পুরনো কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ‘ক্ষোভ’ ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপিতে। ক্ষুব্ধ সিনিয়র নেতাদের কারও কারও দাবি, নতুন গৃহীত উদ্যোগ নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিতে সাধারণ আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের বিদেশ বিষয়ক কমিটি ভেঙে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই প্রধান হবেন— এ নিয়েও ন্যূনতম ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
শনিবার (১৫ জুন) সকালে দলের ৩৯ জনকে নেতাকে বিভিন্ন পদে রদবদল করা হয়। এরপর দলের বিদেশ বিষয়ক দুটি কমিটি গঠনের কথা জানায় বিএনপি। বিকালে আরও ৬ জনকে যুক্ত করা হয় দলের নির্বাহী কমিটিতে। এদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে আবার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক হিসেবে ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলকে মনোনীত করা হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীলরা বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, এরপর স্থায়ী কমিটির নতুন নিযুক্ত সদস্যদের নাম ঘোষণা আসতে পারে। এক্ষেত্রে সংবাদ সম্মেলন হতে পারে বা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানানো হতে পারে। একইসঙ্গে দলের ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান’ পদেও নতুন কাউকে দেখা যেতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছে দায়িত্বশীলরা।
শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিল এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ৩৯ নেতাকে বিভিন্ন পদে রদবদল করা হয়। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর গঠিত বর্তমান কমিটিতে বিশেষ সম্পাদক ছিলেন ড. আসাদুজ্জামান রিপন। তাকে ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে আনা হয়েছে জহির উদ্দিন স্বপন, ব্যারিস্টার এ এইচ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুন অর রশিদ ও আসলাম চৌধুরী এফসিএ, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, বেবী নাজনীন, খালেদ হোসেন চৌধুরী পাহিনকে। যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী।
সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল (ঢাকা বিভাগ), সৈয়দ শাহীন শওকত খালেক (রাজশাহী বিভাগ), জি কে গউছ (সিলেট বিভাগ), শরিফুল আলম (ময়মনসিংহ বিভাগ) মনোনীত হয়েছেন।
প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে। এছাড়া ড. মোর্শেদ হাসান খানকে গণশিক্ষা সম্পাদক, শামীমুর রহমান শামীমকে গবেষণা বিষয়ক, আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ), নজরুল ইসলাম আজাদকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ), অধ্যাপক আমিনুল ইসলামকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ), মীর হেলাল উদ্দিনকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ), আবু ওয়াহাব আকন্দকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ বিভাগ), মিফতাহ সিদ্দিকীকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ) পদে মনোনীত করা হয়েছে।
সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে নাহিদ খান, সহ-স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে ডা. মো. নজরুল ইসলাম, সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক পদে এস এম সাইফ আলীকে মনোনীত করেছে বিএনপি।
পদ থেকে সরিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে কেবল সদস্য হিসেবে রয়েছেন— জালাল উদ্দিন মজুমদার (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, চট্টগাম বিভাগ), সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, রংপুর বিভাগ), সায়েদুল হক সাঈদ (সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, কুমিল্লা বিভাগ), চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক (সহ-কৃষি বিষয়ক সম্পাদক), এস এম গালিব (সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক)। বিগত আন্দোলনে তাদের দেখা যায়নি, এমন আলোচনার মধ্যেই পদ হারালেন এই পাঁচ নেতা।
এছাড়া কয়সর এম আহমেদ (সাধারণ সম্পাদক, যুক্তরাজ্য বিএনপি), মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু (সুইডেন) সদস্য, গাজী মনির (ডেনমার্ক), রাশেদ ইকবাল খানকে (সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ছাত্রদল) কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়েছে।
শনিবার বিকালে আরও ৬ জনকে নির্বাহী কমিটিতে যুক্ত করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএনপি। মেজর জেনারেল (অব.) মো. শরীফ উদ্দীনকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য করা হয়। এছাড়া নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে জাহান পান্না (রাজশাহী), নাজমুন নাহার বেবী (চাঁদপুর), মো. মাইনুল ইসলাম (টাঙ্গাইল), আজম খান (দক্ষিণ আফ্রিকা)ও বেলায়েত হোসেন মৃধাকে (নরসিংদী)।
রদবদল নিয়ে শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। তারা নিজেদের নাম উদ্ধৃত না করার শর্তে উল্লেখ করেছেন, রদবদলে এমন কিছু নেতাকে সামনে আনা হয়েছে তাতে করে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়।
দলের একজন নেতা বলেন, ‘চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’ ও ‘স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি’ গঠন করেছেন সরাসরি তারেক রহমান। এই কমিটিতে বিগত কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে চার নম্বরে রাখা হয়েছে। আগের কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে কমিটিতে রাখা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।
স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কেউ-কেউ মনে করেন, মূলত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে চাপে রাখতেই নির্বাহী কমিটিতে রদবদল আনা হয়েছে। তারেক রহমান দূরবর্তী কোনও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন এনেছেন, বলে দাবি করেন তারা।
সিনিয়র একাধিক নেতা মনে করছেন, দলের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মির্জা ফখরুল দায়িত্বে আসার পর থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রমে তেমন ভূমিকা রাখেননি-- যে কারণে তিনি চাপে থাকবেন, তা মনে করার সুযোগ নেই।
‘তবে মনঃস্তাত্তিকভাবে মির্জা ফখরুলকে চাপে ও দুর্বল করার একটি প্রয়াস দলের ভেতরেই ক্রিয়াশীল রয়েছে, বলে মনে করেন একজন নেতা।
দলের মিডিয়া সেলের সূত্রগুলো বলছে, ‘নির্বাহী কমিটিতে রদবদল এনে তারেক রহমান চমক দেখিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি চমক দিচ্ছেন।’
এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা স্বনামে মন্তব্য প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। পরে জানতে চাইলে শনিবার রাতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেহেতু কমিটিতে পরিবর্তনের কাজ চলছে, সে কারণে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে এটা বলতে পারি, আন্দোলন সংগ্রামে যারা সামনে ছিলেন, যারা কাজ করেছে ঝুঁকি নিয়ে, নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, তাদের প্রমোশনের মধ্য দিয়ে ভালো কিছুর আশা করছি।’
আরও পড়ুন: