X
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

খোলা ভোজ্যতেলে মিলছে না ভিটামিন ‘এ’, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

শফিকুল ইসলাম
০১ মে ২০২৪, ২০:০৯আপডেট : ০১ মে ২০২৪, ২০:০৯

আইন অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত না করে ভোজ্যতেল বাজারে ছাড়া দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাজারে বিক্রি হওয়া খোলা ভোজ্যতেলের বেশিরভাগ নমুনায় মেলেনি ভিটামিন এ। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়ছে। বাজারে বিক্রি হওয়া ড্রামের অস্বাস্থ্যকর খোলা ভোজ্যতেল ব্যবহার এই পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়ংশে কমিয়ে আনা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি লক্ষ্য ৩.৪) অর্জন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথচ প্রতি লিটার তেলে মাত্র ২৪ থেকে ৩০ পয়সা বাড়তি খরচ করলে এই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশ ড্রামে বাজারজাত করা হয়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশই ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ নয়। ৩৪ শতাংশ নমুনায় সঠিকমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ নেই। আর মাত্র ৭ শতাংশ ড্রামের খোলা তেলে আইনে নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, মানবদেহে ভিটামিন ‘এ’র স্বল্পতা একটি নীরব মহামারি আকারে ধরা পড়ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে হৃদরোগ, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি।

ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে রাতকানা রোগ, চোখের শুষ্কতা ও কর্নিয়ার ক্ষতি, ইনফেকশন, দেহের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা হয়। পাশাপাশি ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতা মানবদেহে পুষ্টির ঘাটতি ঘটায় এবং এর ফলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে।

সয়াবিন তেল (ছবি: ফোকাস বাংলা)

জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১৯-২০ অনুযায়ী বাংলাদেশে দুই জনে একজন শিশু ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতায় ভুগছে। ৬ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের (গর্ভবতী বা দুগ্ধদানকারী নয়) মধ্যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিতে ভুগছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (লক্ষ্য ৩.৪) অর্জন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।

ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতা দূরীকরণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন একটি কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী পদক্ষেপ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন এবং ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করে। ‘ভোজ্যতেল ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩’ এবং ‘ভোজ্যতেল ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণ বিধিমালা, ২০১৫’ অনুযায়ী, সব ভোজ্যতেলে (সয়াবিনতেল, পামতেল, পামঅলীন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অন্য যেকোনও উদ্ভিজ্য ভোজ্যতেল) নির্ধারিত মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ বাধ্যতামূলক। এর পরেও দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো আইনের তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ টন খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ করছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে প্রায় ৭০ শতাংশই পামতেল, ২০ শতাংশ সয়াবিন তেল, ৬ শতাংশ রেপসিড ও সরিষারতেল। এর মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোজ্যতেল ড্রামের মাধ্যমে এবং ৩৫ শতাংশ ভোজ্যতেল বোতল বা প্যাকেটের মাধ্যমে বাজারজাত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৯১৩টি (বোতল ৫২০টি, ড্রাম ৩৯৩) নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা করে। সেখানে ৮৭ শতাংশ বোতলজাতকৃত ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া গেলেও ড্রামে বাজারজাতকৃত তেলে এটি পাওয়া গেছে মাত্র ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ ড্রামে বাজারজাতকৃত তেলেই ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়নি।

এদিকে মালয়েশিয়ান পাম অয়েল কাউন্সিলের (এমপিওসি) তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে মোট ভোজ্যতেলের আমদানির পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পাম অয়েল ছিল ১৫ লাখ ৬০ হাজার টন ও সয়াবিনতেল ৮ লাখ ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ পামতেল আমদানি হচ্ছে সয়াবিনের দ্বিগুণ। আবার গত ৭ বছরে পামতেল আমদানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

আইন অনুযায়ী, আমদানিকারক কোম্পানি ভোজ্যতেল আনার পর তাতে ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত করবে। আর পুরো বিষয়টি তদারকি করবে শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাধ্যবাধকতা থাকার পরও তেলে ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত হচ্ছে না।

খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি (ফাইল ছবি)

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, ভোজ্যতেল পরিবহনে ব্যবহৃত ড্রাম দেশে তৈরি হয় না। কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্ট বা মবিল বা অন্যান্য পণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত ড্রাম ভোজ্যতেল পরিবহনে ব্যবহার করা হয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। রিফাইনারি কোম্পানিগুলো এসব পুরনো ড্রামে কোনও প্রকার লেবেল এবং উৎস শনাক্তকরণ তথ্য যুক্ত না করায় তেল সরবরাহের উৎস, বিশেষ করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না; যা আইন বাস্তবায়নে বড় বাধা সৃষ্টি করে।

এদিকে অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর ড্রামে সরবরাহকৃত ভোজ্যতেল স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। ননফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক ড্রাম বারবার ব্যবহারের ফলে ভোজ্যতেল বিষাক্ত হতে পারে। তাছাড়া ড্রামের খোলা ভোজ্যতেলে ভেজাল মেশানোর সুযোগ থাকে। অন্যদিকে, ড্রামে বাজারজাতকৃত ভোজ্যতেলে পরিমিত মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনস্বাস্থের উন্নয়ন এবং সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নিরাপদ এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাবার নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এটি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট- এসডিজি’র সবার জন্য সুস্বাস্থ্য সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত।

ভারতে ২০১৮ সালে ‘ফুড ফর্টিফিকেশন রিসোর্স সেন্টার’ স্থাপনের মাধ্যমে (ভোজ্যতেলসহ) ৫টি প্রধান খাদ্যদ্রব্যে ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতাজনিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা মোকবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।  

শিল্প মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা গেছে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ মাত্রা হবে ১৫ থেকে ৩০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। অর্থাৎ প্রতি গ্রাম ভোজ্যতেলে অন্যূন শূন্য দশমিক শূন্য ১৫ মিলিগ্রাম থেকে অনধিক শূন্য দশমিক শূন্য ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ থাকতে হবে। সমৃদ্ধকরণ প্রতীক ছাড়া এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনও উপকরণ দিয়ে তৈরি প্যাকেট বা পাত্রে ভোজ্যতেল বাজারজাত করা যাবে না। এটি নিরাপদভাবে প্যাকেজিং, মোড়কাবদ্ধ ও লেবেলিং করে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে হবে। এজন্য ভোজ্যতেল সরবরাহের ক্ষেত্রে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’, ‘বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনিস্টিটিউশন আইন, ২০১৮’, ‘ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮’ সহ প্যাকেজিং, মোড়কাবদ্ধ ও লেবেলিং সংক্রান্ত বিধি ও প্রবিধানমালা অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।  কোনও ধরনের অস্বাস্থ্যকর, নোংরা ও ননফুডগ্রেডেড পাত্রে ভোজ্যতেল বাজারজাত, সরবরাহ ও বিক্রয় করা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জানিযেছেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল অত্যান্ত নিরাপদ। সঠিক মাত্রায় ভিটামিন এ ভোজ্যতেলে সংযুক্ত করা গেলে দেশে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব। এর মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুঝুঁকিও কমবে।

এ প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নানা ধরনের জটিলতা কাটিয়ে এ সংক্রান্ত দেশের আইন ও বিধিমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে।

আরও পড়ুন- খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার

/এফএস/
সম্পর্কিত
টিসিবির জন্য সয়াবিন তেল ও মসুর ডাল কিনছে সরকার
৪৬৮ কোটি টাকার তেল ও ডাল কিনবে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু, কেজি ৪০ টাকা
রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু, কেজি ৪০ টাকা
রাজস্থানের শীর্ষ দুইয়ে থাকা কঠিন করে দিলো পাঞ্জাব
রাজস্থানের শীর্ষ দুইয়ে থাকা কঠিন করে দিলো পাঞ্জাব
লন্ডনে অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে অভিযান, বাঙালিপাড়ায় উৎকণ্ঠা
লন্ডনে অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে অভিযান, বাঙালিপাড়ায় উৎকণ্ঠা
মাধ্যমিকে ছেলেরা কেন পিছিয়ে?
মাধ্যমিকে ছেলেরা কেন পিছিয়ে?
সর্বাধিক পঠিত
নিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আত্মসাৎনিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
ঢাকায় চলবে না ব্যাটারিচালিত রিকশা
ঢাকায় চলবে না ব্যাটারিচালিত রিকশা
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খান এই ৫ খাবার
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খান এই ৫ খাবার