পরিবহণ খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন সরকারের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর। মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে 'ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ ব্যবসায় শুদ্ধাচার' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ সময় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ ব্যবসায় শুদ্ধাচার নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ খাত আপাদমস্তক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় উল্লেখ করে টিআইবি বলেছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সিন্ডিকেট এই খাতকে জিম্মি করে রেখেছে। ক্ষেত্রবিশেষে এই আঁতাতের সামনে সরকারও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ খাত আপাদমস্তক অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত।
যাত্রীবান্ধব গণপরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার প্রত্যাশা নিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাস্তবে মালিক শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে পরিবহণ খাত জিম্মি হয়ে গেছে। আর এই জিম্মিদশার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে সিন্ডিকেট। এই জিম্মি দশা এতটাই প্রকট যে মালিক-শ্রমিকের আঁতাতের কারণে তাদের আচরণ সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে, মনে হয়।
ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকার তার নিজের প্রণীত আইন ও নিয়মনীতি বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রত্যাশিত সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, একই সঙ্গে এ খাতের সাধারণ শ্রমিকরাও তাদের মৌলিক অধিকারসহ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
পরিবহণ খাতের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকার সমালোচনা করে ড. জামান বলেন, বাস পরিবহণ ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এ সব ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজশ রয়েছে। বিআরটিএ তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। যাত্রী সেবার ব্যর্থতা ঢাকতে লোকবল সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তারা।
অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিআরটিএ’র অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের সবই চলছে। অবস্থা প্রকটতর হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভের অংশীদার কম-বেশি সংশ্লিষ্ট সকলেই। কারণ, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা আরও বিকশিত হয়।
টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বাস পরিবহণ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য। তাদের সমর্থনে পরিবহণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তারা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার পাশাপাশি নীতি করায়ত্ত করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ২২টি (১৩.১ শতাংশ) কোম্পানির কাছে ৮১.৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে। এ সব বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যগণের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল (৮০ শতাংশ) এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের (১২ শতাংশ) প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
গবেষণার ভিত্তিতে টিআইবি ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ ব্যবসায় সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সব বাস কোম্পানিগুলোকে অনানুষ্ঠানিক নিয়োগ বন্ধ করে শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী কর্মী/শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান; প্রয়োজনীয় নীতিমালা (অর্থ ও প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জেন্ডার, অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন, তথ্য উন্মুক্তকরণ, ক্রয়, টিকেট ইত্যাদি সংক্রান্ত) প্রণয়ন এবং তা তদারকির আওতায় আনা; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, বিশেষ করে মালিক ও কর্মী/শ্রমিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্টকরণসহ নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা; সকল প্রকার প্রভাবমুক্ত হয়ে সড়ক পরিবহণ আইন, ২০১৮-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি।
টিআইবি আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান।
সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন রিসার্চ ফেলো ফারহানা রহমান, মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মুহা. নূরুজ্জামান ফরহাদ।
