X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ুর টাকায় ফুট ওভারব্রিজ, ট্রাফিক বাতি!

শাহেদ শফিক
০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০০আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:১৭

জলবায়ুর টাকায় ফুট ওভারব্রিজ, ট্রাফিক বাতি! জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনওটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরূপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক ও এ খাতের অনিয়ম নিয়ে শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব
ঢাকার জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্প গ্রহণ করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। পরিবেশ অধিদফতর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এতে অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পটির মাধ্যমে জলবায়ুর উন্নয়নে ফুটওভার ব্রিজ ও ট্রাফিক সিগনাল বাতি স্থাপন করা হয়েছে। ইস্পাতের তৈরি ফুটওভারব্রিজ, বৈদ্যুতিক ট্রাফিক সিগনাল, বাসস্টপেজ, যাত্রী ছাউনি ও ফুটপাত জলবায়ু পরিবর্তনে কী ভূমিরা রাখছে তার উত্তর নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক সিগনাল বাতি ও স্টিলের তৈরি ফুটওভার ব্রিজ জলবায়ুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার প্রশ্নই আসে না। প্রকল্পটির মাধ্যমে যে অর্থব্যয় করা হয়েছে তা পরিবেশে নির্মল বায়ু ছড়াতে কাজে আসেনি।
ডিসিসি সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত ‘ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯১টি সড়কমোড়ে আধুনিক ট্রাফিক সিগনাল বাতি বসানো হয়। প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০০৮ সালের শেষের দিকে। পরে ২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল সিগনাল সিস্টেম চালু করা হয়। তাতেও সফলতা পাওয়া যায়নি। তখন ডিসিসিরি পক্ষ থেকে পুলিশের অসহযোগিতাকেই দায়ী করা হয়েছিল। ফুট ওভারব্রিজ
পরে আবারও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০০৯ সালে কেইস প্রকল্পের আওতায় ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩০টি ট্রাফিক ইন্টারসেকশনের মধ্যে ২৮টি এবং দক্ষিণের ৪০টি ইন্টারসেকশনের মধ্যে ৩৬টিসহ মোট ৬৪টি ইন্টারসেকশনে সোলার প্যানেল, টাইমার কাউন্টডাউন, ইনভার্টার, কনভার্টার, কন্ট্রোলার ও ক্যাবল স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকে এর কাজ শেষ হয়। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের ২৮টি এবং দক্ষিণের ২৫টি ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে সোলার নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক সিগনাল চালু হয়। এত কিছুর পরও রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি না অত্যাধুনিক পদ্ধতিটি।
ডিসিসি সূত্র জানায়, বেশ কয়েকবার পরীক্ষামূলক চালু করা হলেও দীর্ঘদিন ধরে অকেজো ছিল এ সিস্টেম। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৫ ও ১৬ মে সকালে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক কাকলী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১২টি ইন্টারসেকশনে প্রকল্পটি চালু করা হয়। এর মাধ্যমে বাঁশি আর হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দিন শেষ হবে বলে আশা করেছিল সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু হয়েছে হিতে বিপরীত। ওই দুই দিন ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও সড়কটিতে ছিল ভয়াবহ যানজট। যার মূলে ছিল কথিত আধুনিক সঙ্কেত ব্যবস্থা।
পরে যানজটের ভয়াবহতা দেখে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক গবেষণা না করে প্রকল্প গ্রহণ করায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে। দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর কোনও জবাবদিহিতা না থাকাও এর জন্য দায়ী।
সম্প্রতি এই ট্রাফিক সিগনালগুলোর মধ্যে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম চালুর নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরই মধ্যে ৯৯টি ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম সংযুক্ত করে তা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মেট্রোরেলসহ অন্যান্য নির্মাণ কাজের জন্য বেশ কয়েকটি বাতি খুলে রাখা হয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যাল
অপরদিকে, ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জলবায়ু ফান্ডের তহবিল থেকে দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৩টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ফুটওভার ব্রিজের অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী। এরই মধ্যে পান্থপথের পানি ভবনের সামনের ফুটওভার ব্রিজ খুলে নেওয়া হয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ফুটওভার ব্রিজ কী ভূমিকা রাখছে তার জবাব পাওয়া যায়নি কর্তৃপক্ষের কাছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রকল্পের একটি অংশ দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করে। তাদের কাজগুলোর মধ্যে ফুটপাত, ট্রাফিক সিগনাল, ড্রেন, যাত্রী ছাউনি, বাসস্টপেজ ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। এগুলো দিয়ে তারা কাজগুলোর যথার্থতা বিচার করছে। তারা বলছে এসবের কারণে এখন দুর্ঘটনা কমছে। সেটা আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হচ্ছে না। কারণ এটা নির্মল বায়ুপ্রবাহে কোনও ভূমিকা রাখছে না। এই টাকাটা যদি আমরা অন্যভাবে ব্যয় করতাম তা হলে প্রভাব চোখে পড়তো। কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে বিষদ আলোচনা করেছি। প্রকল্পটি পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আইএমইডি’তে (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) পাঠিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা তো শুধু অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে কিনা সেটি কিন্তু দেখি না। আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু চিন্তা বা পরিকল্পনা থাকতো যদি, সে অনুযায়ীই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হতো।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সেলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফুটওভার ব্রিজ আর ট্রাফিক সিগন্যাল জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কী ভূমিকা রাখছে তা জানা নেই। যারা এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করছে তারা কোন যুক্তিতে এগুলো বাস্তবায়ন করছে তা খতিয়ে দেখা উচিক। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন মানে অপাত্রে দান।

