X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

কেন এত গরম লাগছে?

গওহার নঈম ওয়ারা
২১ এপ্রিল ২০২৪, ২০:৪১আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ২০:৪২

ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এপ্রিল এবার ভোগাবে আরও কিছু দিন। এই সপ্তাহে গরম কমার কোনও লক্ষণ আবহাওয়াবিদরা দিতে পারছেন না; বরং বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন সবাই। স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার নোটিশ জারি হয়েছে। পশ্চিম বাংলার জলহাওয়াবিদরা তাদের উত্তর বাংলার চাইতে দক্ষিণ বাংলা নিয়ে বেশি চিন্তিত। চলতি সপ্তাহে আরও গরম বাড়বে! দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাতেই তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে রাজ্য সরকার।

এরইমধ্যে কলকাতার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এটা সেখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। কলকাতার খুব কাছেই বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায় বসানো আবহাওয়া দফতরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র বলছে সেখানে ৪১ থেকে ৪২ মধ্যে ওঠানামা করছে। চুয়াডাঙ্গায় এপ্রিলের তাপমাত্রা গড় হচ্ছে ৩৩.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেই বিবেচনায় চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে এখন গড়ের চেয়ে প্রায় ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। গত শনিবার যশোরের তাপমাত্রা  সবাইকে টেক্কা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছিয়ে যায়। আর চুয়াডাঙ্গায় থাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

ঢাকায় এত গরম আগে কি পড়েনি?

এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর গরম এর চেয়ে বেশি ছিল; ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। তার আগে ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ষাট বা পঁয়ষট্টির থেকে কম তাপমাত্রা থাকার পরেও আমরা কেন  ঘোল  খাচ্ছি! কেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে? কেন রাস্তার পিচ নরম হয়ে যাওয়ার মন খারাপ করা ছবি ছাপা হচ্ছে সংবাদ আর যোগাযোগমাধ্যমে? বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ডায়রিতেও ষাটের দশকে  ঢাকার চৈত্র বৈশাখের কাটফাটা গরমের কথা আছে। কিন্তু  সেই গরম এখনকার মতো এতটা দুর্বিষহ ছিল কি?

সেই ষাট সালে যখন ঢাকার পানির ট্যাংকগুলোর পানি টগবগ করে ফোটা পানির মতো গরম তখন ঢাকায় কত পুকুর আর জলাধার ছিল। বাড়ি বাড়ি কুয়া ছিল। অল্প চেষ্টায় চাপাকলে পানি পাওয়া যেত। গাছের কথা আর নাই বা বললাম।

ঝাউতলা, সেগুনবাগিচা, বনগ্রাম রোড, কদমতলি এগুলো তো এই নগরীতেই ছিল সাইনবোর্ডে নয়, বাস্তবে।

পুরাতন বৃক্ষ সাফ করার সঙ্গে সঙ্গে লাগিয়ে চলেছি ভুল গাছ, একাশিয়া, ইপিল ইপিল, ইউক্যালিপটাস এখন আঁকছে আমাদের দিগন্তরেখা।

গত ৫০/৬০ বছরে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব শহর ক্রমশ কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কাচের ঘেরাটোপে তৈরি হচ্ছে সারি সারি ইমারত। সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন আর এয়ারকুলার ছাড়া কেউ অন্য কিছু ভাবতে পারছে না। সূর্যের তাপমাত্রার সঙ্গে যোগ হচ্ছে এসব ঠান্ডা রাখার মেশিনের তাপ। আসামিকে ম্যানেজ করে থানাতে দারোগার ঘরে এসি লাগানোর গল্প আর বদলির সময় সেটা বগলদাবা করে নিয়ে যাওয়ার খবরে এখন আর কেউ আশ্চর্য হয় না। জামাকাপড় থালাবাসনের মতো এসি এখন নিত্যকার সঙ্গী। খোদ ঢাকা শহরেই এলাকা ভিত্তিতে তাপমাত্রার রকমফের ঘটছে গাছ আর জলাধারের অবস্থান আর ব্যবস্থাপনার জন্য।

গ্রীষ্ম ব্যবস্থাপনা

বিভিন্ন ঋতুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য ঋতু বিশেষে অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, সিনেমা হল, শপিং মল খোলা বন্ধের সময়ের রকমফের করা হয়। এককালে এ দেশেও সেই রেওয়াজ ছিল। প্রধান শিক্ষক সিদ্ধান্ত নিতেন গ্রীষ্মকালে কবে থেকে ‘মর্নিং স্কুল‘ হবে আর কবে থেকে আবার নিয়মিত স্কুল হবে।

মনে পড়ে ষাটের দশকে জেলা স্কুলে পড়ার সময় মর্নিং স্কুল চালুর জন্য আমরা দরখাস্ত করতাম। দু-একবার অ্যাসেম্বলি চলার সময় পরিকল্পিত‘ অজ্ঞান‘ হওয়ার নাটক করতে হতো। পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যেতো মর্নিং স্কুল। সারা দেশে একই দিনে একই সময়ে সেটা হতো না। এখন সিদ্ধান্ত  হয় কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকার তাপমাত্রা অনুযায়ী। ঢাকাই যেন এখন দেশ। গরম বলে সারা দেশের স্কুলে এখন তালা ঝুলানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। শীতের সময়ও সেটা করা হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় উত্তম। ঢাকার তাপমাত্রার সিদ্ধান্ত কেন থানছি, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িকে মেনে নিতে হবে। সেখানে তো তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আছে।  

কলকাতাতেও তাপমাত্রা ৪০ ছুঁই ছুঁই। বুধবার সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই। কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ডিগ্রি বেশি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দফতর।

মঙ্গলবার শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বাতাসে সর্বোচ্চ আর্দ্রতার পরিমাণ থাকবে ৮৯ শতাংশ। ফলে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বজায় থাকবে।

ঝাড়খণ্ড সে দেশের একটি প্রায় শুষ্ক রাজ্য। গরম পড়ে সেরকম। সেখানে ইতোমধ্যে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে ফেলেছে। সেই রাজ্য এই গরমে স্কুল নিয়ে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছ।

বিজ্ঞপ্তিটি এরকম …” ২২ এপ্রিল থেকে রাজ্যের সমস্ত স্কুলে ছোটদের ক্লাস হবে সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। এই সময়ে ক্লাস চলবে নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের। এছাড়া, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস চলবে সকাল ৭টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত।

সরকারের এই নির্দেশিকা ঝাড়খণ্ডের সব সরকারি, সরকার পোষিত, ‘অসরকারি’ এবং বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা দফতর। ঝাড়খণ্ডের ওই নির্দেশিকায় আরও জানানো হয়েছে, স্কুল চলাকালীন রোদের মধ্যে কোথাও প্রার্থনা বা খেলাধুলার আয়োজন করা যাবে না। খোলা আকাশের নিচে ছাত্রছাত্রীদের দাঁড় করানো যাবে না। স্কুল থেকে মিড ডে মিল আগের মতোই পাবে সকলে। সরকার জানিয়েছে, এই সময়ের মধ্যে শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও ক্ষতি হলে তা কীভাবে পূরণ করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।“ পড়ালেখা চালু রাখাটা সবচেয়ে জরুরি।

কিছু জরুরি কথা

দাবদাহ সারা পৃথিবীর জন্য সমস্যা। ব্রিটেনে প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার মানুষ মারা যায় গরমে। পুরোনো রেকর্ডে দেখা যায়, তাপপ্রবাহ শুরুর প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মানুষ বেশি মারা যায়। ২০০৩ সালে ইউরোপজুড়ে তাপপ্রবাহে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। শিশুরা খুব বেশি নাজুক অবস্থায় থাকে অনেক সময়, তারা নিজেদের অস্বস্তির কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না। এ কারণে মা-বাবারা সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে পারে না। এদিকে আমাদের অধিক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

কাউকে তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখলে কী করা উচিত?

অতিরিক্ত গরমে কাউকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখলে শুরুতেই তাকে আধা ঘণ্টা ঠান্ডায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি তাতে তিনি সুস্থ হয়ে যান তাহলে বুঝতে হবে অসুস্থতা গুরুতর নয়। এ বিষয়ে ব্রিটিশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কিছু নির্দেশনা আছে ।

১. কেউ গরমে অসুস্থ হলে তাকে যত দ্রুত সম্ভব ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে;

২.  শুইয়ে দিতে হবে এবং তার পা কিছুটা ওপরে তুলে দিতে হবে।

৩.  প্রচুর পানি বা পানীয় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পানিশূন্যতা দূর করার পানীয় দেওয়া যেতে পারে।

৪. আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করতে হবে, ভেজা কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে মুছে দেওয়া যেতে পারে শরীর। বগলের নিচে এবং ঘাড়ে গলায় ঠান্ডা পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কিন্তু ৩০ মিনিটের মধ্যে যদি সুস্থ না হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির হিটস্ট্রোক হবার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেরি না করে তখনই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। হিটস্ট্রোক হলে মানুষের ঘেমে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ওই ব্যক্তি।

হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি কাদের?

অতি গরমে স্বাস্থ্যবান মানুষের হিটস্ট্রোক হবার আশঙ্কা কম। কিন্তু কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রবীণ এবং যাদের আগে থেকেই অসুস্থতা রয়েছে, তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি।

যাদের ডায়াবেটিস টাইপ ওয়ান বা টু রয়েছে তাদের শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং কিছু জটিলতা দেখা দেয়।

ওষুধের কারণেও ঝুঁকি বাড়তে পারে

কিছু রোগের ওষুধ, যেমন মৃগীরোগ ও পারকিনসন্সরোধী ওষুধের কারণে গরম বাড়তে পারে। এছাড়া লিথিয়াম রয়েছে এমন ওষুধেও বাড়তে বাড়ে গরমবোধ।

দাবদাহের সময় সাধারণভাবে কী করা উচিত

কাজটা খুবিই সাদামাটা– ঠান্ডা থাকুন আর শরীরকে পানিশূন্য হতে দেবেন না।

গরমে রোদের মধ্যে কাজ না করা এবং বেশি পরিশ্রমের কাজ করা থেকে বিরত থাকা ভালো।

ঘরে দিনের বেলায় পর্দা টেনে দিন। প্রচুর পানি এবং তরল (দুধ) পান করুন।

লেখক: গবেষক; বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের কর্মী      

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অভিষেকে আস্থার প্রতিদান দিলেন তানজিদ
অভিষেকে আস্থার প্রতিদান দিলেন তানজিদ
এখনও উদ্ধার হয়নি পুলিশের অস্ত্র, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ
২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে সহিংসতাএখনও উদ্ধার হয়নি পুলিশের অস্ত্র, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ
রিকশাচালকদের ছাতা বিতরণ করলেন মেয়র আতিক
রিকশাচালকদের ছাতা বিতরণ করলেন মেয়র আতিক
রেল ও সড়ক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠনের নতুন কমিটি
রেল ও সড়ক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠনের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