থা রাখা ও মেডিক্যাল সাপোর্টের জন্য ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে জানানো হয়।
খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিতি ছিলেন বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। তারা ১১টা ১০ মিনিটের দিকে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু কবীরকে নামাতে অ্যাম্বুলিফট ও হাসপাতলে নিতে অ্যাম্বুলেন্স আসেনি তখনও। প্রায় ৪০ মিনিট পর কবীরকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
১৬ জানুয়ারি কবির আহমেদকে রিসিভ করতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসেছিলেন তার ফুফাতো ভাই মো. ইসমাইল।
বিমান কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কবির ভাই ফ্লাইটে উঠে বাংলাদেশের সিম চালু করবেন বলেছিলেন। তার কোনও ফোন না পেয়ে আমি তার নম্বরে কল দিই। অনেকক্ষণ রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। আমি ভেবেছি হয়তো ইমিগ্রেশনে ব্যস্ত, তাই কল ধরছেন না। বেলা ১১টার দিকে ফোন আসে। তখন অন্য একজন আমাকে বলেন, আমার ভাই অসুস্থ, আমি যেন ৮ নম্বর গেটে থাকি। সেখানে অপেক্ষা করতে করতে আবার কল করি, কেউ ফোন ধরে না। দুপুর ১২টার দিকে আবার কল করলে বলা হয়, আমার ভাইকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, আমি যেন সেখানে যাই। পরে হাসপাতালে গেলে শুনি আমার ভাই বেঁচে নেই। আমাকে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।’
ইসমাইল আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি আমরা পরিষ্কার না। তাকে ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। তিনি বিমানেই মারা গেছেন কি না, তা-ও জানি না। তবে আমরা এ ঘটনার বিচার দাবি করি।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সাল থেকে সৌদি আরবে কাজ করেন করিব আহমেদ। তার তিন সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ের বয়স ১০ বছর, দ্বিতীয় মেয়ের বয়স ৭ বছর, ছোট ছেলের বসয় ১৮ মাস। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায়।
আরও পড়ুন:
