X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মুজিব জন্মেছিলেন এই বাংলায়

আবদুল মান্নান
১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০৩আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৪, ১৬:৩২

১৭ মার্চ, ২০২৪ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে জনকের প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন। বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর সমবয়সী যদি দু-একজন এখনও বেঁচে থাকেন, তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু এখনও মজিবর। অবশ্য মা-বাবার আদুরে নাম খোকা। হয়তো নিকটাত্মীয়রা শেখ মুজিবকে সেই নামেই ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেই’ লিখেছেন, তিনি এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই আমলে বাঙালি মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব ছিল হাতে গোনা।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আজীবন প্রতিবাদী। স্কুলে পড়ার সময়ই শেখ মুজিব মনে করতেন ‘ইংরেজদের এ দেশে থাকার অধিকার নাই।’ তখন সারা ভারতবর্ষে স্বদেশি আন্দোলন চলছে। মুজিব সেই আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চরিত্র যে একগুঁয়ে স্বভাবের ছিল তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। পেছন ফিরে তাকালে বলতে হয়, তাঁর একগুঁয়ে স্বভাবই তাঁকে পূর্ব বাংলার স্বার্থে আপসহীন নেতা হতে সহায়তা করেছিল। শেখ মুজিবের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ তাঁর গোপালগঞ্জে বাল্য ও কিশোর জীবনেও দেখা গিয়েছিল।

১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়ে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরীক্ষা প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়া সত্ত্বেও তিনি দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেছিলেন। পরীক্ষার পরপরই কিশোর মুজিব কলকাতায় যান। তখন পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। চল্লিশের দশকে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনের সঙ্গে তরুণ শেখ মুজিব নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। যোগ দেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ আর মুসলিম ছাত্রলীগে। এ সময় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন এবং সংগঠন সৃষ্টির শিক্ষা নেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমানে মওলানা আযাদ কলেজ) ছাত্র থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের বড় পরিবর্তনগুলো শুরু হয়। এ সময় তিনি অবিভক্ত বাংলার বড়মাপের রাজনীতিবিদের সঙ্গে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগকে (মুসলিম ছাত্রলীগ) তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন এবং এর সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিতেন।

১৯৪৩ সালে শেখ মুজিব বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সদস্য হন তখন বাংলার এক কঠিন সময়ে। এ সময় সারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষ ছিল ইংরেজ শাসকদের সৃষ্টি। বাংলায় দুর্ভিক্ষের সময় মুজিব তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খুলে ক্ষুধার্তদের জন্য খাদ্য জোগানের চেষ্টা করেছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল ভিক্ষা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর একটি ব্যতিক্রমী গুণ ছিল, তিনি সময় পেলেই উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রতিবাদী মানুষের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতেন।

অনেক জল্পনা-কল্পনা ও ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বাংলা, আসাম ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ লিখেছেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল।’ এই ষড়যন্ত্র ছিল মূলত বাঙালিদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র। কলকাতার পাট চুকিয়ে একসময় শেখ মুজিবও ঢাকায় চলে আসেন এবং মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। দেশভাগের পূর্ব থেকেই মুসলিম লীগে ভাঙন দেখা দেয়। এক ভাগের নেতৃত্ব দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আর অন্য ভাগের নেতৃত্বে থাকেন খাজা নাজিমুদ্দীন। শেখ মুজিব আজীবন সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত ছিলেন এবং তাঁরই অনুসারী থেকে যান। অবিভক্ত বাংলায় যেটি ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ ছিল, তার নাম বদলে ‘নিখিল পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ করা হয়। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। এরই মধ্যে অনেকের ছাত্রত্ব চলে গিয়েছিল।

