X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু-কিশোর নয়, এ দায় আপনার-আমার-আমাদের

মাসুদা ভাট্টি
৩১ মে ২০১৬, ১২:৩২আপডেট : ৩১ মে ২০১৬, ১৩:০৮

মাসুদা ভাট্টি শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অত্যন্ত আপত্তিকর একটি রিপোর্ট নিয়ে দেশে যখন গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় তখন বুঝতে হবে, সে দেশের সমস্যা সামান্য নয়, সমস্যার শেকড় অত্যন্ত গভীরে। বিশেষ করে কোমলমতি কিশোর-শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই যখন তাদেরকে রিপোর্টে হাজির করা হয় 'বোকা বোকা' সব প্রশ্ন দিয়ে এবং সেই রিপোর্টকে শেয়ার দিয়ে হাজার হাজার ‘আলোকিত মানুষ’(?) যখন চরম পুলক অনুভব করেন তখন প্রশ্ন জাগে, এই ‘কালেক্টিভ ম্যাডনেস’-এর আসলে শেষ কোথায়?
স্বাভাবিকভাবেই এই রিপোর্ট প্রচারিত হওয়ার পর থেকে বর্তমান সরকার ও সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ওপর চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়েছে। এই আক্রমণ যৌক্তিক কী অযৌক্তিক সে প্রশ্ন তুলছি না, কিন্তু এই প্রশ্ন তোলা জরুরি যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কোন আমলে খুব ভালো ছিল? এই মুহূর্তে যে দেশে একই সঙ্গে তিন/চার ধরনের শিক্ষা-পদ্ধতি বিদ্যমান এবং দেশের একটি গরিষ্ঠ সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনও ধরনের নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই পরিচালিত হচ্ছে সে দেশের শিক্ষারমানের চেয়ে ভালো হওয়ার কথা ছিল কি? প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাহলে সরকার কেন শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে পারছে না? কেন পারছে না, সে প্রশ্ন সরকারকে না করে নিজেকে করুন দয়া করে। কারণ, এই বছর খানেক আগে যখন এদেশে একটি কার্যকর শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছিলো তখন দেশব্যাপী আওয়াজ উঠেছিল, এই সরকারকে বদলাতে হবে কারণ, এই সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়নের নামে ‘ইসলামকে’ শিক্ষা-ব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। নারী নীতির বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থেকে তাজা-মোটা বাঁশ হাতে যখন হাজারে হাজার মাদ্রাসা ছাত্র ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে এসেছিল তখন কিন্তু ভয়ে লেজ গুটিয়ে আপনি-আমিই পালিয়েছিলাম ঘরের ভেতর। রাজপথের ঘটনা সরকার সামলাক - এই চিন্তা থেকে আমরা কেউই তখন কোনও কথা বলিনি।
একই কথা প্রযোজ্য শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও, শিক্ষানীতি নিয়ে যখন দেশের বিশাল জনসংখ্যার একটি অংশ হুঙ্কার দেয় দেশ অচল করার তখন আমরা ভয়ে চুপ মেরে যাই। দায় চাপাই সরকারের ওপর এবং নিজেকে আড়ালে-আবডালে রেখে অপেক্ষা করি, ‘দেখি না সরকার কী করে?’ এই চিন্তা নিয়ে। এবং যখন দেখি যে, সরকার একটি সার্টিফিকেট-সর্বস্ব জেনারেশন তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা কিশোর-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি যাচাইয়ের জন্য সাংবাদিকতার রীতি-নীতিকে অগ্রাহ্য করে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তা বাজারে ছেড়ে দেই, হাজারে হাজারে সেই রিপোর্ট শেয়ার হয় এবং লক্ষ লক্ষ বার সেইসব শিক্ষার্থীদেরকে আমরা অপমান করি, অথচ এই মুহূর্তে তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল ভালোবাসার। কারণ, এই অজ্ঞতার দায় তাদের একার নয়, এই দায় সবার- আপনার, আমার, সকলের এবং সবার আগে পিতা-মাতা-অভিভাবকের, কারণ একটি শিশু পাঠ্যবই থেকে সাধারণ জ্ঞান শেখে না, শেখে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে।

