নদীর গতিপথ পরিবর্তন, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব, মাঝখানে জেগে ওঠা নতুন চর—এই তিন কারণে পানির স্রোত বাধা পাচ্ছে। এর ফলে প্রয়োজনের তুলনায় স্রোত কমে গেছে। ইলিশ গবেষকরা বলছেন, ইলিশ সবসময় দলবেঁধে চলে। এই মাছ গতিপথ সবসময় সোজা রাখে। সোজা চলতে গিয়ে যদি বাধা পায়, তাহলে সাগরে ফেরত যায় ইলিশ। নদীতে চর জাগা ও স্রোত কমে যাওয়ায় সাগর থেকে ঝাঁক বেঁধে ইলিশ নদীর মোহনায় আসতে বাধা পাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আহসান কবির। তিনি বলেন, ‘এসব কারণেই এ বছর প্রবল বৃষ্টি হওয়ার পরও ভরা মৌসুমেও নদীতে জেলেরা ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না।’
এদিকে, জেলেরা জানিয়েছেন, উপকূলীয় নদ-নদীতে আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না। উত্তাল মেঘনা-তেঁতুলিয়া পাড়ি দিয়েও ইলিশের দেখা মিলছে না জেলেদের জালে। তবে সাগরে প্রচুর ইলিশ রয়েছে বলেও জেলেরা দাবি করেন।
বরিশাল, ভোলা, ষাটনল, পটুয়াখালী, পাথরঘাটা ও পিরোজপুরের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত পিরোজপুরের বলেশ্বর ও সন্ধ্যা, ভোলার তেঁতুলিয়া, পটুয়াখালীর পায়রা, আন্দারমানিক, আগুনমুখো এবং চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনাসহ ষাটনল এলাকায় প্রত্যাশিত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এ সব এলাকার জেলেরা জানিয়েছেন, শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমায় ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করলেও সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি তাদের।
ভাদ্র মাসের শেষের দিকের জোয়ারে কিছু মাছ আসতে পারে। তারা এখন সেই আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন পিরোজপুরের পাড়ের হাটের ইলিশের আড়তদার আফজাল মিয়া।
পিরোজপুরের পাড়ের হাট, ভোলার ইলিশা বাজার, বরগুনার পাথরঘাটা, পটুয়াখালীর মহিপুরের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকায় আড়তগুলো প্রায় মাছশূন্য। নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে অনেকটাই খালি হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলেরা। উত্তাল আগুনমুখা, বলেশ্বর, মেঘনা, তেঁতুলিয়া পাড়ি দিয়েও ইলিশ মিলছে না। নদীতে মাছ না পড়ায় দাদনের দেনার ভয়ে বহু জেলে ঘর-ভিটা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জেলে পরিবারগুলোয় এখন দুর্দিন চলছে। তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেরই নিজস্ব জাল বা মাছ ধরার ট্রলার না থাকায় স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছেন। কিন্তু নদীতে মাছ ধরা না পড়ায় এ সব অঞ্চলের জেলেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
ভোলার অন্যতম মৎস্যকেন্দ্র তজুমদ্দিন উপজেলার মাছ ব্যবসায়ী রফিক সাদী বলেন, ‘তজুমদ্দিন এলাকা থেকে প্রতিবছর ইলিশের মৌসুমে কোটি কোটি টাকার মাছ রফতানি হতো। গত বছরও এ সময়ে যেখানে প্রতিদিন এ মৎস্য কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ইলিশ বেচাকেনা হতো, সেখানে এখন প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকার মাছও বেচাকেনা হচ্ছে না।’
জেলেরা বলছেন, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসজুড়ে সময়টাই ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু সেই সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমায় ধরা পড়ে ইলিশ। জেলেদের প্রত্যাশা ছিল ওই সময় অন্তত কিছু ইলিশ ধরা পড়বে। কিন্তু এই মৌসুমও চলে গেছে। কিন্তু নদীতে মিলছে না প্রত্যাশীত ইলিশ। বাজারে ছোট-বড় যে সাইজের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার বেশিরভাগই সাগরের। সেই সাগরের ইলিশের দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
এদিকে পাথরঘাটার ইলিশের ব্যবসায়ী (আড়তদার) সেকেন্দার হাওলাদার টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পানির স্রোত কমে যাওয়া ও নদীতে চর পড়ায় জালে ইলিশ আসছে না ঠিকই কিন্তু এর বাইরেও কিছু কারণ আছে। যে কারণে নদীতে ইলিশ কমে গেছে। সমাজের প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় কিছু জেলে নদীতে সারা বছরই বিভিন্ন মাছের পোনা ধরে। এর মধ্যে ইলিশের পোনাও জালে ধরা পড়ে। এতে ইলিশের উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়।’ ভরা মৌসুমে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ কম ধরাপড়ার এটিও একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
বরিশালের একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, উপকূলীয় নদ-নদীতে আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ছে না। বরিশালের মোকামে গত কয়েক দিনে ইলিশ সরবরাহের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০০২-০৩ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ইলিশের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছর দেশে ইলিশ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টনে। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে দেশে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছর তা ৪ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরও দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৭ সালের শেষে দিকে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ ভাগ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের নদ-নদীতে ধরা মাছের ১২ শতাংশই ইলিশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) এর অবদান এক শতাংশ। এক মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় নদীর পরিবেশ, জাটকা সংরক্ষণ ও অভয়াশ্রম নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে বছরে ইলিশের বাণিজ্য হতো কমপক্ষে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নদীতে ইলিশ মাছ আছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন ধরা পড়ছে না, তাতে কী হয়েছে? সময় যখন আছে, তখন ধরা পড়তেই হবে। নদীতে মাছ আসবে।’