ডিজিটাল যুগে চারদিকে বাড়ছে নিত্যনতুন অপরাধ। সম্প্রতি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে ‘পমপম’ নামের একটি গ্রুপ অনেকের চোখে পড়েছে। এই গ্রুপের সদস্যরা নানাভাবে তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। কখনও কখনও এই সম্পর্ক প্রেমের পর্যায়েও রূপ নেয়। এরপর কৌশলে তরুণীদের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে অপরাধীরা। এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক সাইটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। তরুণীদের বেকায়দায় ফেলে অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছে, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে ব্ল্যাকমেইল করে হাজারো তরুণীর রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। পাশাপাশি তরুণীদের বিভিন্ন ভিডিও টেলিগ্রাম গ্রুপে ছড়িয়ে দিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
কয়েক বছরের প্রেম ভেঙে যায়, ফলে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে শুরু করে রাজধানীর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এতে ক্ষুব্ধ হয় এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাবেক প্রেমিক সাফিন। মেয়েটিকে শায়েস্তা করার ছক আঁকতে থাকে সে। বেছে নেয় টেলিগ্রাম। মেয়েটির দুই শতাধিক একান্ত ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও, যেগুলো নানা কৌশলে সে হস্তগত করেছিল, সেগুলো তুলে দেয় টেলিগ্রাম গ্রুপ পমপমের কাছে। এরপর মেয়েটির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মেয়েটির নাম-পরিচয়সহ টেলিগ্রামে ভাইরাল করে দেয় চক্রটি। মেগা ফাইলের মাধ্যমে বিক্রি করতে থাকে মেয়েটির কন্টেন্ট। চেনা-অচেনা মানুষের চাপে, কটু কথায় বেশ কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করে মেয়েটি।
এমনই আরেক ঘটনা ঘটে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সঙ্গে। অভিযোগ উঠেছে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাকে মিরপুরের এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করে কুমিল্লার তামিম। সেই দৃশ্য আবার মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখে। এরপর শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিং। টাকা ও একান্ত ছবি দিতে দিতে ক্লান্ত মেয়েটি শেষে আত্মহননের পথেও হাঁটে কয়েকবার। প্রাণে বেঁচে গেলেও স্বাভাবিক জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত, কেননা ওই সব ভিডিও ও ছবি টেলিগ্রাম গ্রুপে ছড়িয়ে দেয় নেশাগ্রস্ত ছেলেটি।
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে। অনলাইনে পরিচয় হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশরাফুল হাসান মল্লিক প্রত্যয়ের সঙ্গে। কিন্তু মেয়েটি টের পায়নি যে প্রত্যয় একজন হ্যাকার। মেয়েটির সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে বিনিময় হওয়া অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও কৌশলে হস্তগত করে ছেলেটি, তারপর তা ছড়িয়ে দেয় পমপম গ্রুপে। অনলাইনে ভাইরাল করে দিয়ে মেয়েটিকেই আবার সাহায্যের হাত বাড়ায়। বিপদ থেকে উদ্ধার করবে বলে কৌশলে সখ্য গড়ে তোলে। মেয়েটি যতক্ষণে টের পায়, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। একদিকে টাকার চাপ, অন্যদিকে মানসিক অত্যাচার।
চতুর্থ ঘটনা এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফাইজুল মল্লিকের। সে ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে, প্রেমের দিনগুলোতে সাবেক প্রেমিকার সঙ্গে নিজের একান্ত মুহূর্তে ধারণ করা ভিডিও সাবেক প্রেমিকার অন্য বন্ধুর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পমপম গ্রুপকে অনুরোধ করে কন্টেন্টটি ভাইরাল করতে। এরপর বেশ কিছু ফেসবুক আইডি খুলে সেগুলো দিয়ে ভুক্তভোগী ছেলে ও মেয়েটিকে হয়রানি করতে থাকে।
এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত চার জনকে বুধবার (১৯ জুলাই) সাভার, মিরপুর, উত্তরা ও কুমিল্লার বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতাররা হলো ফাইজুল মল্লিক (২১), আশরাফুল প্রত্যয় (১৯), সাফিন রহমান (১৮) ও তামিম রহমান (২১)।
প্রাথমিক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা তাদের সাবেক প্রেমিকাদের হয়রানি করতে আপত্তিকর কন্টেন্ট পমপম গ্রুপের কাছে ভাইরাল করার জন্য দিয়েছিল। এর আগেও এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত এমন আরও অপরাধীদের গ্রেফতার করেছে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম (সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অনলাইনে ভার্চুয়ালি তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে চক্রটির সদস্যরা। প্রথমে অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে গেমস খেলতে গিয়ে পরিচিত হয় তরুণীদের সঙ্গে। পরিচিত হওয়ার পর টার্গেট করে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে তারা। একসময় ওই সম্পর্ক প্রেমে রূপ নেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় তরুণীর পাঠানো আপত্তিকর ছবি ভিডিও সংগ্রহ করে রেখে দেয়। আবার অনেক তরুণীর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ দাবি করে। টাকা দিতে না পারলে তরুণীদের ভিডিও কলে এনে তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করাতে বাধ্য করে।
তিনি আরও বলেন, এসব কারণে কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। এমন কিছু ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। এ গ্রুপের প্রথম চক্রটি ধরার পর ভুক্তভোগীরা জানতে পারে, তখন এ বিষয়ে আরও বেশ কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে আসে। জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।
এসব বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিআইডির এই পুলিশ সুপার বলেন, বিশেষ করে যেসব তরুণী অনলাইনে পরিচয়ের পর ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করে, তাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তরুণীদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।