X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘জাতির দায়মুক্তিতে আইনি লড়াই করে যাচ্ছি’

বাহাউদ্দিন ইমরান
০৪ মার্চ ২০২২, ২০:১৮আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১৬:৫৩

দেশের নাগরিকদের মধ্যকার বিভেদ-বিভাজন ও ইতিহাস বিকৃতি রোধে প্রতিনিয়ত আইনি লড়াই করে যাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথী। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘জরুরি অবস্থা জারি’র বৈধতা নিয়ে তিনিসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পাঠ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি, জাতীয় শোক দিবসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের বিরুদ্ধে সঠিক তারিখ বের করা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতি প্রতিহত করতে জনস্বার্থে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। বহুল আলোচিত মামলা তিনটির আদ্যোপান্ত নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন নাহিদ সুলতানা যুথী।

বাংলা ট্রিবিউন: বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্তি চেয়ে রিট দায়েরের পেছনে মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?

নাহিদ সুলতানা যুথী: আমাদের বর্তমান প্রজন্ম মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হচ্ছে যে, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক কে? মূলত এ বিষয়টিকে দলীয়করণ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ভাষণ দিলেন, তখনই কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা চলে এসেছে। তো এই ঘোষণা যখন তিনি দিলেন পরে সেটি নিয়ে দলীয়করণ হওয়ায় আমাদের প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: রিটটি দায়েরের ক্ষেত্রে কোনও দায় অনুভব করছেন কিনা?

নাহিদ সুলতানা যুথী: জনস্বার্থে করা ওই রিট মামলায় আমি চেয়েছি যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানুক যে, স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই এই বিষয়টি কারিগরি বা মাদ্রাসা থেকে শুরু করে সব শিক্ষাবোর্ডের পাঠ্যপুস্তকে যদি অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে আমাদের প্রজন্ম তা সহজেই জেনে নিতে পারবে। এর ফলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দলীয়করণ হবে না, কিংবা আর কোনও হানাহানিও হবে না।

একটি মৌলিক বিষয়ের ওপর কোনও বিতর্ক থাকে না। এরপরও যদি সেই মৌলিক বিষয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, তখন এর বলয় ভেঙে যায় এবং দেশ হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। তাই আমি মনে করি, এই মৌলিকতা রক্ষা আমাদের দায়িত্ব এবং সেটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু হতে পারে বলেই রিটটি দায়ের করা।

বাংলা ট্রিবিউন: এসব রিটের মাধ্যমে আপনি কি জাতির দায়মুক্তির চেষ্টা করছেন?

নাহিদ সুলতানা যুথী: অবশ্যই। আমার বিবেক থেকেই এ বিষয়টি এসেছে। কারণ, আমরাই মাঝে মাঝে ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্ত হই। একটা সময় ছিল যখন আমরা টিভিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখতে পেতাম না। জাতির পিতা কে তা ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। এমনও দেশ আছে, যেখানে একাধিক জাতির পিতা রয়েছেন। কিন্তু আমাদের মাত্র একজন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপরও এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্ত ছড়ানো হয় কেন? তাই আমরাই যদি বিভ্রান্তিতে পড়ি, তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জাতির পিতা, কিংবা তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে কীভাবে জানবে? সে উপলব্ধি থেকেই ভাবলাম, বিভ্রান্ত বন্ধে এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে একটি সময় পর প্রজন্ম আর সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে না। তাই একজন আইনজীবী হিসেবে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকে জাতিকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা এবং নিজের বিবেকের দায়মুক্তি থেকেই জনস্বার্থে আইনি লড়াই করে যাচ্ছি।

বাংলা ট্রিবিউন: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়েরের বিষয়ে জানতে চাই।

নাহিদ সুলতানা যুথী নাহিদ সুলতানা যুথী: বিদেশে যাওয়ার সময় আমাদের পাসপোর্ট চেক করা হয়। পাসপোর্টে আমাদের জন্মদিনের তারিখ উল্লেখ থাকে। এছাড়াও জন্মসনদ বা বিয়ের কাবিননামাতেও  জন্মদিনের তারিখ উল্লেখ থাকে। কিন্তু খালেদা জিয়ার দু’টি পাসপোর্টে জন্মদিনের দু’টি তারিখ। এছাড়াও বিয়ের রেজিস্ট্রি সনদে, ম্যাট্রিকুলেশন সনদে এবং হাসপাতালের নথিতে ভিন্ন ভিন্ন জন্মদিনের তারিখ রয়েছে। এই যে কয়েকটি জন্মদিন রয়েছে, এর বাইরেও ১৫ আগস্ট দলীয়ভাবে জন্মদিন পালন করা হয়। যদি সকল নথি বা সনদে ১৫ আগস্টে জন্মদিন পালনের তথ্য উল্লেখ থাকতো, তাহলে সেটি অন্য বিষয় হতো। কিন্তু জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার দিনটি, যেটি আমরা জাতীয় শোক দিবস পালন করি (১৫ আগস্ট), সেই তারিখে আরেকজন নেত্রী বানানো জন্মদিন পালন করায় জাতির মধ্যে বিভেদ, বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। তাই একটি সঠিক জন্মদিনের বিষয়টি আমি তুলে আনার চেষ্টা করেছি। এতে করে তার জন্মদিন নিয়ে প্রকৃত তথ্য উঠে আসবে। ফলে জাতি কখনেও বিভ্রান্ত হবে না। 

বাংলা ট্রিবিউন: দীর্ঘদিন ধরে জন্মদিন পালন করলেও সে বিষয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হননি। কিন্তু আপনি এগিয়ে এলেন কেন?

