X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘দুঃখিত, বেড খালি নেই’

জাকিয়া আহমেদ
০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:০০আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:২৯

‘দুঃখিত, বেড খালি নেই’ করোনায় আক্রান্ত জটিল রোগীর সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। সরকারি হাসপাতালের প্রায় সব বেডে রোগী রয়েছেন, ফলে অনেককেই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন। আইসিইউ না পেয়ে রোগী মারা যাবার ঘটনাও ঘটছে আগের মতো। চিকিৎসকরা বলছেন, একটি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে নির্ধারিত হাসপাতালের ওয়ার্ডের রোগী পাঠানোর ‘কল’-এর পাশাপাশি হাসপাতালের বাইরে থেকেও অনুরোধ আসছে অনেক। যে কারণে বলতেই হচ্ছে, ‘দুঃখিত, বিছানা খালি নেই’।
আর ঢাকার বাইরের আইসিইউ ফাঁকা কেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইসিইউ বিশেষজ্ঞ বলেন, মফস্বলের মানুষের ধারণা, সেখানকার হাসপাতালের চেয়ে ঢাকায় এলে বেটার ম্যানেজমেন্ট, ওষুধ, যন্ত্রপাতি, সিনিয়র চিকিৎসকসহ আইসিইউগুলোতে সুযোগ সুবিধা বেশি। যার কারণে তাদের সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে ঢাকায় আসার প্রবণতা বেশি।
সুরাইয়া বেগমের বয়স ৬৫ বছর। করোনায় আক্রান্ত সুরাইয়া বেগম বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে নয়টাতে মারা যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
গত ১০ থেকে ১২ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় কুলিয়ে উঠেতে না পেরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হন তিনি। সুরাইয়া বেগম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা লিমার আত্মীয়।
বাংলা ট্রিবিউনকে ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হয়েও আমি এ হাসপাতালের আইসিইউতে একটা বেড ম্যানেজ করতে পারিনি। কারণ, বেড ফাঁকা নেই। গত দুই তিন দিন ধরে আইসিইউর জন্য চেষ্টা করছিলাম, পারিনি ম্যানেজ করতে ।
প্রচুর রোগী বেড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কেবল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজেই প্রায় ৩০ থেকে ৩১ শতাংশ রোগী বেড়েছে।
দেশের প্রথম করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ হাসপাতালে আইসিইউ বেড রয়েছে ১৬টি, সব বেডে রোগী আছেন। আর পাশাপাশি বেড়েছে বেডের জন্য রিকোয়েস্টের চাপ। একইসঙ্গে আইসিইউতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর’ সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গত মাস থেকে এটা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, আইসিইউতে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডেও রোগী অনেক বেশি, প্রায় ফুল। ওয়ার্ড থেকে আইসিইউতে রোগী শিফটিংয়ের হারও বেড়েছে।


