বছর ঘুরে আবার চলে এলো ঈদুল আজহা। আর মাত্র ছয় দিন পরেই কোরবানির ঈদ। এ বছর রাজধানীতে কোরবানির পশুর মোট ২০টি হাট বসবে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৯টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১১টি পশুর হাট বসতে যাচ্ছে। প্রায় সব হাটেই প্রস্তুতির কাজ শেষের পথে। কয়েকটি হাটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু-ছাগল আসতেও শুরু করেছে। তবে বেচাবিক্রি এখনও তেমন শুরু হয়নি।
সোমবার (১০ জুন) রাজধানীর ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট ও দনিয়া কলেজ সংলগ্ন কোরবানির পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাকভর্তি গরু আসছে এসব হাটে। ব্যবসায়ীরা সেসব গরু ট্রাক থেকে নামিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। পোস্তগোলায় নৌপথেও গরু আনা হচ্ছে। তবে হাটের ভেতরের প্রস্তুতি এখনও চলমান আছে। ইজারাদারদের নির্দেশনায় মূল সড়কসহ আশপাশের খালি জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে গরু-ছাগল রাখার স্থান নির্ধারণ করা হচ্ছে।
ফরিদপুর সদরপুর থেকে ১০টি গরু নিয়ে ধোলাইখাল গরুর হাটে এসেছেন দুই ভাই শাহেদ বিশ্বাস ও তৈয়ব বিশ্বাস। বাংলা ট্রিবিউনকে তারা বলেন, আমরা ৮ বছর ধরে প্রতি কোরবানির ঈদে এই হাটে গরু আনি। সবসময়ই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাটে গরু তুলতে হয়। আমাদের জানানো হয়েছে ১০ তারিখ থেকে হাটে গরু আনা যাবে। তাই এলাকা থেকে কাল রাতেই রওনা দিয়েছি। ভোর ৬টার দিকে এখানে এসে পৌঁছেছি।
গরুর দাম ও হাটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এই দুই ভাই জানান, গরু বেচাবিক্রি এখনও শুরু করিনি। সবেমাত্র এলাম। এবার গত বছরের চেয়ে চারটা গরু বেশি এনেছি। গত বছর বেচাকেনা ভালো ছিল। তবে এবারের চেয়ে গরুর দাম একটু কম ছিল। এবার গরুর দাম বেশি। আসল কথা হচ্ছে গরু পালনে খরচ বেড়েছে। আর যাতায়াত খরচও অনেক বেশি। প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে এ বছর ধরা খেয়ে যাবো।
পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের কাছে হাটে ১৫টি গরু নিয়ে এসেছেন শিফা হাওলাদার। বাংলা ট্রিবিউনকে এই ব্যবসায়ী জানান, হাটের কাজ এখনও শেষ হয়নি। আর সবাই এখনও গরু নিয়ে আসেনি। আমি গতকাল গরু নিয়ে হাটে এসেছি। এখনও ক্রেতাদের দেখা নেই। অনেকে আসছেন, দেখছেন, ছবি তুলছেন, চলে যাচ্ছেন। কেউ এখনও দামও জানতে চায়নি।
মাদারীপুরের শিবচর থেকে ৩০টি গরু নিয়ে ধোলাইখাল ট্রাক মার্কেট সংলগ্ন গরুর হাটে এসেছেন কাইয়ুম। তিনি বলেন, আমি আমার চাচাসহ আরও দুই জন আছি এই ব্যবসায়। আমরা পাঁচ বছর ধরে একসঙ্গে ব্যবসা করছি। এ বছর গরুর দাম গত বছরের চেয়ে বেশি। আসার সময় মাঝারি আকারের ৫টা গরু কিনেছি ৭ লাখ টাকা দিয়ে। আর বাকি গরুগুলো আমাদের নিজস্ব খামারের। হাটে এখনও কেউ আসেনি, বেচাবিক্রি কেমন হয় জানি না। আশা করছি ভালো হবে।
আকাশ ডেইরি ফার্ম থেকে ২২টি গরু নিয়ে দনিয়া কলেজ সংলগ্ন পশুর হাটে এসেছেন মো. মোস্তফা মিয়া। তিনি এসেছেন ঝিনাইদহ থেকে। অন্যদের মতো তিনিও একই সুরে কথা বলেছেন। প্রত্যাশা করছেন ভালো বেচাকেনার।
হাটের প্রস্তুতি সম্পর্কে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন পশুর হাটের ইজারাদার আশফাক আজিম বলেন, আমাদের পশুর হাট যেহেতু সড়কের ওপর এবং আশপাশের জায়গাজুড়ে, এজন্য আমরা চাইলেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে হাটের প্রস্তুতি নিতে পারি না। হাটে গরু অলরেডি অনেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা তাদের ও গরু রাখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা করে দিচ্ছি। এটি ঐতিহ্যবাহী একটা গরুর হাট। আশপাশের সবচেয়ে বেশি জমজমাট গরুর হাট এটি।
এ বছর ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে এই হাটটি ইজারা নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে কোরবানির পশু বেচাকেনা ও হাটগুলোর নিরাপত্তা জোরদারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্যসহ বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপির) কমিশনার হাবিবুর রহমান। এছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ছয় আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা পশুর হাটগুলোতে শৃঙ্খলা রক্ষা এবং যেখানে-সেখানে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী বিক্রয় কার্যক্রম বন্ধে কাজ করবেন।
এদিকে এখনও প্রস্তুতি শেষ হয়নি রাজধানীর অন্যতম বড় গাবতলী হাটের। সোমবার এই হাট ঘুরে দেখা যায়, হাটটির স্থায়ী অংশে কিছু গরু আসা শুরু করলেও অস্থায়ী অংশে এখনও ‘ডোগা’ (গরু রাখার স্থান) তৈরির কাজ চলমান। হাটের এই অংশে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী বিক্রি প্রতিষ্ঠানের রাখা ইট এখনও পুরোপুরি সরানো হয়নি। এতে হাট প্রস্তুতির কাজ শুরুতে কিছুটা দেরি হয়েছে বলে জানান ডোগা ভাড়া নেওয়া ব্যবসায়ীরা। হাটের আকারও এবার কিছুটা কমেছে বলেও জানান তারা। হাটের সামনে আমিনবাজার সড়কের কাজ চলমান থাকায় প্রধান সড়ক থেকে কিছু ভেতরে বসানো হয়েছে হাট।
হাট সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, মঙ্গলবার থেকে হাটে গরু ও কোরবানির অন্যান্য পশু আসা শুরু করবে।
হাটে এখন পর্যন্ত কোরবানির পশু নিয়ে আসা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমদিকে আসা প্রত্যেকটি গরু আকারে বড়, মূল্য কয়েক লাখ টাকার ওপরে হাঁকা হচ্ছে। হাটের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে বড় গরুগুলো শুরুতেই আনা হয়েছে। এছাড়াও মাঝারি আকারের গরুর দাম এক থেকে দেড় লাখ টাকা হাঁকা হচ্ছে। কিছুটা ভালো হলে দুই লাখও দাম চাওয়া হচ্ছে।
মানিকগঞ্জ থেকে ১০টি গরু নিয়ে আসা ব্যাপারী রমজান বলেন, গরু কিনতে হচ্ছে দাম দিয়ে। সেটাকে আবার লালনপালন করতে হয়। এখানেও খরচ বেড়ে গেছে। সব হিসাব করেই দেড় লাখ করে চাচ্ছি গরুর দাম। তিনি প্রায় ৩ মণ ওজনের একটি গরু ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা দাম হাঁকেন এক ক্রেতার কাছে।
গরু কিনতে আসা নিজামুদ্দিন বলেন, লাখ টাকার নিচে গরু একেবারেই ছোট হয়ে যায়। তাই মোটামুটি সাইজের একটা গরু নিতে লাখ টাকার ওপর বাজেট ধরে রেখেছি।
এখনও হাট জমজমাট না হলেও হাটে আসা ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে দুটি করে উট ও দুম্বা। দাম এখনও নির্ধারণ করেনি। তবে প্রাথমিকভাবে দুটি উটের জোড়মূল্য ৮০ লাখ বলা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এবছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সারুলিয়া স্থায়ী পশুর হাটসহ ১০টি অস্থায়ী পশুর হাট বসেছে। সেগুলো হলো– শ্যামপুর কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ডের পাশে, রহমতগঞ্জ ক্লাবের পাশে, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট, উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘ ক্লাবের পাশে, হাজারীবাগের ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ এলাকা, মেরাদিয়া বাজারের পাশে, আমুলিয়া মডেল টাউনের পাশে, দনিয়া কলেজের কাছের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালের আশপাশে এবং কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোড ও লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবের আশপাশে।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার হাটগুলো হলো– উত্তরা দিয়াবাড়ী বউবাজার এলাকা, মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশের খালি জায়গা, কাওলার শিয়ালডাঙ্গার এলাকা, ভাটারার সুতিভোলা খালের পাশের জায়গা, মোহাম্মদপুর বছিলা ৪০ ফুট রাস্তার পাশে, খিলক্ষেতের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিমপাড়ার খালি জায়গা এবং ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাচকুড়া ব্যাপারীপাড়ার রহমান নগর আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা।