X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মমতার বিজয় ও মিডিয়ার পরাজয়...

শুভ কিবরিয়া
২৬ মে ২০১৬, ১২:৫৫আপডেট : ২৬ মে ২০১৬, ১৩:০০

Shuvo Kibriaপশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল বিক্রমে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নির্বাচনে সোনিয়া গান্ধীর জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থিদের দল সিপিআই (এম) জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে। নির্বাচনি মাঠে ছিল নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি, তারাও এককভাবে লড়াই করে। কংগ্রেস-বাম জোট হওয়াতে মিডিয়ায় জোর প্রচারণা ছিল এবার ধরাশায়ী হবেন মমতা। ২০১১ সালে বাম জমানার ৩৪ বছরের শাসন উল্টো মমতা বাজিমাত করেছিলেন তার তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে। সে সময় জোট দল হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন কংগ্রেসকে। এবার গত প্রায় পাঁচ বছরে মুখ্যমন্ত্রীর জমানায় মমতা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন। তার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন অনেককে ক্ষুব্ধ করেছে। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে। সারদা চিট ফান্ড, নারদ অর্থ কাণ্ড সেসব ঘটনা মিডিয়ায় সরবে প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনাকে মিডিয়া মমতা বিদ্বেষের কাজে লাগিয়েছে। মমতাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে প্রভাবশালী মিডিয়া পশ্চিমবঙ্গে মমতার ইমেজ নষ্টের কাজ চালিয়েছে। মমতার কর্তৃত্ববাদী শাসন এই প্রবণতাকে আরও উস্কে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে মিডিয়ার এই মমতাবিরোধী হাওয়া শেষদিন পর্যন্ত প্রচারণা চালিয়েছে যে, এবারের নির্বাচনে হারছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার প্রচারণায় বাংলাদেশের মিডিয়াও প্রভাবিত হয়ে মমতাকে ভোটের ফলাফলে পর্যদস্তু করে ছেড়েছে।
কিন্তু শেষতক মমতা এসব মিডিয়া প্রপাগান্ডাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন। এখানে দুটো বিষয় আলোচ্য। এক, মমতার বিজয় ঘটল কেন? দুই, মিডিয়ার বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণিত হলো কেন?
০২.
এসব বিবেচনার আগে আমরা পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচনের ফলাফলের চেহারাটা দেখতে পারি। নির্বাচনি ফলাফল বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন জোড়াফুল প্রতীকের সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের চাইতে ৫.৯৭% ভোট বেশি পেয়ে এবার ২১১টি আসন পেয়েছে। ২০১১ সালের চাইতে তৃণমূল এবার ২৭টি আসন বেশি পেয়েছে। তৃণমূলের এবারের প্রাপ্ত ভোট হচ্ছে মোট গৃহীত ভোটের ৪৪.৯ শতাংশ।

আরও পড়তে পারেন: তিস্তা চুক্তির পথ সুগম করতেই বাংলাদেশের ইলিশ-কূটনীতি!
অন্যদিকে কংগ্রেস পেয়েছে ১২.৩% ভোট। প্রাপ্ত আসন ৪৪, যা গতবারের চাইতে ২টি বেশি। সিপিআই(এম) পেয়েছে ১৯.৭% ভোট, কিন্তু আসন পেয়েছে ৩৩টি। গতবারের চাইতে তাদের আসন কমেছে ২৮টি, ভোট কমেছে ১০.৩৮%। বিজেপি পেয়েছে ১০.২% ভোট, আসন ৩।

অর্থাৎ বিগত ২০১১ সালের নির্বাচনের চাইতে এবার বিজেপি ৬.১৪% বেশি, কংগ্রেস ৩.২১% বেশি এবং তৃণমূল কংগ্রেস ৫.৭৯% বেশি ভোট পেয়েছে। ভোট কমেছে বাম দলের। ১০.৩৮% কম ভোট পেয়েছে এবার বাম দল সিপিআই(এম)।

০৩.

২০১১ সালের সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে পরাভূত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক অসাধারণ বিজয় পেয়েছিলেন। নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতায় বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন মমতা। ২০১৬ সালে ‘বদলা নয় বদল চাই’  এই আওয়াজ ছিল তখন মমতার কণ্ঠে। কিন্তু মমতা জনতার সেই রায়কে ততটা স্বস্তি দেননি। বরং এক কর্তৃত্ববাদি শাসন উপহার দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্রের বদলা দিতে চেয়েছেন জনগণকে। তাই মমতার বিরুদ্ধে জনরোষ ছিল, ছিল মিডিয়ার মমতাবিরোধী প্রচারণাও। তারপরও মমতা জিতলেন কেন?

এক. মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মতো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একক কোনও প্রার্থী ছিল না অন্য দলের। বিজেপি, কংগ্রেস-বাম জোট সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতার বিপরীতে কোনও একক ক্যারিশমেটিক ইমেজ দাঁড় করাতে পারেনি। তাই সকল দোষ সত্ত্বেও মমতার ক্যারিশমা আর ঝড়ো ব্যক্তিত্বের ওপর ভরসা করেছে আম-জনতা।

দুই. গ্রামাঞ্চলে মমতার উন্নয়ন কর্মসূচি সত্যিকার অর্থেই মানুষের মনে ধরেছে। মানুষের কাজে লেগেছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তৃণমূলে যে অবকাঠামোগত, বাস্তবিক ও সেবাখাতের সরাসরি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে তার সুফল পেয়েছে মানুষ। তার ‘খাদ্যশ্রী’ কর্মসূচির আওতায় এসেছে ৭.৯৪ কোটি মানুষ। এই কর্মসূচির আওতায় ২ টাকা কেজি দরে প্রতি মাসে প্রতিটি পরিবার ৩৫ কেজি খাদ্যসামগ্রী পায়। ‘কন্যাশ্রী’ কর্মসূচির সুফল পায় ৩৩ লাখ কন্যাসন্তান। বাল্যবিবাহের বদলে উচ্চশিক্ষায় সহায়তা মেলে এই প্রকল্পে। ‘যুবশ্রী’ কর্মসূচির আওতায় শিক্ষিত বেকার যুবকরা পায় ১৫০০ টাকা বেকার ভাতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষ ২ টাকা কেজি দরে ভর্তুকি রেশন পায়। এর আওতায় আছে ১৫ লাখ মানুষ।  এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে মমতাকেই ফিরিয়ে এনেছে আমজনতা।

তিন. সংখ্যালঘু মুসলমানদের যে আশ্রয় ও নিরাপত্তা মমতা দিতে পেরেছেন তার ওপর আস্থা রেখেছে তারা। কেননা জঙ্গিবাদী তকমায় সারা ভারতে মুসলমানরা নানাবিধ আতঙ্ক ও বিপদের মধ্যে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে মমতা নানাভাবে তাদের সুরক্ষা দিয়েছেন। তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি, সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবন-জীবিকা অধিকতর নিরাপত্তা দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত চলছে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের আশ্রয় মমতা দিদিই। ফলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের একচেটিয়া ভোট মমতার বিজয় নিশ্চিত করেছে।

চার. বামদল ও কংগ্রেস বহুবছর ধরে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার রেশ কাটেনি। ক্ষত শুকোয়নি। দুই দল জোট করলেও তা উপরিকাঠামোতেই থেকেছে। দলীয় ভোটারদের তৃণমূলকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। কাজেই কংগ্রেস-সিপিআই (এম) জোট হলেও কট্টর কংগ্রেসিরা যেমন সিপিআই (এম) প্রার্থীকে ভোট দেয়নি তেমনি কট্টর বামপন্থিরাও কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দেয় নাই। এই রেসারেসির সুফল গেছে তৃণমূলের ঘরে। সেটা মমতার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

পাঁচ.  ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি চেয়েছে কংগ্রেস ও বামের উত্থান ঠেকাতে। এটা তার সর্বভারতীয় রাজনৈতিক স্ট্যাটেজি। সেই কৌশলে পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস ঠেকানোর তাড়নায় বিজেপি তলে তলে তৃণমূল কংগ্রেসকে নানাভাবেই সহায়তা করেছে। এটাও মমতার বিজয়কে তরান্বিত করেছে।

০৪.

এবার দেখা দরকার মিডিয়ার নির্বাচনি বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণিত হলো কেন? বা এখান থেকে মিডিয়ার আত্মবিশ্লেষণ কী হতে পারে?

এক. মমতা প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেই জড়িয়ে পড়েন মিডিয়ার সঙ্গে নানা বিরোধে। কেননা ভোটের আগে যে মমতাকে চিনতো মিডিয়া প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেই তিনি বদলে যেতে থাকেন। মমতার এই বদল কিংবা নেতা মমতার বদলে মুখ্যমন্ত্রীর এই নবচেহারা মানতে পারেনি মিডিয়ার বড় অংশ। ফলে মিডিয়া মমতাবিরোধী একটা কট্টর অবস্থান নিয়ে ফেলে।

আরও পড়তে পারেন: বিতর্কিত ব্রিটিশ এমপির বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা

যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মিডিয়া তার পেশাদারিত্ব হারিয়ে অ্যাকটিভিস্টের ভূমিকায় চলে আসে। মিডিয়া যত অ্যাকটিভিজমে জড়িয়ে পড়ে ততই সে জনমানুষের ভাবনা পড়তে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয় মমতাবিরোধিতায় ক্ষুব্ধ মিডিয়া নিজের ভাষা জনমানুষের মুখে লাগাতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানকার মূলধারার মিডিয়া মমতাবিরোধিতা অক্ষুন্ন রাখে। যার ফলে নির্বাচনে মিডিয়ার বিশ্লেষণ বাস্তবতা থেকে দূরে সরতে থাকে।

দুই. পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছরের বাম শাসন তার অনেক ফলোয়ার রেখে যায়। মিডিয়ায় এই ফলোয়ারের সংখ্যা যথেষ্ট। বামপন্থার এই রাজনৈতিক চেতনা সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বে প্রভাব ফেলে। মমতা পেশাদারি সাংবাদিকতার বদলে সেই রাজনৈতিক সাংবাদিকতার শিকার। ফলে মমতা যেমন সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ পেশাদারিত্বের সুদৃষ্টি পান নাই, মমতাবিরোধিতার চোখ নিয়ে সাংবাদিকতাও তেমনি পশ্চিমবঙ্গের জনমানুষের মনের প্রকৃত ভাষা পড়তে সক্ষম হয় নাই। ফলে সাংবাদিকতা মমতাবিরোধিতায় সফল হলেও ভোটের ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ইঙ্গিত দিতে সম্পূর্ণ রুপে ব্যর্থ হয়।

পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার এই হাওয়া বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়াতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে বাস্তবতাবর্জিত সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভূমিধস বিজয় একটা জিনিস সুনিশ্চিত করেছে যে, পেশাদার সাংবাদিকতা আর অ্যাকটিভিজম কিংবা পার্টিজান সাংবাদিকতা দুটো আলাদা জিনিস। বাংলাদেশের মিডিয়া এই জিনিসটি যত দ্রুত বুঝতে পারবে ততই সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের জন্য মঙ্গল।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