তিনি বলেন, একইসঙ্গে অনেক বিষয় আছে। যেগুলো হচ্ছে, ওয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ ও জটিল রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকেই আইসিইউর রিকোয়েস্ট বেশি থাকছে, আবার হাসপাতালের বাইরে থেকেও আইসিউর জন্য অনুরোধ আসছে অনেক বেশি, কিন্তু সেটা দেওয়া যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অধিদফতর ৩ ডিসেম্বর জানানো হয়েছে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা যথাক্রমে ১৬ শয্যা, ১০ শয্যা, ১০ শয্যা ও ১৬ আইসিইউ শয্যার প্রতিটি শয্যায় রোগী রয়েছে। আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৪টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ২২ জন, ফাঁকা রয়েছে দুটি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১১ জন, ফাঁকা রয়েছে চারটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১১ জন, ফাঁকা রয়েছে পাঁচটি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টি শয্যার মধ্যে রোগী আছেন দুইজন, ফাঁকা রয়েছে চারটি। আবার তালিকা থাকে সরকারি হাসপাতালের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউর তালিকা দেখানো হয়েছে শূন্য।
বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালের সাত আইসিইউ শয্যার মধ্যে রোগী আছে সাত জন, আসগর আলী হাসপাতালের ৩১ শয্যাতে রোগী আছেন ২৬ জন, স্কয়ার হাসপাতালের ২৫ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৯ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালের ছয় শয্যার মধ্যে রোগী আছেন পাঁচ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালের ২২ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৪ জন, এভার কেয়ার হাসপাতালের ২০ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৯ জন, ইম্পালস হাসপাতালের ৫৬ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৩ জন, এএমজেড হাসপাতালের ২১ শয্যার মধ্যে রোগী আছেন ১৩ জন ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ১২ শয্যার মধ্যে ১২টিতেই রোগী আছেন। অর্থাৎ, ঢাকা মহানগরীর অধিদফতরের তালিকাতে থাকা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ রয়েছে ৩১৬টি, যার মধ্যে রোগী আছেন ২২৬ জন, আর শয্যা ফাঁকা রয়েছে ৯০টি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ১০টি হাসপাতালের ৩৯টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রোগী আছেন ১৬ জন আর ফাঁকা রয়েছে ২৩টি। সারা দেশের অন্যান্য হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে ২১৯টি, যাতে রোগী আছেন ৯২ জন আর ফাঁকা রয়েছে ১২৭টি।
সারাদেশে অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী, করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ রয়েছে ৫৭৪টি আর তাতে ভর্তি আছেন ৩৩৪ জন, শয্যা ফাঁকা রয়েছে ২৪০টি।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শুরু থেকেই আইসিইউর চাহিদা ছিল অনেক, মাঝে কিছু দিন সহনীয় অবস্থায় এসেছিল, ওয়ার্ডের রোগীর সংখ্যা কমেছিল কিন্তু আবার আগের মতো অবস্থা শুরু হয়েছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে একদিনও একটা শয্যাও ফাঁকা থাকেনি, যখনি সেটা ফাঁকা হয়েছে তখনই রোগী নিতে হয়েছে। সারা দিন একটা বেড শূন্য ছিল—এটা এখনও হয়নি এ হাসপাতালে। কিন্তু তখন ওয়েটিং যে লিস্টটা সেটা ছোট হয়েছিল।
তিনি বলেন, গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেই ওয়েটিং লিস্ট বড় হতে শুরু করেছে, অনেক বড় ওয়েটিং লিস্ট একটা আইসিইউ বেডের জন্য, আমাদের ওয়েটিং লিস্টের খাতাতে একটার পর একটা রোগীর নাম যোগ হচ্ছে।
ডা. শাহজাদ হোসেন বলেন, ওয়ার্ড থেকে যখন আইসিইউর জন্য ‘কল’ হচ্ছে, ‘ওয়েটিং লিস্টে’ থাকা রোগীদের স্বজনদের বলছি, ‘দুঃখিত বিছানা খালি নেই’। সঙ্গে এও বলে দিচ্ছি, যদি রোগীর ওয়েট করার মতো অবস্থা না হয় তাহলে আপনারা অন্য হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা দেখেন, যোগাযোগ করেন। কারণ, আমরা তো তাদের বলতে পারছি না কবে একটা বেড খালি হবে আর কবে সেই রোগীকে আইসিইউতে নিতে পারবো। আর ততক্ষণে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। কারণ, আইসিইউতে যে রোগীর জন্য কল দেওয়া হচ্ছে, ওয়ার্ডে তাকে অক্সিজেন দিয়ে পারা যাচ্ছে না বলেই আইসিইউতে কল দিচ্ছে। সেখানে যদি তাকে আরও অপেক্ষা করতে হয় সে তো পারবে না। ফলাফল হিসেবে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
আইসিইউর জন্য ওয়েটিং লিস্টের তালিকাটা কত বড় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৩ থেকে ১৬ জন রোগীর কলও পাচ্ছি আমরা একদিনে। এই যদি হয় কলের অবস্থা, কিন্তু বেড খালি হলে তো একটা অথবা নিদেনপক্ষে দুইটা হতে পারে। তাহলে এতজন রোগীকে আমি কোথায় পাঠাবো, তাকে অ্যাকোমোডেট করার কোনও ব্যবস্থা নাই।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একইসঙ্গে এই হাসপাতালের ওয়ার্ড ছাড়াও বাইরে থেকে অনেক অনুরোধ থাকে আইসিইউ শয্যার জন্য। কিন্তু আমরা তো আমাদের রোগীকেই নিতে পারছি না, বাইরের রোগীদের কীভাবে নেবো? আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেকেই খরচ চালাতে পারেন না, তাই সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর চাহিদা অনেক বেশি।
এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আজ (৩ ডিসেম্বর) তাদের করোনা রোগী সুস্থ হবার ‘ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল’ করার পরই দ্রুত ছেড়ে দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী মারুফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যখন সংক্রমণ বাড়ে তখন সংক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যাও বাড়ে। তাই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, আইসিইউতে ওয়েটিং লিস্টের তালিকা বড় হচ্ছে দিনকে দিন। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন, কোনও কোনও দিন এরচেয়েও আইসিইউ বেডের জন্য কল পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু বেড পাওয়া যাচ্ছে না।

/এমআর/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
বিএসএফের ছোড়া ৩০টি ছররা গুলি লাগলো বাংলাদেশি যুবকের শরীরে
বিএসএফের ছোড়া ৩০টি ছররা গুলি লাগলো বাংলাদেশি যুবকের শরীরে
ভুল হলে রিয়াল-বার্সার ম্যাচটি পুনরায় মাঠে গড়ানো উচিত: লাপোর্তা
ভুল হলে রিয়াল-বার্সার ম্যাচটি পুনরায় মাঠে গড়ানো উচিত: লাপোর্তা
ভারতের মণিপুরে হয়রানির শিকার হয়েছে সাংবাদিক-সংখ্যালঘুরা: যুক্তরাষ্ট্র
ভারতের মণিপুরে হয়রানির শিকার হয়েছে সাংবাদিক-সংখ্যালঘুরা: যুক্তরাষ্ট্র
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি