X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষ

মুহাম্মাদ রেজাউল করিম
১২ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:১৭আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:২৭

মুহাম্মাদ রেজাউল করিম বাঙালির ইতিহাসে যা কিছু সুন্দর ও সৌন্দর্যকে ঘিরে তার সবটুকুই রয়েছে বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনে। এই দিনকে ঘিরে নানা আয়োজন থাকে বাঙালির প্রতি ঘরে ঘরে। শতভাগ বাঙালিয়ানার স্বাদ যেন সবাই উপভোগ করতে চায়। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে সবাই যেন এক সুরের মৃণাল ধরে গায় সাম্যের গান। সে দিন সবাই হয়ে যায় এক জাত, সবারই হয় একটাই পরিচয় আর তা হলো বাঙালি।
বর্ষবরণকে ঘিরে এমন মধুর আয়োজন পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। বাঙালির এই আয়োজনে জাত-কুল, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবই বাঙালিয়ানার স্বাদ আস্বাদন করেন। রঙে-ঢঙে সর্বত্রই যেন বাঙালির সাজ। ওয়েস্টার্ন কালচার সেদিন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। আমরা বাঙালি এই পরিচয়টাই তখন প্রাধান্য পায়।
নতুন বছর আসে নতুনের বার্তা নিয়ে। পুরনো বছর রেখে যায় স্মৃতি। পুরনো দুঃখ-গাঁথা আমরা ভুলে যাই নতুনের আগমনে। নিজেদেরকে নতুন করে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আমরা স্বপ্ন দেখি। তাই নতুনকে বরণের মধ্য দিয়ে সারাটা বছর যেন একইরকম শুভ হয় সে আয়োজনই থাকে বর্ষবরণের মুখ্য উদ্দেশ্য। ব্যবসায়ীরা পুরনো হাল খাতার সব ধার-দেনা চুকিয়ে নতুন বছরে নতুন হিসেব শুরু করেন। গ্রাম বাংলার আবহমান ঐতিহ্যে রাস্তার পাশে বসে বৈশাখী মেলা। বাঁশি, মাটির তৈরি নানা খেলনা ও তৈজসপত্র যেন আমাদের পুরনো সংস্কৃতিরই ধারক। ঘরে ঘরে চলে মিষ্টান্য আদান-প্রদানের রীতি কিন্তু শহুরে ও নগরে জীবনে এর একটু ভীন্নতা রয়েছে। সেখানে রয়েছে পান্তা-ইলিশের ধারা। রাজপথ মুখরিত হয় গানে গানে । রমনার বটমূল, ছায়ানট, চারুকলা ইনস্টিটিউটে চলে বর্ষবরণের নানা রঙে-ঢঙে সাজানো অনুষ্ঠান। টিভি চ্যানেলগুলো সারাদিন ব্যস্ত থাকে এইসব ছবি ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে। ফাস্টফুড,চাইনিজ রেস্তোরাতেও থাকে উপচে পড়া ভীড়। সেখানেও একদিনের জন্য চলে পান্তা ইলিশের হিড়িক। ছেলেরা পাঞ্জাবি আর মেয়েরা বাসন্তি রঙের কাপড়ে যেন নিজেকে আবিষ্কার করে বাঙালি রূপে। গালে আঁকা নানান আলপনা আর খোঁপায়-খোঁপায় ফুলের বাহার যেন আপন বাঙালি সত্ত্বাকেই বিকশিত করে।

আরও পড়তে পারেন: পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাবেন না প্রধানমন্ত্রী

বাঙালির বর্ষবরণের ইতিহাস নতুন নয়। বহুকাল আগে থেকেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। তবে বর্তমানের মতো করে নয়। অনেকেই আমরা বর্ষবরণের রঙে-ঢঙে নিজেদেরকে মানিয়ে নেই কিন্তু জানি না এর ইতিহাসটা কোথা থেকে আসলে শুরু হয়েছে। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটা ধারা থাকে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাসেরও একটা ধারা রয়েছে। আর সে ধারাতেই আমরা নতুন রূপে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান পালন করে থাকি।
ঐতিহাসিকভাবে অনেকেই মনে করেন মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন। কিন্তু আকবরের, 'আইন-ই-আকবরিতে' আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন এমন কোন কথা কোথাও লেখা নেই। কারণ ভারতের যে সকল জায়গায় তিনি যে সন প্রবর্তন করেছিলেন, তা স্পষ্টই উপর্যুক্ত গ্রন্থে লেখা আছে। তবে তিনি যে সর্বভারতীয় ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন, অনেকেই মনে করেন আকবরের ইলাহী সনকে উৎস হিসাবে ধরে বাংলা অঞ্চলের কোনও সুবেদার বাংলা সন প্রবর্তন করতে পারেন।
মোগল সুলতানেরা ইরানের নববর্ষ উপলক্ষে দিল্লিতে এবং পাশ্ববর্তী কোনও কোনও অঞ্চলে উৎসবের আয়োজন করতেন। দিল্লিতে নারীদের জন্য এ উপলক্ষে 'মিনাবাজার' আয়োজন করা হতো। এ আয়োজনে বাংলার বাঙালিদের যোগসূত্রতা না থাকলেও তা থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা সন প্রবর্তনে উৎসাহী হয়ে থাকতে পারেন। তবে ইতিহাসে ৯৬৩ হিঃ, ১৫৫৬ খ্রিঃ ১১ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ৯৬৩ বাংলা সন গণনা শুরু হয়, বলে জানা যায়। যেহেতু আকবরের শাসন আমল পহেলা ফেব্রুয়ারি ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিঃ সেহেতু আকবরই বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন বলে ধারণা পাওয়া যায়।

