X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ রক্ষাকারী গাছের গোড়ায় ক্ষতিকর প্লাস্টিক টব

আমানুর রহমান রনি
২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:০৮আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ০১:২৬

প্লাস্টিকের টবে ফুল গাছ পরিবেশ রক্ষা, সৌন্দর্যবর্ধন এবং শহুরে জীবনের ইটপাথর থেকে কিছুটা দূরে থাকতে আজকাল নাগরিকদের মধ্যে গাছপালার প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। সুযোগ পেলেই মানুষজন বাসাবাড়ির আঙিনা, বারান্দা, সিঁড়ি, ছাদ এমনকি বসা, শোয়া ও খাওয়ার ঘরেও টবে বাহারি নানা ধরনের গাছ লাগিয়ে থাকেন। তবে এখন মাটির টবের জায়গা দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিকের রঙিন টব। সহজলভ্য ও সহজ ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় অনেকেই এখন বাসাবাড়িতে গাছ লাগাতে প্লাস্টিকের টবের দিকে ঝুঁকছেন।

কিন্তু প্লাস্টিকের এমন ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অসচেতনতার কারণেই মানুষজন এগুলো ব্যবহার করছেন। এভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য ঘরে গাছ রাখতে গিয়ে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক পণ্যও। তাৎক্ষণিক প্রভাবের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর প্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত মানুষের বিপদ বাড়িয়ে তোলে।

প্লাস্টিকের টব এ বিষয়ে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি, যার ভেতরে প্রকৃতির মান থাকে না, তা কোনও না কোনোভাবে মানুষের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিক যেহেতু কেমিক্যালের সমন্বয়ে তৈরি হয়, এগুলো বাসাবাড়িতে থাকলে তা অবশ্যই স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তাছাড়া, টবে যে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের।’

রাজধানীর বিভিন্ন নার্সারি, ফুটপাত ও গৃহসজ্জা সামগ্রী বিক্রির দোকানে এখন সারি সারি প্লাস্টিকের টব দেখা যায়। বিভিন্ন কোম্পানির এসব টব বাসাবাড়িতেও দেখা যায়। আগে মাটির ও কাঠের তৈরি টব থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিকের টব ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে। ঘরের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে অনেকেই প্লাস্টিক টব কিনে তাতে গাছ রোপণ করছেন। গত এক সপ্তাহ রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, নিউমার্কেট, দোয়েল চত্বর ও শাহবাগ এলাকার বিভিন্ন মার্কেট ও ফুটপাতে হরেক রকমের প্লাস্টিকের টব বিক্রি করতে দেখা গেছে।

প্লাস্টিকের টব ধানমন্ডির ২৭ নম্বরের ফুটপাতে রুহুল আমিন নামের একজন বিক্রেতা গত শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন মাটির টবের চাহিদা নেই। আমি একটি কোম্পানির প্লাস্টিকের টব বিক্রি করি। এসব টব বিভিন্ন রঙের হওয়াতে বাসাবাড়িতে ভালো ফুটে ওঠে। তাই এগুলোই বেশি বিক্রি হচ্ছে।’ তিনি জানান, বিভিন্ন দামের টব আছে। ছোট টব ৩০ টাকা থেকে শুরু। এরপর ৬০, ৮০ ও ১২০ টাকা দামের টবও আছে। অবিকল মাটির টবের মতো দেখতেও টব আছে।

শনিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার বিভিন্ন নার্সারিতেও প্লাস্টিকের টব দেখা গেছে। অনেকে দেখেশোনে প্লাস্টিকের টব কিনছেন। সেখানে কর্তব্যরত একজন বিক্রেতা মো. সোহেল বলেন, ‘মাটির টব আনা-নেওয়ায় অনেক সমস্যা ছিল। এগুলোর অনেক ওজন, আনা-নেওয়া করতে গিয়ে অনেক সময়ই ভেঙে যেত। এখন প্লাস্টিকের হওয়াতে সবাই সহজে গাছসহ বহন করতে পারে। তাই প্লাস্টিকের টব বেশি বিক্রি হচ্ছে।’ অধিকাংশ ক্রেতাই চোখে দেখে ভালো লাগার কারণে এসব প্লাস্টিকের টব কিনছেন বলে জানিয়েছেন। তারা পরিবেশ ও নিজের স্বাস্থ্যের কথাটা কমই ভাবছেন।

প্লাস্টিকের টবে ফুল গাছ শনিবার দুপুরে দেখা গেছে, রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনের ফুটপাত থেকে একজন মধ্যবসয়ী নারী প্লাস্টিকের টব কিনছেন। ছোট ছোট পাঁচটি ঝুলানো টব কিনেছেন তিনি। প্রতিটির দাম ৬০ টাকা করে। মাটির টব না কিনে প্লাস্টিকের টব কেনার কারণ হিসেবে তিনি জানান, মাটির টব বাসায় নিয়ে আলাদা রশি দিয়ে বারান্দায় টানাতে হবে। কিন্তু প্লাস্টিকের টবের সঙ্গে রশি থাকে। ঝুলানোর ব্যবস্থাও করা আছে। তাছাড়া, পড়ে গেলে ভাঙার কোনও আশঙ্কা আশঙ্কা নেই।

তবে প্লাস্টিকের টবে স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, লতানো গাছ ঝুলন্ত টবে লাগালে দেখতে ভালো লাগে। তাই এগুলো কিনেছি। বাজারে পাতাকৃতি, ত্রিকোণাকার, গোলাকার, মটকাকৃতি, গোলাকৃতি, চৌকোণাকার ইত্যাদি ছোট-বড়, নানান রঙ, নানান আকৃতির প্লাস্টিকের টব পাওয়া যায়।

প্লাস্টিকের টবে ফুল গাছ যেখানে দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, সেখানে পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এই প্লাস্টিক এখন মানুষ ও পরিবেশ রক্ষাকারী লতাপাতা ও গাছের নিচেই রাখা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষাকারী গাছের গোড়ায় প্লাস্টিকের টব নিয়ে ভাবছেন পরিবেশবাদীরাও। তারা বলছেন, যেকোনও ধরনের প্লাস্টিক পণ্যই এড়িয়ে চলা উচিত।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ব্যবহৃত এসব টব এখন ঘরের পরিবেশের জন্যও হুমকি হয়ে দেখা দেবে। প্লাস্টিক দূষণ বন্যপ্রাণী, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, এমনকি মানবজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্লাস্টিকের টব এখন মানুষের ঘরে, বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। পরিবেশবান্ধব কিনা তা যাচাই বাছাই ছাড়াই এগুলো মার্কেটে চলে এসেছে।’

প্লাস্টিক রিসাইকেল সম্পর্কে এই পরিবেশ আন্দোলনকারী বলেন, ‘আমাদের দেশে প্লাস্টিক রিসাইকেল প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রাচীন। এখানে প্লাস্টিক সাধারণ প্রক্রিয়ায় গলিয়ে ডাইসে দিয়ে সামগ্রী তৈরি করা হয়। এটা উন্নত রাষ্ট্রে চিন্তাও করা যায় না। এতে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ হয়।’

প্লাস্টিকের ভয়াব্হতা তুলে ধরে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমেরিকার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ক্যান্সারের যে আটটি কারণ উল্লেখ করেছে, প্লাস্টিক তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিকস প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার নেয়। পানিতে থাকা প্লাস্টিক একসময় কণায় রূপ নেয়। সেগুলো যদি মাছ গ্রহণ করে, তবে সেই মাছ খেলে মানুষের শরীরে সেই প্লাস্টিক প্রবেশ করবে।’

এজন্যই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিকের আসবাবপত্র, টব, থালাবাসন— কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এর পরিবর্তে কাঠের বা মাটির টব ব্যবহার করা উচিত। কারণ, স্বাস্থ্যসম্মত প্লাস্টিক ছাড়া সব প্লাস্টিকই ঝুঁকিপূর্ণ। প্লাস্টিক সামগ্রীর পাশাপাশি তাতে কোনও খাবার থাকলে সেখানেও এক ধরনের বিক্রিয়া হয়, যা থেকে খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। তাই প্লাস্টিক এড়িয়ে চলাই ভালো।’

প্লাস্টিক পণ্যের প্রকারভেদ ও পরিবেশে এর প্রভাব তুলে ধরে ডা. লেলিন বলেন, ‘প্লাস্টিকের কিছু গ্রেড আছে। যেমন— কোনও প্লাস্টিক একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হয়, কিছু প্লাস্টিক নির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যবহার করতে হয়, আবার কিছু প্লাস্টিক দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করা যায়। কোন গ্রেডের প্লাস্টিক আমরা ব্যবহার করছি, সেটা বিবেচনার বিষয়। আমাদের দেশে ব্যবহৃত প্লাস্টিক অত্যন্ত নিম্নমানের। এগুলো বায়োডিগ্রেডেবল নয়; অর্থাৎ, এ প্লাস্টিক অপচ্য বর্জ্য। ফলে কোনও প্লাস্টিক কন্টেইনার, কৌটা বা সামগ্রী ফেলে দিলে বছরের পর বছর তা মাটিতেই থাকে, মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। এতে মাটির গুণগত মান ও উর্বরতা নষ্ট হয়। ভূমির যে প্রাণ (গাছ, উদ্ভিদ), তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাটির ভেতরে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, নদী, খাল, বিলের স্রোতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এগুলোর সবই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।’

শরীরে প্লাস্টিকের ক্ষতির প্রভাবের প্রসঙ্গ টেনে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘খাদ্য চক্রাকারে মাছ ও ফলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্লাস্টিক প্রবেশ করে। আর থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী। তাছাড়া, সাধারণত প্লাস্টিক পদার্থে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক রঞ্জক মেশানো হয়। এসব রঞ্জক কারসিনজেন হিসেবে কাজ করে ও এন্ডোক্রিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’ তিনি বলেন, ‘যে প্লাস্টিক ৮০’র দশকে জীবনযাপন সহজের জন্য ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল, সেটা এখন অভিশাপে রূপ নিয়েছে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি