X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ মাহদী কোথায় ছিলেন?

চৌধুরী আকবর হোসেন
১০ আগস্ট ২০২০, ১৫:৪৯আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২০, ১৮:৩০

আশরাফ মাহদী প্রায় দু’দিন নিখোঁজ ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নাতি আশরাফ উদ্দীন মাহদী। ফিরে এলেও তার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে রহস্য কাটছে না। নিখোঁজ হওয়ার সময়ে ইসলামী ঐক্যজোটের দু’জন নেতাকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত করেছেন মাহদী, যদিও ফিরে আসার পর তিনি ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানাননি। এদিকে পুলিশ বলছে তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার। এদিন রাত ১১টা ২৭ মিনিটে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন আশরাফ উদ্দীন মাহদী। তিনি লেখেন, ‘লালবাগ থেকে বাসায় ফেরার পথে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কিছু হলে দায়ী থাকবে মুফতি ফয়জুল্লাহ আলতাফ গং।’ এর দুই দিন পর ৮ আগস্ট রাত ১১টা ৪০ মিনিটে আবারও ফেসবুকে পোস্ট দেন মাহদী। এবার তিনি লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আবারও সুস্থভাবে ফিরিয়ে এনেছেন। তবে তাদের শেষ কিছু কথাবার্তায় শঙ্কা কাটেনি। প্রশাসনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার পরবর্তী নিরাপত্তার বিষয়টিও তারা দেখবেন বলে আশাবাদী।’

ফিরে আসার পর ফেসবুকে তিনটি পোস্ট দিয়েছেন আশরাফ মাহদী। সেখানে তিনি তার নিখোঁজ হওয়ার পর যারা প্রতিবাদ জানিয়েছেন ও খোঁজ নিয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। নিখোঁজ হওয়ার সময় মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা আলতাফ হোসেনের নাম লিখলেও পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে কোনও কিছুই পরিষ্কার করেননি মাহদী।

তবে তাকে কেউ তুলে নিয়ে থাকলে ওই সময়ে কীভাবে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিলেন? সেই ব্যাখ্যা দিয়ে মাহদী একটি পোস্টে লিখেছেন—‘তারা খুব পেশাদার কেউ ছিল বলে আমার মনে হয়নি। আমাকে ধরার প্রায় ১০ মিনিট আগেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমাকে ফলো করছে। তখনই আমি স্ট্যাটাস লিখে ফেলি এবং রিকশা থেকে নামার আগেই পোস্ট দিয়ে ফেলি। যদি তারা আমাকে না ধরতো তাহলে পোস্ট সরিয়ে দিতাম। দুই দিন তারা আমাকে একটা কথাই বুঝিয়েছে— ফেসবুকে লেখালেখি বন্ধ করতে হবে। লেখালেখি না করার শর্তেই আজ মুক্তি পেয়েছি।’

আশরাফ মাহদী নিখোঁজ হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে কেন তিনি মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন? তার নিখোঁজের পেছনে রহস্য কী? এ বিষয়ে জানতে আশরাফ উদ্দীন মাহদীকে বারবার কল করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সূত্র জানায়, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দুই ছেলে ও চার জামাতা তার প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলো পরিচালনা ও শিক্ষকতার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। এছাড়া এদের মধ্যে আমিনীর ছোট ছেলে ও তিন জামাতা ইসলামী ঐক্যজোটের বিভিন্ন শীর্ষ পদে রয়েছেন। অন্যদিকে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব পদে ও লালবাগ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন মুফতি ফয়জুল্লাহ। আর মাওলানা আলতাফ হোসেন রয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব পদে। দলটি ২০১৬ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। যদিও এই জোট ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না আমিনীর জামাতারা। গত ১১ মে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী মারা যান। তার মৃত্যুর পর ১২ মে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী। বরাবরই দলের পদ, সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আমিনীর জামাতা মাওলানা জসিম উদ্দিন, মাওলানা জুবায়ের, মুফতি সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা আলতাফ হোসেনের।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান পদে আসতে চান মাওলানা জসিম উদ্দিন। অন্যদিকে লালবাগ মাদ্রাসার শুরা পদ্ধতি বাদ দিয়ে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যও চেষ্টা চালাচ্ছেন মাওলানা জসিম উদ্দিন ও মাওলানা জুবায়ের।

মাহদী নিখোঁজ হওয়ার পর লালবাগ থানায় জিডি করেছিলেন তার বাবা মাওলানা জসিম উদ্দিন। এরপর মাওলানা আলতাফ ও মুফতি ফয়জুল্লাহর বাসায় যায় পুলিশ। তবে সে সময়ে ঢাকায় ছিলেন না মাওলানা আলতাফ।

মাহদীর বাবা মাওলানা জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাহদী ফিরে এসেছে। সে বেশ ক্লান্ত, তার সঙ্গে এখনও বিস্তারিত কথা হয়নি। কারা, কীভাবে নিয়ে গেলো। তবে তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেনি। শুধু তাকে বলেছে— সে যেন আর লেখালেখি না করে।’

দলের পদ নিয়ে কোনও বিরোধ আছে কিনা জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, ‘যেকোনও দলের কর্মী দলের শীর্ষ পদে যেতে চায়, আমিও চাই। তবে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা আমি মেনে নেবো। এই মুহূর্তে বলতে পারছি না যে মাহদী কেন এমন অভিযোগ করেছে। আমি চেষ্টা করছি নিজের মধ্য কোনও সমস্যা থাকলে সেটি মিটিয়ে ফেলতে।’

জানা গেছে, মাহদী একসময় ইসলামী ঐক্যজোটের ছাত্র সংগঠনে ছিলেন। পরে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র জমিয়তে যোগ দেন। মাহদী গুম হতে পারেন— এমন শঙ্কা প্রকাশ করে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এমন পোস্ট দিচ্ছিলেন ছাত্র জমিয়তের নেতারা। কেন গুম হওয়ার শঙ্কা— এমন প্রশ্নের জবাবে ছাত্র জমিয়তের প্রচার সম্পাদক মাহফুজুর রহমান ইয়ামিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেফাকে দুর্নীতি আছে। আবার মুফতি ফয়জুল্লাহকে নিয়ে তিনি লেখালেখি করেছেন। মাওলানা আলতাফকে নিয়েও লিখেছেন তিনি (মাহদী)। এ কারণে আমরা ধারণা করেছি তাকে গুম করতে পারে। বাস্তবেও তারা সেটি করলো।’

মাহদী নিখোঁজ হওয়ার আগে সর্বশেষ দেখা হয় তার খালু মাওলানা সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি একইসঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন। মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাওলানা আলতাফের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এটা আমার জন্য বলা মুশকিল। এমনিতে ওদের মধ্যে ঝামেলা চলতেছে। কিন্তু কে কতটুকু এটার জন্য দায়ী, তা আমার জন্য বলা মুশকিল। ৫-৬ বছর ধরেই এই ঝামেলা চলছে। ঝামেলা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব, কর্তব্য, কর্তৃত্ব নানা বিষয় নিয়ে।’

দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আলতাফ-ফয়জুল্লাহ সাহেব তো আমাদের নিজেদের কেউ না। কেউ কাউকে মানলে তো সমাধান হবে। প্রত্যেকে নিজের মতো করে চলতেছে। মাহদী তো ছাত্র মানুষ। আর ফয়জুল্লাহ সাহেবের বক্তব্য শুনে সমাধান কে করবে— উনি তো অনেক বড় নেতা। উনার সমাধান উনাকেই করে নিতে হবে।’

সম্প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে ফেসবুকে লিখে আলোচনায় আসেন আশরাফ মাহদী। তিনি অভিযোগ করেন, তার নানা ফজলুল হক আমিনীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে, যার জন্য তিনি মাওলানা আলতাফকে দায়ী করেন। যদিও মাহদীর এমন অভিযোগ তোলার পর আমিনীর ছেলে আবুল হাসনাত আমিনী ফেসবুক লাইভে আসেন। তিনি তার ভাগিনা মাহদীর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগরী ছাত্র খেলাফত নেতা ওসমান কাসেম হামলার শিকার হলে মামলা দায়ের করেন। সেখানে আশরাফ মাহদীকেও অভিযুক্ত করা হয়। সেই মামলায় পুলিশ মাহদীকে গ্রেফতার করে। ২৮ জুলাই তাকে আদালতে তোলা হয়। পরবর্তীতে জামিন পান মাহদী।

মাহদীর অভিযোগ প্রসঙ্গে মাওলানা আলতাফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমে মাহদী আমার বিরুদ্ধে আমিনী সাহেবকে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগ তোলে। যদিও পরবর্তীতে আমিনী সাহেবের ছেলে হাসনাত আমিনী ফেসবুকে লাইভে এসে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন। এখন আবারও তাকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ এলো, অথচ সেদিন আমি গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। ঢাকায় আমার বাসায় পুলিশ গেলো। তার কর্মকাণ্ডে আমি সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি। তাদের কাছে যদি কোনও ধরনের তথ্য প্রমাণ থাকে— তবে তারা মামলা করুক। আমি অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী আমার শাস্তি হবে। কিন্তু তা না করে আমাকে ফেসবুকে লিখে হেয় করা হচ্ছে কোন উদ্দেশ্যে তা পরিষ্কার না।’

এ বিষয়ে আমিনীর ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আশরাফ হোসেন বলেন, ‘তিনি (মাহদী) ও তার বাবা আমাদের জানিয়েছেন যে, চলে আসছেন, এ পর্যন্ত। কোথায় গিয়েছিলেন আমাদের তা বলেননি। জিজ্ঞাসাবাদেও এগুলোই জানিয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
ট্রেনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
রামরুর কর্মশালায় বক্তারাঅভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের