X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

২০ বছরেও হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন করেনি রাবি কর্তৃপক্ষ!

বাহাউদ্দিন ইমরান
০৭ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:৫৪আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:২৫




মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ

রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, অথচ সেই দেশে নিজের আইনি অধিকার বুঝে পাননি যশোরের মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ। প্রথমে সনদের জন্য আদালত থেকে আদালতে পার করেছেন জীবনের ১১টি বছর। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষতিপূরণের আশায় কেটে গেছে আরও প্রায় ২০ বছর সময়। তবে এতদিনেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত এ মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাস্তবায়ন করেনি রাবি কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধিভুক্ত যশোরের শহীদ মশিউর রহমান কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকে (এলএলবি) ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ। ১৯৮৮ সালের ১৬ এপ্রিল পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। কিন্তু পাসের তালিকায় নিজের রোল নম্বর দেখতে না পেয়ে একই বছরের ৩ মে মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীন জানতে পারেন, তিনি ফাইনাল পরীক্ষায় একটি বিষয়ে ২৪ নম্বর পেয়েছেন। যা ছিল ওই সময়ের নির্ধারিত পাস মার্কের চেয়ে ১ নম্বর কম। তবে যশোর সরকারি এমএম কলেজের সাবেক ভিপি মুক্তিযোদ্ধা মহীউদ্দিন সেখানেই হাল ছেড়ে দেননি। তিনি নির্ধারিত ফি দিয়ে তার উত্তরপত্র পুনরায় নিরীক্ষণের আবেদন জানান।

আবেদন অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় খাতা নিরীক্ষণ করে। তবে ফলাফল প্রকাশ না করে বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। পরে ওই কমিটি খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুরুতর অসদাচরণ খুঁজে পায়। তাই অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ অনুসারে শাস্তি হিসেবে খাতা মূল্যায়নকারী দুই শিক্ষককে যথাক্রমে ৭ ও ১২ বছর খাতা দেখা থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে, ফলাফল প্রকাশিত না হওয়ায় নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বশেষ আশ্রয়স্থল আদালতের শরণাপান্ন হন মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীন। ১৯৮৮ সালে তিনি যশোরের সহকারী জজ আদালতে একটি ঘোষণামূলক মামলা (দেওয়ানি মামলা নম্বর ২৩৩/১৯৮৮) দায়ের করেন। মহিউদ্দীনের অপ্রকাশিত ফলাফল প্রকাশের নির্দেশনা দিয়ে ১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর ডিক্রি জারি করেন আদালত। ওই ডিক্রির বিরুদ্ধে যশোরের জেলা জজ আদালতে আপিল দায়ের করে রাবি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জেলা জজ আদালত রাবি কর্তৃপক্ষের আবেদন না মঞ্জুর ঘোষণা করেন।

এরপর যশোরের জেলা জজ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রাবি প্রশাসন ১৯৯৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগে একটি দেওয়ানি রিভিশন আবেদন (৩৩৭২/১৯৯৩) দায়ের করেন। এখানেও ব্যর্থ হয় রাবি কর্তৃপক্ষ। কেননা, ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর বিচারপতি (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি) এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ রাবি কর্তৃপক্ষের দেওয়ানি রিভিশনটি খারিজ করে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন এবং মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীনকে মামলার খরচ প্রাপ্তির অধিকারী ঘোষণা করেন। কিন্তু ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আর কোনও আপিল না করায় মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীনের পক্ষে হাইকোর্টের রায়টি বহাল থেকে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘কোনও মোকদ্দমার রায়ে ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা থাকলে তা বাস্তবায়ন করা সংশ্লিষ্টদের জন্য বাধ্যতামূলক।’

হাইকোর্টের রায়ের পর ২০০১ সালের ২৯ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীনের এলএলবি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে রাবি কর্তৃপক্ষ। ওই ফলাফলে এলএলবি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীনকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। তবে হাইকোর্টের রায় অনুসারে মামলার খরচ ও ক্ষতিপূরণ পরিশোধ না করায় রাবি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণের ১০ লাখ টাকা চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের পক্ষে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই নোটিশের জবাব দেবে বলে আশ্বাস দিলেও এখনও পর্যন্ত কোনও জবাব দেয়নি। এমনকি এ বিষয়ে পরবর্তীতে আরও কিছু চিঠি, ই-মেইল এবং ফোনে রাবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে কোনও কর্ণপাত করেননি।

নিজের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় মহিউদ্দীন বারবার রাবি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই যোগাযোগের মধ্যই কেটে গেছে তার জীবনের অনেকগুলো বছর। অবশেষে ২০১০ সালে প্রথমে ব্রেন স্ট্রোক করেন তিনি। এরপর আরও কয়েকবার স্ট্রোক করায় ২০১৬ সালে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীন আহমেদের সর্বশেষ সংকটাপন্ন অবস্থার বর্ণনা করে রাবি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন তারই বড় ছেলে আসিফ শাহরিয়ার সৌম্য।

আসিফ শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারিতা কারণে আমার বাবার জীবনের সোনালী সময় শুধু নষ্টই হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের পুরো পরিবার। রাবি প্রশাসন শুধু কালক্ষেপণ করেছে এবং ন্যায়বিচার ব্যাহত করতে বারবার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। আইনিভাবে বাবাকে হয়রানি করা হলেও উচ্চ আদালতের রায় বাবার পক্ষে আসে। এতে আমার বাবা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তাই ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে রাবি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত ও মৌখিকভাবে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা কৌশলে বিষয়টি পাস কাটিয়ে যাচ্ছে। আমরা লিখিতভাবে ও ইমেইলের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে এ বিষয়ে অবহিত করেও কোনও সদুত্তর পাইনি।’

রাবির রেজিস্ট্রার প্রফেসর এম. এ. বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে আমাদের কী ফল্ট ছিল, তা আমার জানা নেই। এটা দেখতে হবে, না দেখে কিছু বলতে পারবো না।’

আসিফ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমার বাবা ও দাদা উভয়ে মুক্তিযোদ্ধা। দাদা মুন্সী জালাল উদ্দীন প্রবাসী মুজিব নগর সরকারের একজন কর্মচারী ছিলেন। একাত্তরে জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা দেশ স্বাধীন করেছেন। অথচ আজ  তারা স্বাধীন দেশেই এভাবে অবহেলিত কেন? আমি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবারর কাছে বাবার প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণ দ্রুত প্রদানে রাবি প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করছি। তাহলে জীবনের শেষ সময়ে এসেও অন্তত একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশে আইনের শাসন দেখে যেতে পারবেন। আর ক্ষতিপূরণের টাকায় বাবার উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে। তাই বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।’

তবে এতদিনেও রায়টি বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ভুক্তভোগী মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের করণীয় বিষয়ে বলেন, ‘রায়টি বাস্তবায়ন না করা আদালত অবমাননার শামিল। এখনও ভুক্তভোগীর পরিবার চাইলে একটি দরখাস্ত দিয়ে রাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনতে পারে এবং এতদিন রায় বাস্তবায়ন না হওয়ারও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। সেটা অবশ্যই আদালত বিবেচনা করবেন।’

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!