X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডার স্মৃতি বার বার ফিরে আসে’

রক্তিম দাশ, কলকাতা
১৫ আগস্ট ২০২২, ১৬:০৩আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১৬:৪৮

তিনি ছিলেন শহীদ শেখ কামালের বন্ধু, সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা। এখন থাকেন কলকাতায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ দিনটিতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেদিনের স্মৃতিচারণ করলেন সুবীর হোম রায়।

বাংলা ট্রিবিউন: সেদিনের সেই ঘটনা আজও যেভাবে ভারাক্রান্ত করে...।

সুবীর হোম রায়: ১৫ আগস্ট দিনটা এলেই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমি মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি ময়মনসিংহ থেকে। যুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ে আশ্রয় নিই পরিবারের সঙ্গে। যুদ্ধ শেষে ফের ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করি। থাকতাম জগন্নাথ হলে। ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে পড়লাম। তখন ভালো ক্রিকেট খেলতাম। সলিমুল্লাহ হলের ছেলেরা আমাদের হলের মাঠে খেলতে আসতো। আর সলিমুল্লাহ হলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কামাল ভাই। আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। উনি ম্যাট্রিক দেন ৬৭-তে। আমি পাস করি ৬৮-তে। একদিন খেলার মাঠেই কামাল ভাইয়ের বন্ধু মুনির ভাই আমায় সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অচিরেই আমি হয়ে উঠলাম কামাল ভাইয়ের আপনজন।

বাংলা ট্রিবিউন: কেমন দেখেছেন তাকে?

সুবীর হোম রায়: আমি গান-বাজনা করতাম, ছবি আঁকতাম। কামাল ভাই নাটক খুব ভালোবাসতেন। ফলে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হলো। টিএসসি চত্বরে আড্ডা হতো প্রতিদিনই। আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ছেলে বলে তার মধ্যে কোনও অহংকার দেখিনি। ’৭৫-এর ১৭ জুলাই বিয়ে করেছিলেন কামাল ভাই। আমরা ধরে বসলাম খাওয়াতে হবে। ঢাকা স্টেডিয়ামের সামনে প্রভিন্সিয়্যাল নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখান থেকে বিরিয়ানি আনিয়ে আমাদের খাওয়ান তিনি।

সুবীর হোম রায়ের আইডি কার্ড

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডটা...?

সুবীর হোম রায়: আমি ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া আপার (মতিয়া চৌধুরী) গ্রুপে ছিলাম। ডাকসুতে তখন ইউনিয়নের রমরমা। ইউনিয়নের সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সম্মেলন উপলক্ষে দেশজুড়ে পোস্টার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আমি প্রথম হয়েছিলাম। ১০ ডিসেম্বর উদ্বোধনী সম্মেলন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে সেদিন আমি মেডেল ও সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম। এখনও সেগুলো আছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু এরকম হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি। প্রকাশ্যে কোনও দিন তাঁর সমালোচনা শুনিনি। তখন বুঝতে পারিনি, লুকিয়ে থাকা রাজাকার-আলবদররা চক্রান্ত চালাচ্ছে গোপনে। বঙ্গবন্ধু তখন শুধু আমি কেন, আমাদের সবার স্বপ্নের নায়ক। যিনি আমাদের একটা স্বাধীন মানচিত্র দিয়েছেন।

বাংলা ট্রিবিউন: ওই সময় ঢাবি ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি কী ছিল?

সুবীর হোম রায়: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। ১২-১৩ আগস্ট থেকেই দেখলাম বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রচুর পোস্টার পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। জাসদের একটা গ্রুপ এই পোস্টারিং করেছিল। ১৪ তারিখ আমরা সারা দিন শাপলা চত্বর থেকে পুরো ক্যাম্পাস বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে সাজাচ্ছিলাম। রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিলাম। রাত পৌনে দুইটা নাগাদ কামাল ভাই ক্যাম্পাসে এলেন সব দেখতে। তিনি দুই সিটের একটা কলাপাতা রঙের টয়োটা স্টারলেট গাড়ি চালাতেন। কিছুক্ষণ থাকার পর বললেন, ‘বাসায় যাই।’ আমি থাকতে অনুরোধ করলাম। কামাল ভাই বললেন, ‘না রে, আমার তো বাসায় যাইতে হবে। বিয়া কইরা ফাঁইসা গেছি।’ সকালে আসবেন বলে কামাল ভাই চলে গেলেন। ওই শেষ দেখা। আজ ভাবি, সেদিন যদি বাসায় না যেতে হতো, আমাদের সঙ্গে থাকতেন, এভাবে প্রাণ হারাতে হতো না।

বাংলা ট্রিবিউন: ১৫ আগস্ট কী করেছিলেন?

সুবীর হোম রায়: ভোরে হলে চলে এলাম স্নান করতে। ৫টা নাগাদ গুলি শুরু হলো। হলের বাইরে বের হয়ে টিএসসির সামনে দেখলাম রমনা থানার দিক থেকে গুলির আওয়াজ আসছে। অনেক আর্মির ভ্যান আমার সামনে দিয়ে শাহবাগের দিকে গেলো। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হলের দিকে আসতে দেখলাম, শহীদ মিনারে পুলিশ কর্মকর্তারা মাইন টেস্ট করছে অনুষ্ঠানের জন্য। তারাও কিছু বলতে পারলেন না। হলে ফিরে এলাম। ৬টা নাগাদ শুনলাম মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি, অজয় দাশগুপ্ত, মৃণাল সরকার আর কার্তিক চ্যাটার্জি ডাকসুর দিকে গেলাম। সেখানেও সব সুনসান। কেউ নেই।

সুবীর হোম রায়ের পুরনো ছবি

অজয়দা বললো, চল মেডিক্যালে যাই। ওখানে তখন আমাদের ইউনিয়ন। মেডিক্যালের ক্যান্টিনে গিয়ে হেলাল ভাইকে সব বললাম। নিচে নেমে দেখলাম করিডোরে আর্মি ভরে গেছে। সবাইকে মেডিক্যাল থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ওখান থেকে সরে গিয়ে আউটডোরের সামনে এলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম। চারটা মরদেহ স্ট্রেচারে শোয়ানো। কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল না বলে দেখতে পেলাম আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আর শেখ ফজলুল হক মনির রক্তাক্ত লাশ। আর দুটি শিশুর লাশ।

বুঝতে পারলাম, যা বলা হচ্ছে তা সত্যি। বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর গোটা পরিবারকে খুন করেছে জল্লাদরা। কামাল ভাইকেও মেরে ফেলেছে। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অজয়দা বললো, এখানে থাকা যাবে না। শেলটারে যেতে হবে। আবার দেশ ছাড়লাম। পালিয়ে এলাম কলকাতায়। আর ফেরা হয়নি মাতৃভূমিতে। আজও ঢাকায় গেলে জগন্নাথ হলে, টিএসসিতে যাই। কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডার স্মৃতি বারবার ফিরে আসে।

/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
করারোপ নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে: সলিমুল্লাহ খান
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
সর্বশেষ খবর
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
নড়াইলে ‘সুলতান মেলা’ উপলক্ষে আর্ট ক্যাম্প
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
লোকসভা নির্বাচন: রাস্তার দাবিতে ভোট বয়কট করলেন গ্রামবাসী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্মরণে কাল নাগরিক সভা
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!