X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস

এনামুল করীম ইমাম
২৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:০০আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:০০

হজরত আদম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমন করার পরে প্রত্যেক মাসে তিনটি রোজা রাখতেন। এটা শুকরিয়া হিসেবেও হতে পারে। আবার তাওবা হিসেবেও হতে পারে। চাঁদের হিসেবে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে এই রোজা রাখতেন। কারণ, এই দিনগুলোতে চাঁদ পূর্ণতা পায়।

বলা হয়, একবার তিনি পানিতে নিজের চেহারা দেখে বুঝতে পারেন যে জান্নাতের সৌন্দর্য ও লাবণ্য তিনি এখানে পাননি। তখন তিনি দুঃখিত হয়ে বলেন, হে আল্লাহ, জান্নাতের পোশাকও আমার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার সৌন্দর্য ও লাবণ্যও দেওয়া হয়নি। তখন তাকে বলা হয়, তুমি মাসে তিনটি রোজা রাখো। তিনি এই রোজা রাখতে শুরু করেন, যার বদৌলতে আগের মতো জান্নাতি রূপ-লাবণ্য ও ঔজ্জ্বল্য ফিরে পান। অবশ্য আলোচ্য বক্তব্যের কোনও সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।

যেভাবেই হোক, হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে রোজার ধারাবাহিকতা শুরু হয়।

তার পরবর্তী যুগে হজরত নূহ আলাইহিস সালাম এই রোজা রাখতেন। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামও রোজা রাখতেন। এ ব্যাপারে হাদিসে নববিতেও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাওয়া যায়। হজরত মুসা আলাইহিস সালাম যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহ তাআলার সাথে কথোপকথনে গমন করেন, তখন তিনি ৪০ দিন রোজা রাখেন। হজরত দাউদ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার রাজত্বও দিয়েছিলেন। আবার নবুয়তও দিয়েছিলেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, একদিন ইফতার করতেন। বছরে ছয় মাস রোজা রাখতেন। হাদিসে নববিতে একে রোজা রাখার উত্তম পদ্ধতি বলা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন : 

আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় রোজা হলো হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের নিয়মে রোজা পালন করা। তিনি একদিন সওম পালন করতেন, আরেক দিন বিরত থাকতেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৩১]

হজরত জাকারিয়া ও ইয়াহইয়া আলাইহিমাস সালামও রোজা রেখেছেন। হজরত ঈসা আলাইহিস সালামও দুই মাসের রোজা রাখতেন। হিন্দু ব্রাহ্মণরাও ৪০টি রোজা রাখেন। অতএব, বোঝা গেলো প্রত্যেক ধর্মে Fasting (রোজা) ইবাদত রয়েছে। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় Fasting (রোজা) শিরোনামের অধীনে লেখা হয়েছে, ‘আমরা দুনিয়ার এমন কোনও ধর্ম পাইনি, যে ধর্মে রোজার ইবাদত নেই।’

আশুরার রোজা: হিজরত করে মদিনায় আসার কিছু দিন পর থেকেই মুসলিমরা আশুরার রোজা পালন করতে শুরু করেন। এই সময় আশুরার রোজাই তাদের ওপর ওয়াজিব ছিল। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসেন তখন দেখতে পান, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তাদের রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা ও বনি ইসরাইলকে ফিরাউনের ওপর বিজয় দিয়েছিলেন। তাই আমরা ওই দিনের সম্মানে রোজা পালন করি। 

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আলাইহিস সালামের বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি সবাইকে রোজা পালনের নির্দেশ দেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯৪৩]

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন : 

জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করতো এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই রোজা পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনও এই রোজা পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজা ছেড়ে দেওয়া হয়। যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। [সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০২]

বেশিরভাগ ফকিহ ও মুহাদ্দিসের মতে, রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল, যা পরবর্তী সময়ে নফলে পরিণত হয়। আর প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান সবসময় মুস্তাহাব ছিল। 

রমজানের রোজা: দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ হয়। এই হিসাবে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোট ৯ বছর রমজানের রোজা পালন করেছেন। [আল-মাজমুআ: ৬/২৫০]

প্রথমে ইচ্ছাধিকার ছিল: রমজানের রোজা যখন প্রথম ফরজ হয়, তখন রোজা রাখা ও ফিদিয়া দেওয়ার ইচ্ছাধিকার দেওয়া হয়।

এরশাদ হচ্ছে:

(তোমাদের ফরজ করা হয়েছে) রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এটা যাদের মারাত্মক কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য হলো, এর পরিবর্তে ফিদিয়া—একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। অবশ্য রোজা পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে। [সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৪]

ফরজ বিধান : এরপর কোনও প্রকার অবকাশ না রেখেই রোজা ফরজ করা হয়।

এরশাদ হচ্ছে : 

রমজান মাস। এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫]

সময় রদবদল : রমজানের রোজা যখন ফরজ হয়, তখন কেবল রাতের বেলা এশার নামাজ বা ঘুমের আগ পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-সহবাসের সুযোগ ছিল। এশার নামাজ বা ঘুমের পর পানাহার ও স্ত্রী-সহবাস নিষিদ্ধ হয়ে যেতো। পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সময় সংক্ষিপ্ত করে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার সময় নির্ধারণ করেন।

এরশাদ হচ্ছে : 

রোজার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সহবাস বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ জানেন যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সঙ্গে সংগত হও এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা করো। আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাতের কৃষ্ণরেখা থেকে ঊষার শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়। [সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭]

এভাবেই ধারাবাহিকভাবে রোজা ফরজ হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকভাবে রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। 

লেখক : ইতিহাস গবেষক ও মুহাদ্দিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬

/এসটিএস/এমএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ঈদুল ফিতরে করণীয়
চাঁদ দেখা যায়নি, ঈদ বৃহস্পতিবার
রমজানে নবীজির রাতের আমল
সর্বশেষ খবর
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
সর্বাধিক পঠিত
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন