নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পাওয়াসহ জামানত ছাড়া ঋণসুবিধা পেতে চালু হওয়া ক্রেডিট কার্ড এখন যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ইলেক্ট্রনিক মানি’খ্যাত এই কার্ড শহুরে জীবনে কারও কারও নিত্যসঙ্গী হলেও এর উচ্চ হারের সুদ ও নামে-বেনামে হিডেন চার্জ অনেককেই সর্বস্বান্ত করেছে। কোনও কোনও ব্যাংক ব্যয়বহুল এই কার্ডে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩০ শতাংশেরও বেশি সুদ নেওয়ার পর আরও ২৭ রকম ফি নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ক্রেডিট কার্ডের সেবা নিতে গিয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন জানিয়েছেন মুস্তাহিদ সেন্টু নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দু’টি বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড আমাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। এখন কার্ড দু’টি ক্লোজড করতে চেয়েও পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। দুই বছরও হয়নি। গত মাস পর্যন্ত শুধু সুদ বাবদই বেসরকারি একটি ব্যাংককে ৭১ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ৬০ হাজার টাকা শোধ হচ্ছে না।’
ক্রেডিট কার্ডের এই গ্রাহক আরও বলেন, ‘আমাকে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে শুধু সুদ গুনতে হচ্ছে ৩ হাজার ১০০ টাকা করে। এর সঙ্গে ২৫ থেকে ২৭ রকমের হিডেন চার্জ নেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে কোনও কারণে ১০ তারিখের মধ্যে টাকা জমা না দিতে পারলে সেই মাসে আরও ৩০০টাকা জরিমানা দিতে হয়। এছাড়া আরেকটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার পরও ঋণ নেওয়া ৬৫ হাজার টাকা শোধ হচ্ছে না। এই ব্যাংকটিকে প্রতি মাসে ৩ হাজার ৪০০টাকা দিতে হচ্ছে।’
কেবল মুস্তাহিদ সেন্টুই নন, তার মতো অনেকেই ক্রেডিট কার্ডের ঋণ চক্রে জড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিক ব্যাংক খাতে ঋণে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটের নিচে নেমে এলেও ক্রেডিট কার্ডে ঘোষণা দিয়ে ৩৬শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে ব্যাংকগুলো।
বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের কার্ড বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, কোনও কোনও ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে ক্রেডিট কার্ড সেবা বিপরীতে ২৭ থেকে ২৮ ধরণের ফি (মাশুল) নিচ্ছে। ব্যাংকভেদে ফি’র নাম ভিন্ন হলেও চার্জ কাটা হয় প্রায় একইহারে। এর মধ্যে লিমিট ক্রস করলে গ্রাহককে দিতে হয় ‘ওভার লিমিট ফি’, এছাড়া গুনতে হয় আন্তর্জাতিক স্কাই লাউঞ্জ ভিজিট ফি, অভ্যন্তরীণ স্কাই লাউঞ্জ ভিজিট ফি, গ্লোবাল লাউঞ্জ অ্যাকসেস ফি, কার্ড রিপ্লেসমেন্ট ফি, পিন রিপ্লেসমেন্ট ফি, লেট পেমেন্ট ফি, ক্যাশ উইথড্রয়াল ফি, অ্যাডভান্স ফি (নিজস্ব এটিএম এবং অন্য এটিএম বুথে), রিটার্ন চেক ফি, ডুপ্লিকেট ই-স্টেটমেন্ট ফি, সেলস ভাউচার রি-ট্রিয়াল ফি, সার্টিফিকেট ফি, রিস্ক অ্যাসুরেন্স ফি, কার্ড চেক বই ফি, কার্ড চেক প্রসেসিং ফি, চেক ডিজ অনার ফি, ক্রেডিট ভেরিফিকেশন ফি, সিআইবি ফি, ট্রানজেকশন অ্যালার্ট ফি, ইএমআই আর্লি সেটেলমেন্ট ফি, প্রি-পেইড কার্ড ইনিশিয়াল লোড ফি, প্রি-পেইড কার্ড রিলোড ফি, প্রি-ক্লোজার ফি, রিফান্ড ফি, এটিএম রিসিপ্ট ফি। প্রতি ৬ মাস পরপর দিতে হয় ‘অজানা ফি’। এছাড়া গ্রাহককে বাধ্যতামূলক দিতে হয় বার্ষিক ফি। এই ফি’র পরিমাণ ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০টাকা পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমনিতেই ক্রেডিট কার্ডে অতিরিক্ত সুদ নেয় ব্যাংকগুলো। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের হিডেন চার্জও নেওয়া হয়। ফলে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডে গ্রাহকের ওপর হিডেন চার্জ যেন আরোপ করতে না পারে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত গ্রাহকের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুদহার নিচ্ছে বেসরকারি ব্র্যাক ৩৬ শতাংশ হারে। সিটি ব্যাংক সুদ আদায় করছে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। ওয়ান ব্যাংকের সুদ হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক সুদহার আদায় করছে ৩৬ শতাংশ হারে। এছাড়া ৩০ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ইউসিবিএল, ট্রাস্ট ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংকসহ ১৩টি বেসরকারি ব্যাংক।
জানা গেছে, অনেকে নগদ টাকার পরিবর্তে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পণ্য কেনেন, কিন্তু ব্যাংকের কাছে এই ক্রেডিট কার্ড একটি পণ্য। অন্যান্য ঋণে সুদের হার বার্ষিক হারে আরোপিত হলেও ক্রেডিট কার্ডে সুদ দিতে হয় মাসিক ভিত্তিতে। অবশ্য সিংহভাগ ক্রেডিট কার্ডের ভোক্তা সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী।
প্রসঙ্গত, ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৩১টি ব্যাংক গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড সেবা দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে গত জুলাই মাসে ৩১ লাখ ৩৪ হাজার ২০২টি লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে পস মেশিনে ২৩ লাখ ৪৪ হাজারটি। এটিএম বুথে লেনদেন হয়েছে ২লাখ ৫৮ হাজার ৫৪০টি এবং ই-বাণিজ্যে হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৫টি লেনদেন। গত জুলাই মাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে দেশের ভেতরে-বাইরে তিন হাজার ৯৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী হেলাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উচ্চ সুদ ও নানা ধরনের হিডেন চার্জ থাকার পরও আমি এই সেবা নিচ্ছেন মূলত কোনও রকম জামানত ছাড়াই ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যায়। এছাড়া কোনও কোনও সময় নানা ধরনের ছাড় পাওয়ার সুযোগও থাকে। আরেকটা সুবিধা হলো—ক্রেডিট কার্ড নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।’
ক্রেডিট কার্ডে সুদ বেশি নেওয়া ও হিডেন চার্জ প্রসঙ্গে বেসরকারি ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড মূলত ব্যাংকের ঝুঁকিযুক্ত সেবা। এই সেবার ক্ষেত্রে কোনও জামানত ছাড়া ব্যাংক গ্রাহককে ঋণ দেয়। এ কারণে এই সেবায় সুদের হার বেশি।’ তিনি বলেন, ‘বিনা জামানতে ঋণ দেওয়ায় ব্যাংকের কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে অনেক ব্যাংক গ্রাহকককে না জানিয়ে নানা ধরনের হিডেন চার্জ নেয়। তবে এটা অনৈতিক।’ কোনোভাবেই ক্রেডিট কার্ড সেবায় হিডেন চার্জ থাকা ঠিক না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে ক্রেটিড কার্ডের মাত্রাতিরিক্ত সুদহারের লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই মাস আগে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিরোধিতায় সেখান থেকে সরে আসে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এবিবি) নেতারা ক্রেডিট কার্ড নীতিমালা এখনই বাস্তবায়ন না করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাদের ওই প্রস্তাবগুলো বাস্তবসম্মতই ছিল।’ এ কারণে ২০১৮ সালের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোনও নীতিমালার আওতায় আনা যাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
/এমএনএইচ/