সে সময় থেকেই পূর্ব বাংলায় নববর্ষ উদযাপিত হতো। নববর্ষের আদি অনুষ্ঠান হিসাবে ড. এনামুল হক 'আমানি' উৎসবের কথা বলেছেন। এটি ছিল কৃষকের উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি রাতে কৃষকের ঘরে একটি ঘটিতে আতপ চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো এবং তাতে আমগাছের কচি পাতাযুক্ত ছোট ডাল রেখে দিতো। পরের দিন বছরের প্রথম দিবসে কৃষক সকালে পাতাযুক্ত ডাল থেকে ঘরের চারিদিকে পানি ছিটিয়ে দিতেন। এতে গোটা ঘরটি পরিশুদ্ধ হবে বলে মনে করা হতো এবং সারা বছরের জন্য মঙ্গল কামনায় এ অনুষ্ঠান করা হতো । কৃষক যখন ক্ষেতে হাল দিতে যেতেন, তার শরীরেও ওই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। এতে ক্ষেতে বেশি পরিমাণ ফসল ফলবে বলে মনে করা হতো।

আরও পড়তে পারেন: অন্ধ হলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে?

বাংলার কৃষি অর্থনীতিতে মানুষের হাতে নগদ পয়সা না থাকায় বাকিতে কেনাবেচা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ফসল বিক্রির টাকায় নববর্ষের দিনে সারা বছরের বাকি পরিশোধ করতেন গ্রাহকরা। আর ব্যবসায়ীরা নববর্ষ উপলক্ষে 'হালখাতা'র আয়োজন করতেন। এতে রঙ-বেরঙের কাগজ দিয়ে দোকান সাজানো হতো। দোকানি বা ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের মিষ্টি মুখে আপ্যায়ন করতেন আর গ্রাহকেরা সারা বছরের বাকির টাকা পরিশোধ করে নতুন খাতা বা হালখাতা খুলতেন। অন্যদিকে জমিদার বাড়িতে প্রজারা নববর্ষের উৎসবে যোগ দিতেন। সেখানেও মিষ্টিমুখ আর পান সুপারি দিয়ে প্রজাদের আপ্যায়ন করা হতো। আর প্রজারাও তাদের সারা বছরের খাজনা পরিশোধ করতেন। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ উপলক্ষে মেলাও অনুষ্ঠিত হতো।
সময় বদলে গেছে, বদলে গেছে বর্ষবরণের রীতি-নীতি। শহর-গ্রাম কোথাও বাদ নেই যেখানে পরিবর্তনের ছোঁয়া আসেনি। নতুন আঙ্গিকে, নতুন ভঙ্গিতে বাঙালি তার এই প্রাণের উৎসবটি পালন করে থাকেন। কিন্তু উৎসব আমেজ আর ঐতিহ্যের অন্তরালে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি এ ধরনের করুণা কাম্য নয়। বাঙালি সাজ আর বাঙালিয়ানা একদিনের জন্য কেন?

আরও পড়তে পারেন: পহেলা বৈশাখে মিষ্টি খাওয়াবে ডিএমপি
পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির নিজ সংস্কৃতির ধারা। এখন আমাদের চর্চা করতে হবে সংস্কৃতির ধারাগুলোর আর মনে লালন করতে হবে বাঙালি সংস্কৃতি। যে সুরের দোলা বাঙ্গালীর মনে সে দোলায় প্রকম্পিত হোক পৃথিবী। অন্য সংস্কৃতি আর ইতিহাস নয় বরং আমাদের সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই আমরা পরিচিত হয়ে ওঠতে পারি। শুধু একদিনের জন্য বাঙ্গালী হওয়ার মাঝে গর্ব নেই, প্রতিদিন বাঙ্গালী হয়ে থাকতে হবে। এই চেতন বোধজন্ম নিলেই আমরা আমাদের পরিচয়টাকে বড় করে দেখতে পারবো।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা