পুলিশ বাহিনীর বড় পদে থেকে ডিআইজি মিজানুর রহমান প্রভাব খাটিয়ে সম্পদ অর্জন করেছেন এমন অভিযোগ আড়াই বছর আগে উঠলেও তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগের শুরু ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। দেড় বছর আগে অভিযোগ নথিভুক্ত করে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমন প্রেক্ষাপটে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনে জড়িয়ে নিজেকে আলোচনায় এনেছেন মিজান। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তার বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ তদন্তে আর কত সময় লাগবে।
পুলিশ সদর দফতর ও দুদক সূত্রে জানা গেছে, মিজানের বিরুদ্ধে উচ্চপদে থেকে তদবির, নিয়োগ, বদলিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াসহ দেশে-বিদেশে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ আছে তার নিজ দফতর ও দুদকে। নারী গণমাধ্যমকর্মীকে যৌন হয়রানি, অপহরণ ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগও আছে পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মিজানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ঘুষ লেনদেনসহ নানা অভিযোগে গত রবিবার (১৬ জুন) পুলিশ সদর দফতর আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি শিগগিরই মিজানকে বরখাস্ত করাসহ তার বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে বলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পুলিশ সদর দফতরের এনআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং) সোহেল রানা বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
২০১৭
এ বছরের জানুয়ারিতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকা মিজানের বিরুদ্ধে হয়রানি, অপহরণ ও হত্যার হুমকি দেওয়ার মৌখিক অভিযোগ করেন পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
১৪ জুলাই রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের সামনে থেকে মরিয়ম আক্তার ইকো নামে এক নারীকে অপহরণ করেন মিজান।
১৭ জুলাই মগবাজারে তাকে জোরপূর্বক বিয়ে করেন তিনি।
২০১৯ সাল পর্যন্ত গোপন রাখার শর্তে ৫০ লাখ টাকা দেনমোহরে এ বিয়ে হয়। পরে স্ত্রীর স্বীকৃতি চাওয়ায় মরিয়মের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়।
১২ ডিসেম্বর মরিয়ম গ্রেফতার হন। ১৩ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করার পর জামিন আবেদন নাকচ হওয়ায় কারাগারে যেতে হয় মরিয়মকে।
২০১৮
এ বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি জামিন পান মিজানের দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়ম। ২ জানুয়ারি কাশিমপুর কারাগার থেকে ছাড়া পান তিনি।
৮ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতর মিজানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. মইনুর রহমান চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার শাহাবুদ্দীন কোরেশী ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মিয়া মাসুদ হোসেন।
৯ জানুয়ারি মিজানকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। ওই দিনই তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ২ জন সাংবাদিককে ফোন করে হত্যার হুমকি দেন মিজান।
মিজানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য ১০ ফেব্রুয়ারি উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে দায়িত্ব দেয় দুদক।
২১ জানুয়ারি পুলিশের তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথা বলেন মরিয়ম। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি মরিয়মের মা কুইন তালুকদারের বক্তব্য নেয় পুলিশের তদন্ত কমিটি।
১৩ ফেব্রুয়ারি মিজানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরসহ ৬ সংস্থায় চিঠি পাঠায় দুদক। সংস্থাগুলো হলো বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা ও বরিশাল জেলা রেজিস্ট্রার অফিস, বিআরটিএ, রাজউক ও রিহ্যাব।
২৬ ফেব্রুয়ারি মিজানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে জমা দেয় তদন্ত কমিটি।
২৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় পুলিশ সদর দফতর। প্রতিবেদনে মিজানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
২৫ এপ্রিল মিজানকে নোটিশ পাঠায় দুদক। নোটিশে ৩ মে দুদকে হাজির হতে বলা হয় তাকে।
৩ মে সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে মিজানকে সাড়ে ৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম ও উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। একই দিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকাকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন মিজান।
২৮ মে মিজান তার ব্যক্তিগত পিস্তলের জন্য ৪০ রাউন্ড গুলি কেনার অনুমতি চেয়ে মাগুরা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনপত্রে নিজেকে মাগুরার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৯৯৮ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে অতিরিক্ত সুপার ছিলেন তিনি।
২ জুন মিজানের আবেদন নাকচ করার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান মাগুরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুন্নাহার।
১১ জুলাই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় সাত কর্মদিবসের মধ্যে সম্পদবিবরণী জমা দিতে মিজানকে নোটিশ পাঠায় দুদক।
২০ সেপ্টেম্বর মিজানকে তলবি নোটিশ পাঠান দুদক উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী।
৩০ সেপ্টেম্বর তাকে দুদকে হাজির হতে বলা হয়। নোটিশ পাঠানো হয় মিজানের উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসা, কর্মস্থল পুলিশ সদর দফতর এবং বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে। মিজান ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদবিবরণী দাখিলের কথা বলা হয় নোটিশে।
২০১৯
গত ২৩ মে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন দুদকে জমা দেন দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। প্রতিবেদনে মিজানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী মিজানের দখলে আছে ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এর মধ্যে তার নামে আছে ১ কোটি ১০ লাখ ৪২ হাজার টাকার স্থাবর এবং ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ।
মিজানের দাবি, দুদকের অনুসন্ধান থেকে বাঁচতে বাছিরকে গত জানুয়ারিতে ২ দফায় (২৫ লাখ ও ১৫ লাখ) ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। কিন্তু ২ জুন বাছির তাকে জানান, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারের চাপ থাকায় মিজানকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায়নি। বাছিরের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের কথোপকথনের একাধিক অডিও প্রকাশ করেন মিজান। ৯ জুন এ বিষয়ে বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজে প্রতিবেদন প্রচার করা হয়।
মিজানের কাছে তথ্য ফাঁসের অভিযোগে ৯ জুন দুদক পরিচালক বাছিরের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন দুদক সচিব মো. দিলওয়ার বখত। সদস্য ছিলেন মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো. মফিজুর রহমান ও মহাপরিচালক (প্রশাসন) সাঈদ মাহবুব খান।
১০ জুন তদন্ত কমিটির সুপারিশে তথ্য ফাঁসের অভিযোগে দুদক পরিচালক বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
১২ জুন মিজানের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান দুদক পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদ।
১৩ জুন ডিআইজি মিজান ও দুদক পরিচালক বাছিরের ফৌজদারি অপরাধ (ঘুষ লেনদেন) অনুসন্ধানে পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যাকে প্রধান করেন তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ও মো. সালাউদ্দিন। অনুসন্ধান কার্যক্রম তদারক করবেন দুদক পরিচালক নিরু শামসুন নাহার।
১৬ জুন ডিআইজি মিজানের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দফতর। এই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মইনুর রহমান চৌধুরীকে (অ্যাডমিন অ্যান্ড অপারেশন) প্রধান করে গঠন করা তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিন) শাহাবুদ্দীন কোরেশী ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মিয়া মাসুদ হোসেন। মিজানকে নিয়ে করা আগের তদন্ত কমিটিতেও এই তিন জনই ছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুদকও অনেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে, মামলাও হয়েছে। তবে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অনুসন্ধান শুরু করেও ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারায় শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।