আরও পড়তে পারেন: আমার কাছে সবাই বাংলা শিখতে চেয়েছিল: মুস্তাফিজ

স্মরণ করি আমাদের আশির দশকের বড় হয়ে ওঠার সময়কালের কথা। ইতিহাস বিকৃতির সেই “মহাকালে” যারা লেখাপড়া করে আজকে বড় বড় পদে কাজ করছেন তারা হয়তো ভুলে গেছেন যে, কতবড় বিভ্রান্তির ভেতর তারা বেড়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, নেতৃত্ব, সমাজ বা রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের জানা ইতিহাসের ভেতর কতোখানি গলদ ঢুকিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সরকার ও নীতিনির্ধারকগণ। সামরিক শাসনের ভেতর শিক্ষাব্যবস্থার কী বেহাল দশা হয়েছিল তার হিসেব মেলাতে বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই, নিজেকেই প্রশ্ন করে দেখুন, উত্তর মিলবে। সেই সময় ঢাকা ও তার আশেপাশের ভালো স্কুলগুলোতে যারা ভালো ফল করতে পারবে না বলে মনে করেছে তারা চলে গেছে নরসিংদি কিংবা আরও দূরের কোনও শহরের স্কুলগুলোতে রেজিস্ট্রেশন করতে, কারণ একটাই, সেখানে গেলে নকলের সুবিধে পাওয়া যাবে। আজকের অনেক বিখ্যাতদের (যাদের কেউ কেউ এই লেখকেরও পরিচিত) মধ্যে অনেকেই সেই সময়ের ‘নকলের ফসল’ এবং অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এইসব নকলের ‘ফসল’দের অনেকেই পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নিয়েছেন ও আজকের জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এবার প্রশ্ন তুলুন যে, এই সব শিক্ষকদের কাছ থেকেই বা তারা কী শিখছে? আমরা প্রশ্নের গোড়ায় না গিয়ে প্রশ্নের মাথা নিয়ে দেশব্যাপী ঝড় তুলছি। যারা শেখাচ্ছেন তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে আমরা যারা শিখছে সেই সব শিশুদের ভিকটিম বানাচ্ছি - এইতো আমাদের মেধাবীদের কাজ!!

সামরিক শাসনের কথা বাদ দিই। তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে কী হলো? দেশ পেলো একজন রাজাকার রাষ্ট্রপতি এবং সেই সঙ্গে একজন রাজাকার শিক্ষামন্ত্রীও, যিনি গত দু’একদিন আগেই দেশ থেকে পালালেন, কারণ তার বিরুদ্ধে একাত্তরে পাকিস্তানি মিলিটারিদের “এন্টারটেইন” করার অভিযোগ উঠেছে। মেধা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে তখন চলুন প্রশ্ন তুলি,

ক) কারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে?; খ) কারা স্বাধীনতার ঘোষক-বিতর্ক তৈরি করতে গিয়ে ঘোষণা ২৫ মার্চ রাতে হয়েছিল নাকি ২৬ মার্চ হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে?; গ) কারা বলেছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি?; ঘ) কারা বলেছে, এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নয়?; ঙ) কারা সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার ধুয়া তুলে দেশব্যাপী তাণ্ডব তৈরি করেছে?; চ) কারা শাহবাগে জমা হওয়া তরুণদের নাস্তিক বানিয়ে দেশে চাপাতি-সন্ত্রাসীদের উস্কে দিয়েছে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার জন্য? এরকম হাজারো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি এবং এগুলোর জন্য কিন্তু টেলিভিশনে সদ্য প্রচারিত এই রিপোর্টের কোমলমতি কিশোর-কিশোরীরা দায়ী নয়। বরং এর জন্য দায়ী তাদের উত্তর-প্রজন্ম, অর্থাৎ আমরা। এখন বলুন, এই বিভ্রান্তির ভেতর বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোররা যদি বলেও যে, জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাহলেও তাদের দোষ দেওয়া যাবে কি? তারা যে, নজরুলকে “নরজুল” বলেনি, সেটা ভেবেই বরং আমাদের (কারণ, আমরা তাদেরকে শিক্ষিত করতে চাইনি, চেয়েছি ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার/টেলকোগুলোর বড় পদের চাকর বানাতে) খুশি থাকা উচিত, তাই না?

মেধা এমনি এমনি বিকশিত হয় না, মেধা বিকাশের জন্য মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। যখন পৃথিবীতে গণমাধ্যমের এতো দৌরাত্ম ছিল না তখন প্রকৃতিপ্রদত্ত মেধা নিয়ে ক্ষণজন্মা কিছু মানুষ পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। কিন্তু এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে শিশুর মেধা বিকাশের জন্য অনেক সহজ ও সুলভ পথই তৈরি হয়েছে। কেউ কি লক্ষ্য করেছেন যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে ক্রমশ শিশুদেরকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? হার্ড নিউজ এবং তার বিশ্লেষণ, বড়দের জন্য নাটক, গানের আয়োজন ছাড়া শিশুদের উপযোগী খুব কম অনুষ্ঠানই আজকাল চোখে পড়ে। আর সে কারণে শিশুরা ডোরেমোন নামক কার্টুনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাতে তাদের দোষ কতটুকু আর কতটুকু অভিভাবকের; তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে। শিশুতোষ পত্রপত্রিকা (এই মুহূর্তে আমার টাপুর-টুপুরের কথা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে কচি-কাঁচার আসরের কথা, খেলাঘরের কথা, ফেলুদা’র কথা, আমআঁটির ভেঁপুর কথা, রাজকাহিনীর কথা), গল্প-উপন্যাস কিংবা শিশুপাঠ্য বই-পুস্তকগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায় এবং তা নিয়ে সরকারকেও এক হাত নেওয়া যায়, কিন্তু তাতে যে সত্য এতোক্ষণ উচ্চারিত হলো, তা কি বদলাবে? মনে হয় না।

আরও পড়তে পারেন: নারায়ণগঞ্জ ইজ অনলি ফর ওসমানস!

সুতরাং, মেধা নিয়ে প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন এই বিতর্ক প্রলম্বিত হোক। আলোচিত হোক, গলদ আসলে কোথায়। স্কুল শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনে কারা অনীহা প্রকাশ করে? কেনই বা জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তা বর্জিত হয় দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? কেন দাবি ওঠে যে, পাঠ্য-পুস্তক থেকে অন্য ধর্মাবলম্বী লেখক-কবিদের লেখা বাদ দেওয়ার? মোটের ওপর, এই প্রশ্নগুলো কারা তোলে এবং কী তাদের উদ্দেশ্য সেটা নিয়েও এই মুহূর্তে জোর আলোচনা হওয়া উচিত। শুধু সরকারকে দোষারোপ না করে নিজেকেই আমরা প্রশ্ন করছি না কেন, ছেলেমেয়েকে আমরা কী শেখাচ্ছি? বা তাদেরকে আসলে ভবিষ্যতে আমরা কী হিসেবে দেখতে চাই? টাকা উপার্জনের মেশিন হিসেবে? নাকি একজন ভালো মানুষ/নাগরিক হিসেবে তাদেরকে গড়ে তুলতে চাই? অনেকদিন আগে একটি লেখায় লিখেছিলাম, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে নীরব যুদ্ধ চলছে, তাহলো মাদ্রাসা শিক্ষা বনাম সাধারণ স্কুলের (বাংলা মাধ্যম) শিক্ষার মধ্যেকার যুদ্ধ। এই দু’য়ের দ্বন্দ্ব নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত লিখা যাবে কিন্তু এখন এটাই বলতে চাইছি যে, একটি দেশে এতোগুলো শিক্ষা-মাধ্যম থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয়। সরকার চাইলেও যে এই মাধ্যমগুলোকে এক করতে পারছে না কারণ আমরা কেউই সরকারের পাশে দাঁড়াতে পারছি না। নুরুল ইসলাম নাহিদ একা চাইলেই এই মাধ্যম-বিতর্ক ঘুচাতে পারবেন না, তাহলে তাকে একা দোষারোপ করে কী হবে? আমরা ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলতেই পারি এবং তুলছিও, কেউ কেউ প্রচারিত রিপোর্টের জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলেমেয়েদের ইতোমধ্যেই ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে স্ট্যাটাসও প্রসব করেছেন, কিন্তু তাতে কি কিছু অর্জন হবে? যতোক্ষণ না আমি/আপনি নিজেই নিজেকে ওপরের প্রশ্নগুলো না করছি এবং তার উত্তর নিজেকে দিতে না পারছি ততোক্ষণ, এই শিশুদের/কিশোরদের আর অপমান না করি, প্রচারিত রিপোর্টটি শেয়ার না করি, সেটাই হবে তাদের প্রতি আমাদের সত্যিকার দায়িত্ব পালন।

নিজের ভুল, অজ্ঞতা এবং অকাজের দায় ও দায়িত্বকে আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের ওপর এভাবে চাপিয়ে দিচ্ছি বলেই একটি জাতি ক্রমশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে, পরিণত হচ্ছে একটি মধ্য-মেধার জাতিতে, যা আমরা বুঝেও বুঝতে পারছি না বা আসলে স্বীকার করছি না। কারণ স্বীকার করলেই যে, দায়টা আমাদের নিজেদের কাঁধেই এসে পড়ে, আর কে হায় সাধ করে দায় নিতে চায়!!

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