তিনি আরও বলেন, নির্মল বায়ু নিশ্চিত করার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদফতরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কেস প্রকল্প ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারতো, বিশেষকরে বায়ু মান পরীক্ষার সম্প্রসারণ এবং তরুণদেরকে এনগেজ করে আধুনিক প্রযুক্তি বা স্মার্টফোন ভিত্তিক প্রযুক্তির ব্যবহার অধিক দূষিত এলাকায় দূষণবিরোধী বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ। কিন্তু বাস্তবে সেরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করার নজির খুব কম,  জলবায়ু অর্থায়নের এসব বৈদেশিক তহবিলের কার্যকর ব্যবহার না করলে প্রশমন বা বায় দূষণ কোনটা কমানো সম্ভব হবেনা, উল্টো বিদেশি দেনার দায় বাড়বে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে কেইস প্রকল্প পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব কাজ করা হয়েছে সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে কী ভূমিকা রাখছে তা বলতে পারবো না। কারণ প্রকল্প গ্রহণের সময় এর সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম না। প্রকল্প পরিচালক অবসরে যাওয়ার পর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দাতা সংস্থা কীসের ভিত্তিতে টাকা দিচ্ছে সেটা তারাই জানেন। তবে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য-নির্মল বায়ু ও টেকশই পরিবেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে সবুজায়ন কমে যাওয়ায় দিনদিন তাপমাত্রা বেড়ে চলছে। অথচ জলবায়ু তহবিলের যে টাকা দিয়ে ব্রিজ আর সিগনাল বানানো হয়েছে সেই টাকায় বৃক্ষরোপণ করে শহরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। ট্রাফিক সিগন্যাল

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ম ইনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফুটওভার ব্রিজ, ছাউনি, রোড মারকিং কিংবা ট্রাফিক সিগনাল বাতি বায়ুর মান উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখে তা জানা নেই। জলবায়ু ফান্ডের টাকায় এটা কেন?
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোনও জবাবদিহি নেই। এটা থাকলে এমন হতো না। এ ধরনের প্রকল্প জলবায়ুর জন্য সহায়ক নয় বরং লুটপাটকে উৎসাহ দেওয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তপস বলেন, অতীতে অনেক প্রকল্প বাস্তব সমীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে এমন প্রকল্প আর বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। সব প্রকল্পই স্টাডি করে বাস্তবতার নিরীখে হতে হবে।


বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন। ১০ নভেম্বর তার কাছে প্রশ্নগুলো পাঠানো হয়। এর মধ্যে ছিল- ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ' (কেইস) প্রকল্পটি বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনও ভূমিকা রেখেছে কিনা? প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ফুটওভার ব্রিজ ও ট্রাফিক সিগনাল জলবায়ুর জন্য সহায়ক কিনা?’ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায়নি।

/এফএ/
সম্পর্কিত
মুগদায় উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করলেন হাইকোর্ট
ওয়ারীতে ‘হিট স্ট্রোকে’ একজনের মৃত্যু
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
সর্বশেষ খবর
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
বুধবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
বুধবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
সর্বাধিক পঠিত
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী 
উৎপাদন খরচ হিসাব করেই ধানের দাম নির্ধারণ হয়েছে: কৃষিমন্ত্রী