শেখ মুজিব বললেন, ছাত্রদের নিয়ে ছাত্রলীগ গঠন করতে হবে, তবে অছাত্রদের নিয়ে নয়। শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য জেলার ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্থির করা হয় একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার নাম হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। গঠিত হলো পাকিস্তানের প্রথম ছাত্রসংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’, পরবর্তী সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। প্রথম আহ্বায়ক করা হয় নইমউদ্দিন আহমদকে। কিন্তু বাস্তবে এই ছাত্রসংগঠনটি সৃষ্টি ও তাকে গড়ে তোলার একক কৃতিত্ব শেখ মুজিবের। নেতৃত্বের গতিশীলতার কারণে ছাত্রলীগ দ্রুত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদ বৈঠকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু হলে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরা এই মত প্রকাশ করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। অথচ সেই সময় পাকিস্তানের বেশিরভাগ (৫৬ শতাংশ) মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতিটি সভা ও মিছিলে শেখ মুজিব ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতাদের অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। একপর্যায়ে শেখ মুজিবসহ অনেককে জেলে নেওয়া হলো। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। রমনা রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় বলেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। শেখ মুজিব সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন এবং অন্য ছাত্রদের সঙ্গে স্লোগান তোলেন, ‘মানি না’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে জিন্নাহ আবার একই কথা বললে আবারও ছাত্ররা তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর ফজলুল হক হলে একটি ছাত্রসভা হয়। সেই সভায় একজন ছাত্র জিন্নাহর বক্তব্যের সমর্থনে কথা বলেন। সভায় উপস্থিত শেখ মুজিব সেই ছাত্রের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাঁকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। বাংলা ভাষা ৫৬ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।’

শেখ মুজিবের বাবা চাইতেন তাঁর ছেলে আইন পড়ুক। কিন্তু যুবক শেখ মুজিবের তাতে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। বাবা তাঁকে এমনও বলেছিলেন, আইন পড়ার জন্য তিনি বিলেতেও যেতে পারেন। তাঁর ইচ্ছা ছেলে ব্যারিস্টার হবে। তখন সমাজে ব্যারিস্টারদের কদর আকাশচুম্বী। প্রয়োজনে তিনি জায়গা-জমি বিক্রি করতেও প্রস্তুত ছিলেন। শেখ মুজিব বাবাকে জানালেন, বিলেতে যাওয়ার চেয়ে জনবিরোধী মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রতিবাদ করাটা তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আক্ষেপ করতেন যে পাকিস্তানের জন্য তিনি অন্যদের সঙ্গে আন্দোলন করেছেন আর যেই পাকিস্তান পেয়েছেন দুটির মধ্যে অনেক তফাত। তাঁকে গ্রামের সাধারণ মানুষ যখন প্রশ্ন করতেন যে পাকিস্তানে তারা নির্যাতন আর অবিচারের শিকার হন, সেই পাকিস্তানের জন্য তিনি কেন আন্দোলন করেছিলেন। তখন তিনি বেশ বিচলিত হতেন। তিনি এও বুঝেছিলেন, কোনও মুসলিম লীগ নেতা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক তা চাইতেন না। হয়তো দুই একজন ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি আরও দেখলেন কীভাবে পূর্ব বাংলার আয় করা অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন হচ্ছে এবং পূর্ব বাংলা অবহেলিত হচ্ছে। শেখ মুজিব সব সময় এটি উপলব্ধি করতেন কোনও আন্দোলন প্রতিবাদ করতে হলে প্রয়োজন একটি দক্ষ ও কার্যকর সংগঠন, যে কারণে তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে ছাত্রলীগ খুবই ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরে ছাত্রলীগকে আবার পুনর্গঠন করার দায়িত্ব নিলেন। ঢাকায় ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন হলো শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে। নতুন কমিটি হলো। সেই কাউন্সিলে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকবো না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকার আর আমার কোনও অধিকার নাই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি ছাত্র নই।’ বর্তমান ক’জন ছাত্রনেতা এমন বক্তব্য দিতে পারেন?

ছাত্ররাজনীতি থেকে অব্যাহতি নিয়ে শেখ মুজিব একটি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে নজর দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তরুণ শেখ মুজিবসহ অনেক ছাত্রনেতাই জড়িত ছিলেন। এতে টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতা শামসুল হক বেশ সহায়তা করেন। একটি খসড়া ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হয়। তাতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। শুধু দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রাখার প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তী সময় এই প্রস্তাবগুলোই ঐতিহাসিক ছয় দফার ভিত্তি রচনা করে। জেল-জুলুমের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার সবসময় শেখ মুজিবের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন, মোট ১৩ বছর জেলে কাটিয়েছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দুবার (আগরতলা মামলা ও ১৯৭১ সালে)।

কাজের মানুষ শেখ মুজিব বুঝতে পারতেন কোন সময় কী কাজটা করতে হবে। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, জনগণকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক করতে হলে তাদের সামনে শাসকদের কীর্তিকলাপ তুলে ধরার কোনও বিকল্প নেই। তিনি সোহরাওয়ার্দীসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের নিয়ে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমাবেশের মাধ্যমে মানুষের কাছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-শাসনের কথা তুলে ধরতেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল নিরঙ্কুশ।

১৯৫৩ সাল নাগাদ দেশে একমাত্র রাজনৈতিক দল যা জনগণের দলে পরিণত হতে পেরেছিল, তা হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর অন্যতম কারণ ছিল, দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। আর দলে শেখ মুজিব, শামসুল হক, মোল্লা জালালউদ্দিন, নইমউদ্দিন আহমেদ, খালেক নেওয়াজ খানের মতো একঝাঁক তরুণ নেতার সমাবেশ হয়েছিল। মওলানা ভাসানী আসামের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নে গণভোটের সময় তাঁর ভূমিকার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে একটি পরিচিত নাম হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে একটি যুক্তফ্রন্ট হয়েছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও ছিল কৃষক প্রজা পার্টি, নেজামে ইসলামী আর গণতন্ত্রী দল। নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল। সেই নির্বাচনই ছিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এক পাকিস্তানের প্রথম ও সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন। তবে নির্বাচন শেষে যুক্তফ্রন্ট এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে সরকার গঠন করেছিল তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। এরপর শুরু হলো নতুন মাত্রায় পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের একটি সিভিল সরকারকে উৎখাত করে সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান  দেশে সামরিক শাসনপর্ব শুরু করে যা ক্ষমতায় ছিল দশ বছর। এ সময় সব রাজনৈতিক নেতাকে জেলে যেতে হয় আর নিষিদ্ধ হয় সকল রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মকাণ্ড। সেনাশাসনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলটির তৃণমূল কর্মীরা শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও দলটিকে টিকিয়ে রাখেন।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব কর্তৃক ঘোষিত বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফায় আইয়ুব খান পাকিস্তান ভাঙার একটি নীলনকশা আবিষ্কার করেন এবং কিছু দিন পরই শেখ মুজিবকে আটক করে, তিনিসহ ৩৫ জন আওয়ামী লীগ নেতা, সামরিক-বেসামরিক আমলার বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা (আগরতলা মামলা নামে খ্যাত) রুজু করেন। সেই মামলার শেষ পরিণতি ছিল মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু সারা দেশে আইয়ুববিরোধী তুমুল ছাত্র আন্দোলনের (ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন) তোড়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাংলার রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন। তত দিনে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি, আর তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা কখন আকাশচুম্বী।

আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করবেন। মওলানা ভাসানীসহ অন্য বামপন্থি দলগুলো এই সেনাশাসকের অধীনে ওই নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, এই নির্বাচনই বদলে দিতে পারে পাকিস্তানের ইতিহাস আর উপমহাদেশের মানচিত্র। পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় ১৬৭টি আসনে।

বাঙালি পাকিস্তান শাসন করছে, তা তো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মানতে পারে না। শুরু হতে পাকিস্তানের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল দেশটির সামরিক-বেসামরিক আমলাদের একটি অশুভ শক্তির কাছে। সেই অশুভ শক্তি দেশটিকে আর উঠে দাঁড়াতে দেয়নি। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন নির্ধারিত ছিল। ১ তারিখ ইয়াহিয়া খান এক রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে তা স্থগিত করে জিন্নাহর পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকেন। সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে পূর্ব বাংলার সিভিল প্রশাসনের ভার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে চলে গিয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন স্থগিতাদেশ ঘোষণার পর সারা বাংলা এক উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে। ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সের পড়ন্ত বেলায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি জনগণের অধিকার চাই’। শেষ করেন এই বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর এই বক্তৃতা ছিল পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক।

৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলমুক্ত হয়ে এক স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার হয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছরে তাঁর কীর্তি বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে যে বিষয়টির ওপর তাঁর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি ছিল সেটি হচ্ছে প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করা। তিনি কখনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। প্রয়োজনে তিনি দলের সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চেয়ে দলকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে দলকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কামারুজ্জামানের ওপর। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। আমরা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে জন্ম-জন্মান্তর ধরে যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে, তাদের মাঝেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেঁচে থাকবেন। জন্মদিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো
অর্থ আত্মসাতের মামলাড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো
তিন ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলো রাজবাড়ীর ট্রেন চলাচল
তিন ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলো রাজবাড়ীর ট্রেন চলাচল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