X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’

নাদীম কাদির
২১ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫০আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫০

সব দুর্ঘটনাই কি দুর্ঘটনা? বাংলাদেশে দুর্ঘটনার অভাব নেই। ছোট, মাঝারি ও বড় কত রকমের দুর্ঘটনা। প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটার পরে একই নিয়মে ব্যাখ্যা প্রদান, একে অন্যকে দোষারোপ করা যেন একটি লীলাখেলায় পরিণত হয়েছে। কত জীবন চলে গেল, এসব শুধু নথিপত্রে থেকে গেলো। হৃদয় নিংড়ানো বেদনা নিয়ে একেবারেই তাদের নিজস্ব পৃথিবীতে বেঁচে আছে আপনজনেরা। কয়েক দিনের সমবেদনা প্রকাশের মাধ্যমেই ঘটনার ধামাচাপা পড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কার্লিনের ‘ডান্স উইথ দ্য ফায়ার’ গানটির কথা। যদিও তা গাওয়া হয়েছিল ভিন্ন অর্থে। আমার কাছে ডান্সিং উইথ দ্য ফায়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যার ক্ষতি হওয়ার তার তো হয়েই গেলো, কিন্তু কোনও অনুশোচনা ছাড়াই আবার আরেকটি ঘটনার খবর আমাদের সামনে হাজির হয়। আমরা যেন আগুন নিয়ে নাচতে ব্যস্ত। যে নাচে আনন্দ নাই, আছে শুধু মৃত্যু আর কষ্ট।

চলুন ফিরে দেখা যাক কয়েকটি বড় বড় আগুনের লীলাখেলা। বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুন বা চকবাজারের মৃত্যুর ঢল। সর্বশেষ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে প্রায় অর্ধশতাধিক মৃত্যু হলো আগুনের লীলাখেলায়। বারবার সব সরকারি মহল থেকে একই বয়ান, বিল্ডিংয়ের মালিকের দোষ ছিল, রেস্টুরেন্টের মালিকের দোষ ছিল, এমনকি যারা সুন্দর সময় কাটাতে ওখানে গিয়েছিল তাদেরও নাকি দোষ আছে। অথচ এফ আর টাওয়ারটি এখনও বীভৎস রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হায়রে কপাল! ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’! চলুন আমরা ভবনের কথাই বলি। ভবনের মালিক নিশ্চয়ই কোনও ইঞ্জিনিয়ার বা স্থপতি নয় যে ওনার দোষ হবে। উনি সৌন্দর্য পিপাসু একজন মানুষ, তাকে বলা হয়নি তার ভবনে অফিস, বাসা নাকি রেস্টুরেন্ট হবে। উনি পয়সার তাগিদে অফিস রেস্টুরেন্ট বাসা সব গোঁজামিল করে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। আহা সমাজের কত দাম, তার সেই পাওয়া টাকা দিয়ে জীবনযাপন করতে। উনারই বা দোষ কী। এখন তো টাকা মানেই মর্যাদা। প্রশ্ন হলো এখন তার মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? আসুন স্থপতির কথায়। স্থপতি জমির মালিকের সঙ্গে, বাড়ির মালিকের সঙ্গে আলাপ করে ভবনটির নকশা করেছেন, ইঞ্জিনিয়ার তা তৈরি করে দিয়েছেন। হয়তো নকশায় ত্রুটি থাকতে পারে, হয়তো ইঞ্জিনিয়ারের ভবন তৈরির সময় কোনও ঘাটতি থাকতে পারে। এজন্য তাদের কাঠগড়ায় আনার জন্য চাপাচাপি চলছে। এই চাপাচাপি হচ্ছে আসল রহস্য। এই চাপাচাপিই হচ্ছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’, এই চাপাচাপিই হচ্ছে ‘ডান্সিং উইথ দ্য ফায়ার’।

আসুন বিষয়টি গবেষণা করা যাক। গবেষণাটা খুব সহজ। প্ল্যান পাস করেছে রাজধানীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), যেখানে কর্মকর্তা, কর্মচারীরা সবাই নাকি কোটিপতি। এই আলাদীনের চেরাগ রাজউকের বৈশিষ্ট্য। বিল্ডিং শেষ হওয়ার পর আরও কয়েকটা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বিল্ডিং পরিদর্শন করে অনুমতি দেন। এর প্রধান একটি হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন। সেখানেও শোনা যায় বেশ কিছু কোটিপতির ভিড়। এবার চলুন বেশ কিছু নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা এসব ভবন। পরিদর্শন করা তাদের দায়িত্ব। তাহলে জিজ্ঞাসা করতে হয়, তারা কি পরিদর্শন করেননি? তারা পরিদর্শন করতে গিয়ে কোনও না কোনও কারণে ত্রুটিগুলো না দেখার ভান করেছেন অথবা তারা মূর্খ, শুধু নামমাত্র পরিদর্শক। ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ঘটনা ঘটার পরে একই কথা বলেন বারবার, যা তারা ঘটনাস্থলে না গিয়ে অফিসে গিয়েই বলতে পারেন।

এবার আসুন ভবন মালিকদের ব্যাপারে। তারা মানবিক দিকটা বিসর্জন দিয়ে শুধু কি টাকাই গুনবেন? এটা সত্যি ভবন মালিকরা পয়সার জন্যই বিনিয়োগ করেন। কিন্তু তাই বলে হাত ঝেড়ে ফেললে তো হবে না। সবারই কিছু না কিছু ত্রুটি ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু আমি যখন যত দোষ নন্দ ঘোষ বলছি, সেখানে মূল দায়িত্বটি কার? নন্দ ঘোষকে বাদ দিয়ে ‘সত্য ঘোষ’কে নিয়ে আলোচনা করি। ‘সত্য ঘোষ’ হলো দুর্নীতি আর চুরি করা টাকার গরম দেখায় যারা।

ওপরের আলোচনার বিষয় দায়িত্বহীন দায়িত্বশীলেরা। এ কারণে কেউ কারও দায়িত্বই পালন করেননি। যারা আনন্দের জন্য সময় কাটাতে গিয়েছিলেন তারা তাদের টাকা খরচ করেছেন, ভবনটিকে নিরাপদ মনে করে। সে কারণে তাদের আমাদের অর্থাৎ ‘নন্দ ঘোষ’রা ক্ষতিপূরণ দিবেন, তারাই একমাত্র যাদের কোনও দোষ নেই। তাদের একটাই দোষ, তারা কেন সেদিন সেই ভবনে বিনোদনের জন্য গেলেন।

ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন তাদের ব্যবসায়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ওই দুর্ঘটনার পরে। এটা তাদের প্রাপ্য শাস্তি। হয়তো আশা করা ভুল হবে তারা তাদের প্রতিষ্ঠান বা ভবনগুলোকে নিরাপদের ব্যবস্থা করবেন, যদিও সেই আশা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হবে। নন্দ ঘোষরা জেগে উঠুন এবং জীবন রক্ষা করুন।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন, ব্যতিক্রম থাকতেই পারে
মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করছেন, ব্যতিক্রম থাকতেই পারে
জন্ম আর মৃত্যুর সুরেলা মেলবন্ধনের প্রতিধ্বনি
৩৫তম জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসবজন্ম আর মৃত্যুর সুরেলা মেলবন্ধনের প্রতিধ্বনি
দারুণ সেঞ্চুরিতেও রাব্বির কাছে ম্লান সাকিব
দারুণ সেঞ্চুরিতেও রাব্বির কাছে ম্লান সাকিব
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