দশটি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে। তিনি আগামী দুই বছর কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না। বুধবার (৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দশটি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পর দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবার দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণের চিঠি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, দেওয়ান মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর এ ব্যাপারে তদন্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তদন্তে দেখা গেছে, অনেক বোর্ড সভায় পরিচালকদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দশটি গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ পাওয়ার পরই তাকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে দেওয়ান মুজিবর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে অপসারণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো বলতে পারবে।’
এর আগে গত ২০ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এমডিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো নোটিসে বলা হয়, এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমান ব্যাংকের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ওই সময় অভিযোগের বিষয়গুলো জানিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী কারণ দর্শানো নোটিশও দেওয়া হয় তাকে। এ নোটিশের বিরুদ্ধে আদালতে যান তিনি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে রায় দেন আদালত। এরপর গত ৩ মে নোটিশের জবাব দেন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি।
জানা যায়, প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের অভিযোগে একই প্রক্রিয়ায় বেসিক ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবর রহমানকে যে দশ কারণে অপসারণ করা হয়েছে, তা জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
প্রথম কারণটি হলো- ব্যাংকের পরিচালক কামরুন নাহার সাথী, এবি এম আব্দুল মান্নান, ফিরোজ হায়দার খান ও মো. আমির হোসেন দেশে না থাকলেও তাদের স্বাক্ষর জাল করে পর্ষদ ও ইসি সভায় উপস্থিত দেখানো হয় তাদের। এ অপরাধ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পরিচালকদের জাল স্বাক্ষরে সভার কার্যবিবরণী প্রস্তুত করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো একাধারে জালিয়াতি ও প্রতারণা, যা ফৌজদারি আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয়।
দুই- ১০ জন পরিচালকের পক্ষে বিকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানা হয়নি। মূল পরিচালকের বিদেশ গমন ও দেশে প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত দালিলিক প্রমাণাদি ব্যাংকের নথিতে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা পালন করা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার নির্দেশ দিলেও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়নি।
তিন- ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও কামরুন নাহার সাথীর খেলাপি সংক্রান্ত তথ্য গোপন করে তাকে ব্যাংকের পর্ষদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ১৫ (৬) ধারার লঙ্ঘন। খেলাপির তথ্য গোপন, জাল স্বাক্ষর, মূল পরিচালকের বিদেশ গমন ও দেশে প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত দালিলিক প্রমাণাদি ব্যাংকের নথিতে সংরক্ষণ না করা একই সূত্রে গাথা, যা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার যোগসাজসে হয়েছে। এর দায় ব্যবস্থাপনার পরিচালকের ওপর বর্তায়।
চার- পর্ষদ সদস্য না হয়েও বহিরাগত মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদুল আহসান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আহসান গ্রুপের কর্মকর্তাকে ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থিত করানো।
পাচ- শহীদুল আহসানের ব্যবসায়িক গ্রুপের নাম আহসান গ্রুপ (এজি)। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এজি এগ্রোকে ২০১৩ সালে মাত্র ৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা মূল্যের সহায়ক জামানতের বিপরীতে ১৪০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও ১৮৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিগ্রস্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, এই ঋণ এক উদ্দেশ্যে নেওয়া হলেও ব্যবহার হয়েছে অন্য খাতে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন। এই অনিয়ম প্রতিহত করার কোনও উদ্যোগ না নেওয়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচায়ক।
ছয়- ব্যাংকটি থেকে নোয়াখালীর গ্রাহক বেগমগঞ্জ ফিড মিলস লিমিটেড এর আবেদন ও সংশ্লিষ্ট শাখার প্রস্তাব বা সুপারিশ ছাড়াই ১৯ কোটি টাকার সমন্বিত ঋণ সীমা অনুমোদন করা হয়। এই ঋণও এক উদ্দেশ্যে নেওয়া হলেও তা ব্যবহার করা হয়েছে অন্য খাতে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন।
সাত- আহসান গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান (বেগমগঞ্জ ফিড মিলস ও এজি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রির) মঞ্জুরীকৃত ঋণ সীমা ও ঋণ স্থিতি উভয়ই একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ ঋণ সীমা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার লঙ্ঘন।
আট- ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক মাল্টিপ্ল্যান ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড এর ঋণের বিষয়ে শাখার প্রস্তাব ক্রেডিট কমিটির কাছে উপস্থাপন না করেই একক ক্ষমতাবলে মেয়াদ বাড়িয়েছেন এমডি। যা ঋণ শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত নির্দেশনার লঙ্ঘন।
নয়- ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক ফাস্ট করপোরেশন (প্রাঃ) এর ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়লেও ঋণ শ্রেণিকরণ না করে ও ঋণ আদায়ে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে এবং ক্রেডিট কমিটিতে উপস্থাপন না করে একক ক্ষমতাবলে ঋণের মেয়াদ বাড়িয়েছেন এমডি, যা ঋণ শ্রেণিকরণ সংক্রান্ত নির্দেশনার লঙ্ঘন।
দশ- ধানমন্ডি শাখার গ্রাহক মের্সাস গুল্ডবাগ এর অনুকূলে গ্রাহকের শিপিং ডকুমেন্ট ডেলিভারি করার উদ্দেশ্যে একক ক্ষমতা বলে এখতিয়ার বর্হিভূতভাবে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করেছেন এমডি। হালনাগাদ সিআইবি রিপোর্ট ছাড়াই এবং এক্সিকিউটিভ কমিটির সভায় উপস্থাপন না করেই অপর একটি শিপিং ডকুমেন্টস ডেলিভারি করার উদ্দেশ্যে প্রায় এক কোটি ৬৯ লাখ টাকার বিশেষ এলটিআর এবং ৩১ লাখ টাকার বিশেষ মেয়াদী ঋণ এমডির একক ক্ষমতাবলে মঞ্জুর করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে লাইসেন্স পায় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। শুরুর বছরই এনআরবি কমার্শিয়ালে এমডি হিসেবে যোগ দেন দেওয়ান মুজিবুর রহমান। গত বছর তার মেয়াদ নবায়ন করা হয়। এর আগে তিনি বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকেও কাজ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ২০১৬ সালেই এ ব্যাংকটির ৭০১ কোটি টাকা ঋণ সংক্রান্ত গুরুতর অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখন ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।