X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লুটপাটের জন্যই কি ব্যাংকে যাচ্ছে জনগণের করের টাকা?

গোলাম মওলা
১৮ মার্চ ২০১৮, ০১:৫৩আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৮, ১৩:৫৬

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক করের মাধ্যমে সরকারকে টাকা দিচ্ছে জনগণ। সরকার এই টাকা থেকে একটি অংশ দিচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রতি বছরই বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঋণের নামে এই টাকা আবার যাচ্ছে লোপাটকারী-খেলাপিদের হাতে। সরকারকে দেওয়া জনগণের করের টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে আবারও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য না করে প্রতি বছর বাজেট থেকে টাকা দেওয়ার প্রবণতা জনগণের টাকা লুটপাটকেই উৎসাহিত করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে একটি খাত আছে। মূলত এই খাত থেকে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরেও একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ ছিল। প্রাথমিকভাবে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও এই খাতে দুই হাজার কোটি টাকাই রাখা হবে বলে জানা গেছে। 
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জনগণের টাকা ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এভাবে নষ্ট করার কোনও যৌক্তিকতা নেই। কারণ, এই টাকাও হয়তো চলে যাবে অসৎ ব্যক্তিদের হাতে। আর  এটা কোনও স্থায়ী সমাধানও নয়। ব্যাংকগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত না করে, লোকসান না কমিয়ে, খেলাপি আদায়ে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য না করে, প্রতি বছর বাজেট থেকে টাকা দেওয়ার অর্থ হলো— দিনের পর দিন অনিয়ম ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা। ’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)এ সংক্রান্ত একটি গবেষণায় দেখা গেছে,  ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত আট বছরের মধ্যে ৭ বছরই পুনঃ মূলধনের নামে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা, যা ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আয়ের ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে সিপিডি’র ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে যেভাবে টাকা দেওয়া হচ্ছে, এটা না করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা সামাজিক খাতে যদি টাকাগুলো খরচ করা যেত, তাহলে দেশও অনেক বেশি উপকৃত হতো।’

সরকারি সেবার বিপরীতে এই ব্যাংকগুলো ফি নেওয়া শুরু করলে মূলধন পুনর্গঠনে বাজেট থেকে কোনও টাকা নিতে হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে এখন অনেকটা ভালো করছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সরকারের কাছ থেকে এভাবে আর টাকা নিতে হবে না। সরকার এই ব্যাংকগুলো থেকে অনেক ধরনের সেবা নেয়। অথচ সেগুলোতে কোনও ফি বা চার্জ নেওয়া হয় না।’ তিনি উল্লেখ করেন, যদি সরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের সব সেবার বিপরীতে চার্জ নেওয়া শুরু করে,তাহলে বাজেট থেকে একসঙ্গে এতগুলো টাকা আর নিতে হবে না।

জানা গেছে, গত চার অর্থবছরে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়েছে বেসিক ব্যাংক। এই ব্যাংককে মোট দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৩ কোটি টাকা। জনতাকে ৮১৪ কোটি টাকা, অগ্রণীকে এক হাজার ৮১ কোটি টাকা, রূপালীকে ৩১০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে ৭২৯ কোটি দেওয়া হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘বাজেট থেকে প্রতি বছর টাকা দেওয়ার অর্থই হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে লুটপাটে উৎসাহিত করা। এভাবে প্রতি বছর তাদের টাকা দেওয়া হবে। আর তারাও ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করবে।’

বিশ্বের সব দেশেই কোনও সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্য কিছু একটা করা হয়, কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশ  মন্তব্য করে তিনি বলেন,‘এখানে চুরি করার কারণে ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়েছে, অথচ চুরির কোনও সমাধান না করে বাজেট থেকে জনগণের টাকা দেওয়া হয় ফের চুরি করার জন্য।’

অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক মূলধন ঘাটতি পূরণে চেয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা। এই ব্যাংক থেকে ‘হল-মার্ক’ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জনতা ব্যাংক চেয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই ব্যাংকটিও ‘অ্যাননটেক্স’ নামের একটি গ্রুপকে নিয়মনীতি না মেনে ৫ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে। বেসিক ব্যাংক চেয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই ব্যাংকটি থেকেও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য রূপালী ব্যাংক চেয়েছে ১২৫০ কোটি টাকা।  বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক চেয়েছে ৭ হাজার ৩৪৮ কোটি  এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক চেয়েছে ৮০০ কোটি টাকা।

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিদের কারণে ‘কু-ঋণ’ হিসাবে বরাদ্দের বোঝা সাধারণ মানুষকে টানতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩৯টি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ এখন বেশি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট বা বিডিবিএল-এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। অথচ প্রতিবছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে করের টাকা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেমের) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলোর দুর্নীতির বোঝা জনগণকে বহন করতে হচ্ছে। প্রতিবছর বাজেট থেকে টাকা নিচ্ছে। আর সেই টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই টাকা অর্থনীতিতে কোনও ভূমিকা রাখছে না।’ ব্যাংকের টাকা নয়-ছয় করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো প্রতি বছর বাজেট থেকে টাকা দেওয়াতে এই খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সানেমের এই নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আর এভাবে প্রতিবছরই যদি জনগণের কষ্টের টাকা ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়, তাহলে এই ব্যাংকখাত কোনও দিনও শক্তিশালী হবে না। অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে খ্যাত ব্যাংক খাতে সুশাসন আসবে না।’

সরকারি বাজেট ডকুমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে এক হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেওয়া হয় এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেওয়া হয় ৭০০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪২০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুই হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর দুই হাজার কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

 

/এনআই/এফএস/ এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন ক্যাটরিনা!
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
মারা গেলো গাজায় নিহত মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া শিশুটি
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!