নাহিদ সুলতানা যুথী: এখানেও আমি জাতির দায়মুক্তির জায়গা থেকে কাজ করেছি। বিষয়টিকে একটি সুষ্ঠু ধারাতে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছি। আমি জন্মদিন পালন জোর করে বন্ধ করতে চাচ্ছি না। বিভিন্ন নথিতে খালেদা জিয়ার জন্মদিনের তারিখ দেওয়া রয়েছে। তাই আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহার জন্য এবং জাতিকে সত্য জানাতেই আমার এগিয়ে আসা।

কেননা, একজন মহান নেতার মৃত্যুর দিনে বানানো জন্মদিন পালনের মাধ্যমে বাঙালিকে যেন খারাপ বার্তা না দেওয়া হয়, সে প্রচেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, শহীদ জাতীয় চার নেতা, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিজের বিবেক-বিবেচনার জায়গা থেকেই প্রচেষ্টাগুলো অব্যাহত রেখেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

নাহিদ সুলতানা যুথী: বিষয়টি তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন এসেছে। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে। আমরা চাই, যেটি সঠিক জন্ম তারিখ সেটি পালন হোক, শোক দিবসের অবমাননা এবং বাঙালির বিবেককে অবদমিত করা বন্ধ হোক। 

বাংলা ট্রিবিউন: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সারাদেশে যখন শঙ্কা-ষড়যন্ত্র, তখনই আপনি আদালতে রিট করলেন। কারও পরামর্শে নাকি নিজে থেকেই রিটটি দায়ের করেছিলেন?

নাহিদ সুলতানা যুথী: বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী প্রচারণা শুরু করলো যে, আমাদের ইসলাম ধর্মমতে, ভাস্কর্য করা যাবে না। কিন্তু জাতির পিতার ভাস্কর্য তো একটি শিল্প। এটাকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। অথচ সংবিধান অনুসারে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ জাতি। সুতরাং, ভাস্কর্য নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব থাকার কথা না। তবু ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে জাতি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হানাহানি-মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। সে বিষয়গুলোকে অবলোকন করে রিটটি দায়ের করি। রিটের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশের পরই ভাস্কর্য নিয়ে মারামারি-হানাহানি বন্ধ হয়ে গেল।

বাংলা ট্রিবিউন: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে কখনও নারী সভাপতি বা সেক্রেটারি আসীন হননি। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

নাহিদ সুলতানা যুথী: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এখন অসংখ্য নারী আইনজীবী (সদস্য) রয়েছেন। আমরা নারীরা আজীবন শুধু ভোট দিয়ে যাবো, তা কিন্তু নয়। নারীদের মধ্য থেকেও নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমাদের সহকর্মী পুরুষদের উদার মনোভাবটিও বেরিয়ে আসবে। সমিতির অনেক পুরুষ সদস্যও চান যে, নারীরা সমিতির নেতৃত্বে আসুক।

নাহিদ সুলতানা যুথীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক বাহাউদ্দিন ইমরান বাংলা ট্রিবিউন: আপনার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন।

নাহিদ সুলতানা যুথী: রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের (রুলা) প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এর আগে ২০০৮ সালে এক-এগারো সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। পেশাগতভাবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে ব্যস্ততা তো আছেই।

বাংলা ট্রিবিউন: পেশাগত ব্যস্ততার ভিড়ে পরিবারকে সময় দিতে অসুবিধা হয় না?

নাহিদ সুলতানা যুথী: সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সময় বের করা সহজ হয়। আমিও সেভাবে চেষ্টা করি।

বাংলা ট্রিবিউন: পরিবার থেকে কে বেশি সাপোর্ট করে?

নাহিদ সুলতানা যুথী: নিজের সব ব্যস্ততাজুড়েই আমি আমার স্বামী (যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ) ও মেয়ের (তানজিম বৃষ্টি) কাছ থেকে বেশি সাপোর্ট পেয়ে থাকি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে ধন্যবাদ।

নাহিদ সুলতানা যুথী: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
‘মেয়েদের নিয়ে কেউই ঝুঁকি নিতে চায় না’
নারী দিবস উপলক্ষে একান্ত সাক্ষাৎকারে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী১৫ বছরে নারী শক্তির জাগরণ হয়েছে
সর্বশেষ খবর
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা