X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ফারমার্স ব্যাংক বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি’

গোলাম মওলা
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১০:২৮আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৫৫

 

‘ফারমার্স ব্যাংক বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি’ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডকে বাঁচাতে হলে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংক বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকের বোর্ডের পাশাপাশি সমন্বিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে জরুরি হস্তক্ষেপ করতে হবে।’ আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে দ্রুততম সময়ে একজন আস্থাবান প্রধান নির্বাহীও নিয়োগ দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ফারমার্স ব্যাংকে এই মুহূর্তে প্রশাসক নিয়োগ দিতে চায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। বরং একজন দক্ষ ও আস্থাভাজন প্রধান নির্বাহী বসাতে চায়। এজন্য মোহাম্মদ নূরুল আমিনকে রবিবার (২৪ ডিসেম্বর) ডেকেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তাকে ফারমার্স ব্যাংকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব দিলেও তিনি তাতে সম্মত হননি। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেবল ফারমার্স ব্যাংকই নয়, আমি আর কোনও ব্যাংকেই এমডি হিসেবে চাকরি করবো না। যদিও আমার আরও এক বছর চাকরি করার বয়স আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের পর্ষদ আমার সঙ্গে বসার কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না। কারণ, জীবনের বাকি সময় আমি পরিবারকে দিতে চাই।’

ফারমার্স ব্যাংককে রক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে নূরুল আমিন বলেন, ‘সবকিছুর আগে দায়িত্বশীল কোনও জায়গা থেকে ঘোষণা আসতে হবে যে কোনোভাবেই ব্যাংকটি বন্ধ হবে না। আমানতকারীদের টাকা সুরক্ষিত আছে। একইসঙ্গে গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে একটি পরিকল্পনার কথাও জানাতে হবে। বাস্তবেও তেমন পদক্ষেপ থাকতে হবে। ব্যাংকের পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় টাকা সরবরাহ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাহকের আস্থা না ফিরলে এই ব্যাংকটিকে বাঁচানো যাবে না। এক্ষেত্রে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংকে শক্ত পর্ষদ গঠন করতে হবে। শক্তিশালী ম্যানেজমেন্ট গঠন করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তভাবে তদারকি করতে হবে।’

এর আগে ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদ নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে এহসান খসরুকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিতে চাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই মুহূর্তে এহসান খসরুকে দিয়ে আমানতকারীদের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা দক্ষ ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ নূরুল আমিনকে সেখানে (ফারমার্স ব্যাংকে) পাঠানোর কথা ভাবছি। তিনি আরও বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাংকটির নতুন পর্ষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যর্থ হলে ব্যাংকটিতে প্রশাসক বসানো হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমানতকারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই উদ্যোগ নিচ্ছে। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সুযোগ আছে, প্রয়োজনে সবই করা হবে।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের সমস্যা দ্রুত দূর করা না গেলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকে পড়বে। এ জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এখনই ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া দরকার। এভাবে ছয় মাস চলার পর পরিস্থিতির উন্নতি হলে ফের পরিচালকদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।’

গত এক মাসে এক টাকার আমানতও পায়নি ব্যাংকটি। উল্টো এর মধ্যেই এক হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি আমানত তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা। বাকিরাও তাদের জমানো টাকা তুলে নেওয়ার জন্য ফারমার্স ব্যাংকের শাখাগুলোয় প্রতিদিন ভিড় করছেন। অর্থ তুলতে গিয়ে আমানতকারীদের বেশিরভাগই খালি হাতে ফিরছেন। অনেকে আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ দিচ্ছেন।

ব্যাংকটির মতিঝিল শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায় গ্রাহকদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রাহকরা আমাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করছেন।’

জানা গেছে, ব্যাংকটিতে ছোট-বড় মিলে সোয়া লাখ আমানতকারীর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত আটকা পড়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে, শুধু তারা চাহিদার তুলনায় সামান্য কিছু টাকা নিতে পারলেও বাকিরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীকে দেওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। কাউকে কয়েকদিন পর আসতে বলা হচ্ছে। ব্যাংকটির মতিঝিল, গুলশান ও ধানমন্ডি শাখায় এমন চিত্র দেখা গেছে। যদিও আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ৮৯৯ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক; তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ব্যাংকটির দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা পাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। চলতি মাসের বেতন তারা নাও পেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রবিবার (২৪ ডিসেম্বর) ফারমার্স ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকরা তাদের টাকা ওঠানোর জন্য ভিড় করছেন। ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও অনেকে টাকার জন্য ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করছেন। গ্রাহকদের একজন আরিফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি এই ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় তিনটি ডিপিএস করেছেন। ডিপিএসের টাকা ওঠানোর জন্য তিনি গত কয়েকদিন ধরে শাখার ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লিখিতভাবে টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছেন না বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান তিনি।  আরিফুজ্জামান বলেন, ‘টাকা ওঠানোর জন্য অন্তত ১০ দিন এসেছি। কিন্তু টাকা ফেরত পাচ্ছি না।’

তার মতো আরেক গ্রাহক অ্যাডভোকেট রিপন বিশ্বাস মতিঝিল শাখায় ১০ লাখ টাকার ডাবল স্কিমের এফডিআর রেখেছেন। এই টাকা ওঠানোর জন্য তিনিও গত কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করছেন বলে জানান।

আরেক গ্রাহক মাসুম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনের কাছে হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার আড়াই লাখ টাকার এফডিআর ও ৫০ হাজার টাকার ডিপিএস ওঠানোর জন্য কয়েকদিন ধরে ঘুরছি। কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। ব্যাংক শুধু সময় দিচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে ফারমার্স ব্যাংকের উপদেষ্টা প্রদীপ কুমার দত্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন করে কোনও আমানত আমরা পাচ্ছি না বললেই চলে। যাদের আমানত ছিল তারা এখনও তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। শাখাগুলোয় ভিড় করছেন তারা। আমরা আমানতকারীদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছি।’

রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালের ৩ জুন চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ফারমার্স ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির শাখার সংখ্যা ৫৬ এবং এটিএম বুথের সংখ্যা ১১টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি মোট ঋণ বিতরণ করেছে চার হাজার ৪১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত বছর প্রায় এক হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংকের মোট আমানত সংগ্রহের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৫ সালে ছিল তিন হাজার ৪৮২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

সম্প্রতি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতি। গত ১৯ ডিসেম্বর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে সময় নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরও পড়ুন:
ওরিয়েন্টালের পথেই ফারমার্স!

 

 

 

/এএম/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!