দুই সপ্তাহেও আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অচলাবস্থা কাটেনি। জরুরি সেবা চালু থাকলেও বহির্বিভাগের চিকিৎসাসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম এখনও বন্ধ রয়েছে। আগামী ১৪ জুন থেকে হাসপাতালটিতে পুরোপুরি সচল হতে পারে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে সেখানে চিকিৎসাধীন আহত জুলাইযোদ্ধাদের সঙ্গেও কর্তৃপক্ষের বিরোধের সমাধান এখনও হয়নি। বর্তমানে হসপিটালের বিশেষায়িত আবাসিক শাখায় তাদের ৬ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঈদের কারণে প্রায় ৪৮ জন বাসায় গেলেও দুই-একদিনের মধ্যে তারা ফিরে আসতে পারেন। তখন আবারও তারা আন্দোলনে গেলে পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বুধবার (১১ জুন) বিকাল ৩টায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের ভেতরে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ পরিবেশ। নিচতলার সামনে দায়িত্ব পালন করছেন কয়েকজন কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মী। স্বাভাবিক কার্যক্রম ও বহির্বিভাগ সেবা বন্ধ রয়েছে। তবে চতুর্থ তলায় জরুরি সেবা চালু রয়েছে। সেখানেও রোগী একেবারেই হাতেগোনা কয়েকজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার কর্মরত কয়েকজন নার্স ও আবাসিক চিকিৎসক জানান, সকাল থেকেই না জেনে অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা এসেছেন। তবে সেবা না পেয়ে তারা ফিরে গেছেন। অবশ্য বেশি সিরিয়াস রোগীদের ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, এমন সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫ জন হবে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এই হাসপাতালটিতে তিন-চার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
কী নিয়ে সংকট
গত ২৫ মে দুপুরে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে একটি বৈঠক চলাকালে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া ও অবহেলার অভিযোগ এনে বিষপান করেন সেখানে চিকিৎসাধীন চার জুলাইযোদ্ধা।
বিষপানকারীরা হলেন—শিমুল, মারুফ, সাগর ও আখতার হোসেন (আবু তাহের)। পরে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা এখন শঙ্কামুক্ত।
এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক বিরোধ শুরু হলেও এর তিন দিন পর ২৮ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামেন আহত জুলাইযোদ্ধারা। একই দিন বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে কর্মচারীদের একাংশের সঙ্গে সাধারণ রোগীদের হাতাহাতি ঘটে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন জুলাই-আহতরা। তখন ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় মানববন্ধন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে হাসপাতালের সব ধরনের সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ভর্তি রোগীরাও হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে হাসপাতালের পরিচালক খায়ের আহমেদ চৌধুরী ছুটিতে রয়েছেন। আর ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় জানে আলম মৃধাকে।
এতে ৯ দিন হাসপাতালের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। পরবর্তী সময়ে ঈদুল আজহার একদিন আগে ৬ জুন জরুরি বিভাগ চালু করা হয়। এসময় বিশেষায়িত আবাসিক শাখায় চিকিৎসাধীন আহত জুলাই-যোদ্ধাদের কর্তৃপক্ষ জানায়—তারা চাইলে ঈদ করতে বাসায় যেতে পারেন। সে অনুযায়ী ৪৮ জন বাসায় গিয়েছেন। কিন্তু কাউকে পুরোপুরি ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য
চার তলায় বিশেষায়িত আবাসিক শাখায় চিকিৎসাধীন জুলাই-যোদ্ধা নুরে আলম জানান, গত বছরের ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হন । এখানে ভর্তি হওয়ার পর শুরুতে কিছুটা চিকিৎসা পেলেও পরবর্তী সময়ে অবহেলার শিকার হন। তার দাবি, সেখানে তাদের প্রকৃত চিকিৎসা হচ্ছে না। সেজন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন তারা। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান।
জুলাই ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্য প্রতিনিধি নাবিলা ইদ্রিস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় আমাদের অনেকের জীবন শঙ্কায় পড়ে গেছে। বিদেশে চিকিৎসা হলে হয়তো দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারতেন। তিনি জানান, ঈদের ছুটি শেষ হলে দাবি আদায়ে আবারও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।’
বিশেষজ্ঞ কমিটির ভাষ্য
চিকিৎসাধীন জুলাইযোদ্ধাদের চোখের পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত ৩ জুন চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. মোস্তাক আহাম্মদকে। কমিটির সদস্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের তিন জন চক্ষুবিশেষজ্ঞ।
কমিটি ৪ জুন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৫৪ জুলাইযোদ্ধার চোখ পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। তাদের মধ্যে ৩০ জন বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে চোখ পরীক্ষা করান। আর ২৪ জন চোখ দেখাননি।
বিশেষজ্ঞ কমিটি ওই দিনই একটি প্রতিবেদনে জানায়, রোগীদের প্রদত্ত চিকিৎসা ও চলমান চিকিৎসা সন্তোষজনক। আপাতত রোগীদের ছাড়পত্র দিয়ে প্রয়োজনে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
বিশেষ ক্ষেত্রে রোগীদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি ইস্পাহানি হাসপাতালে যোগাযোগের পরামর্শ এবং দ্রুত পুনর্বাসনের জন্য সুপারিশ করে কমিটি।
যা বললো কর্তৃপক্ষ
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলম মৃধা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামী ১৪ জুন কার্যক্রম পুরোপুরি সচল হতে পারে। ঈদে বাড়িতে যাওয়া জুলাই-যোদ্ধারা ফিরে এলে সম্ভাব্য সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।’
