X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত তিন ভাইবোন জানে না, মা আর নেই

জাকিয়া আহমেদ
১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২১:১৭আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২১:৩১

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাহেদা বেগমের মা সুরাইয়া খাতুন সুমী জানে, মা আছেন মীমের কাছে আর মীম জানে, মা আছেন সুমীর কাছে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই বোনের কেউই জানে না, মা জাহেদা বেগম আর বেঁচে নেই। এ কথা জানে না হাসাপাতালে ভর্তি থাকা ইমনও। ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত এই তিন ভাই-বোনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে রাখছেন স্বজনরা। জাহেদার মা সুরাইয়া খাতুনও জানেন না, তার মেয়ে আর নেই। এই বৃদ্ধাকেও ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে মিথ্যা কথায়।
গত সোমবার (১১ নভেম্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগ রেলস্টেশনে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যান জাহেদা বেগম। চার ছেলে-মেয়েসহ মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিকালের বড় এই রেল দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধ শতাধিক মানুষ।
জাহেদার ভাইয়ের বউ নীলুফার বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত সপ্তাহে জাহেদার স্বামী মোসলেম উদ্দীন মারা যান। মোসলেম চট্টগ্রামে জাহাজ মেরামতের কাজ করতেন। কাজ করার সময় এক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন।
হাসপাতালের বেডে জাহেদা বেগমের ছোট ছেলে ইমন শ্রীমঙ্গলে তারই দাফন শেষে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন তারা। তবে আলাদা বগিতে থাকায় সুমী, মীম, ইমন ও সুমন রক্ষা পান। তবে সুমন ছাড়া বাকিরা গুরুতর আহত হয়েছে। মায়ের দাফন শেষ করে গ্রামের বাড়িতে আছেন সুমন।
দুর্ঘটনার পর সুরাইয়া বেগম, জাহেদা বেগমের বড় মেয়ে সুমী, ছোট মেয়ে মীম আর ছোট ছেলে ইমনকে ভর্তি করা হয় পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান)। পরে মীমকে নেওয়া হয়ে সিএমএইচে। সুমীর সিটিস্ক্যান করানোর জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে আবার তাকে নিয়ে আসা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। গত বুধবার (১৩ নভেম্বর) রাত ১টায় আবার সুমীকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আর সুরাইয়া বেগম আছেন পঙ্গু হাসপাতালের দ্বোতলায়। ইমন আছে একই হাসপাতালের তৃতীয় তলায়।
শনিবার পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেডে শুয়ে আছেন সুরাইয়া বেগম। তার পায়ের ড্রেসিং চলছে, ব্যথায় চিৎকার করছেন তিনি। একদল চিকিৎসক তার সামনে দাঁড়িয়ে। সুরাইয়ার ক্ষত-বিক্ষত পা দেখে সহ্য করা কঠিন। এ কথার সত্যতা মেলে তার ছেলের বউ নীলুফার বেগমের কথায়। তিনি বলেন, ‘যখন ড্রেসিং করতেছিল ডাক্তাররা, তখন পাটা দেখছি। দেখার পর আমার মাথা ঘুরে যায়, মাথায় পানি দিয়ে অনেকক্ষণ বারান্দায় শুয়ে ছিলাম।’ এ রকম দৃশ্য যেন আর কাউকে দেখতে না হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সবাই মিলে কোন পরীক্ষায় যে পড়লাম, তাই ভাবি!’
পঙ্গু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথম থেকেই সুরাইয়া খাতুনের অবস্থা খারাপ ছিল। তাকে আমরা শুরু থেকেই আশঙ্কামুক্ত বলছিলাম না।’
ড্রেসিং করানোর বেশ কিছুক্ষণ পর সুরাইয়া খাতুন একটু ধাতস্থ হন। তাকে জড়িয়ে ধরে বসেন নীলুফার বেগম। শাশুড়িকে আড়াল করে তিনি বলেন, ‘মা-ছেলে-মেয়ে কেউ জানে না, আপা (জাহেদা বেগম) নেই। সারাক্ষণ তিনি বলতে থাকেন মেয়ের কথা। তাকে বলা হয়েছে, আপা বাড়ি আছে। সেই আবার জানতে চান, তাকে ওষুধ কিনে দেওয়া হয়েছে কিনা, বুঝায়া দেওয়া হয়েছে কিনা— সবকিছু। কিছুক্ষণ পরপরই প্রশ্ন করতেছেন, খুব চিন্তা করতেছেন মেয়ের জন্য।’
আহত সুমী নীলুফার বেগম বলেন, ‘কয়েকদিন আগে মেয়ের জামাই মারা গেছে। মেয়ের শোক সামলাতে তিনি নিজেই যাচ্ছিলেন সবার সঙ্গে চট্টগ্রামে। এখন এই বয়সে যদি শোনেন মেয়েটাই মারা গেছে, তাহলে তাকে কী করে আমরা সামলাবো! সেই চিন্তায় রাত-দিন একাকার আমাদের!’ এই শরীরে এই ধকল উনি কতটা সইতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন নীলুফার বেগম।
ছেলে ইমন মায়ের মৃত্যুর কথা জানে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জানে না, কেউ জানে না। কেবল বড় ছেলে সুমন জানে।’ তিনি বলেন, “সুমী আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আমার আম্মু কোথায়?’ আমি বলেছি, ‘মীমের কাছে।’ আবার মীম জিজ্ঞেস করছে, ‘আম্মু কোথায়?’ বলছি, ‘সুমীর কাছে।’ ইমন জিজ্ঞেস করছে, ‘আম্মু কোথায়?’ তাকে বলছি, ‘সুস্থ হয়ে বাড়ি আছে।’”
নীলুফার বেগম বলেন, ‘তিন ভাই-বোনের কেউ জানে না, ওদের মা নেই। এভাবেই আমরা সবার কাছে মিথ্যা বলে যাচ্ছি। আমাদের কাছে কোনও ভাষা নেই! পাঁচ দিনের মাথায় বাবা-মা দুজনকে হারানো এই বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের কী বলে সান্ত্বনা দেবো!’
সেদিন কখন ঘটনার কথা জানলেন, এমন প্রশ্নে নীলুফার বেগম বলেন, ‘রাতের বেলায় ফোনে জানতে পারি, ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হইছে। সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি নিয়ে সেখানে চলে যাই।’
তিনি বলেন, ‘কাউকে পাই না, অনেক খুঁজে জানতে পারি, হাসপাতালে চারজন রয়েছে। কিন্তু কাউকেই পাচ্ছিলাম না। পরে আমিই যাই অ্যাক্সিডেন্টের পাশের এক স্কুলে। সেখানে লাশের সারিতে খুঁজলাম।’
কীভাবে খুঁজে পেলেন জাহেদা বেগমের লাশ? নীলুফার বেগম বলেন, ‘কাপড় দেখে চিনেছি। সাদা শাড়ি আর গোলাপি ব্লাউজ। আর তো চেনার মতো কিছু ছিল না!’
তিনি বলেন, ‘এমন অ্যাক্সিডেন্ট হইছে, মানুষকে চেনার মতো কোনও উপায় ছিল না! কী নিষ্ঠুর জীবন আমাদের!’

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লিজেন্ডের ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরে জিম্বাবুয়ে
লিজেন্ডের ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশ সফরে জিম্বাবুয়ে
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে  ইসরায়েল?
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা