X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জ ইজ অনলি ফর ওসমানস!

আহসান কবির
৩০ মে ২০১৬, ১২:২৯আপডেট : ৩০ মে ২০১৬, ১২:৪৩

আহসান কবির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নাম খানিক বদলে যাবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। নামের আগে পরে ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’, ‘মাওলানা’ কিংবা ‘নারায়ণগঞ্জি’ যুক্ত হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। তার সম্পর্কে এ ধরনের লেখার কারণ হচ্ছে, সেলিম ওসমানকে নিয়ে ইসলামি সংগীত বেরিয়েছে।
এই গান শুনে আমরা জানতে পেরেছি শিক্ষক শ্যামল কান্তির সঙ্গে যারা আছেন, যারা তার জন্য সংহতি প্রকাশ করেছেন, (কান ধরুন আর নাই ধরুন) তারা সবাই নাকি গণ হনুমান! তবে নারায়ণগঞ্জের নাম ( নারায়ণ শব্দটা হিন্দুয়ানি!) এখনও যে বদলে গিয়ে ওসমানগঞ্জ হয়নি, সে কারণে কেউ কেউ উল্লাস প্রকাশ করতেই পারেন!
প্রিয় পাঠক, প্রায় দুই বছর আগে নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার নিয়ে প্রায় একই শিরোনামে একটি লেখা লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের ইশারা ছাড়া গত আট বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৬) নাকি কোনও কিছুই ঘটেনি। মহান সেলিম ওসমানের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পাঠকদের জন্য আরও কিছু তথ্য উল্লেখ করি। যা আগেই লিখেছিলাম—
এক. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পরিবারকে ভালোবাসেন। ২০১৪ সালের জুনে তিনি জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ওসমান পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটা নিবিড় সর্ম্পক ছিল। ওই পরিবারে বসেই জন্ম হয়েছিল আওয়ামী লীগের। শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলী এবং বাবা সামছুজ্জোহা খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ। নাসিম ওসমান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে একটি যুব ব্রিগেড গড়ে তুলছিলেন। পরে জাতীয় পার্টি করলেও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের!

আরও পড়তে পারেন: মামলা তুলে নিতে চিকিৎসকের ‘মাস্টারপ্ল্যান’!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন—‘ওসমান পরিবারকে নিয়ে অনেকেই  সমালোচনা করেন। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি অপরাধ করার পরে অনেকই সেই সব অপরাধীদের নিয়ে লেখেন না। তাদের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই পরিবারের  অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মুক্তযুদ্ধের সময় বারবার এই পরিবারের প্রতি আঘাত এসেছে।

দুই. স্বৈরাচার এরশাদের আয়োজনে ১৯৮৮ সালে মহাতামাশার এক নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন নাসিম ওসমান। এরপর নারায়ণগঞ্জের ডাবল মার্ডার আলোচনার জন্ম দেয়। তারু মিঞা সর্দারের ছেলে কামাল ও কালাম নামের অন্য একজন কোরবানি ঈদের আগের দিনে খুন হন। সবাই তখন ওসমান পরিবারের দিকেই সন্দেহের চোখ রেখেছিলেন। বহু বছর পরে এসে ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যা মামলায় নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরি ওসমানের নাম উঠে আসে এবং অন্তত দু’জন অভিযুক্ত তাদের স্বীকারোক্তিতে আজমেরি ওসমানের জড়িত থাকার ঘটনা ও তার টর্চার সেলের সব ধরনের অত্যাচারের কথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষীকারী বাহিনীকে জানায়! খান সাহেব ওসমান আলি এবং শামসুজ্জোহা সাহেব, যারা আওয়ামী লীগের জন্ম থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের নামে কোনও ধরনের অভিযোগ না উঠলেও নাসিম ওসমান এবং তার ছেলের নামে সন্ত্রাস ও খুনের অভিযোগ উঠেছে। জানি না পানি এবং স্নেহের মতো সন্ত্রাসও ক্রমশ নিম্নগামী কিনা!

তিন. ১৯৯৮ সালে দেশের একসময়ের সর্ববৃহৎ পতিতালয় নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে খুনের ঘটনা ঘটে এবং এর অল্প কয়েকদিনের ভেতরে কোনও রকম পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই রাতের আধারে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হয়। শামীম ওসমান এই উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে খালেদা জিয়া শান্তি চুক্তির প্রতিবাদে দেশব্যাপী লংমার্চের আয়োজন করলে নারায়ণগঞ্জে তার গাড়ি বহরকে আটকে দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন শামীম ওসমান।

চার. এরপর নারায়ণগঞ্জজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন শামীম ওসমান। টেন্ডারবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ সব কিছুতে শামীম ওসমানের জড়িয়ে থাকার খবর ছড়িয়ে পড়লে নামটি ভীতিকর এক নাম হিসেবে কুখ্যাতি পেয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে এমন ভিআইপি সন্ত্রাসের কারণে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয় এবং পহেলা অক্টোবর রাতে বীরের বেশে পলায়ন করেন শামীম ওসমান। ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত (মাঝখানে সামান্য কয়েকদিন বাদে) পুরোটা সময়ে এই বীর পুরুষ দেশের বাইরেই ছিলেন।

দেশে ফিরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কল্যাণে তিনি আবারও নারায়ণগঞ্জে জাকিয়ে বসেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে এমপিও হয়ে যান। মাঝখানে নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে প্রশাসনের সব ধরনের সহযোগিতার পরও তিনি সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনার মূল আসামি নূর হোসেনকে পালাতে সহায়তা করার প্রমাণ সংবলিত একটা টেলিফোন সংলাপও ছড়িয়ে পড়ে, যা দারুণ বিতর্কের জন্ম দেয়!

এবার আবার সেলিম ওসমানের কথায় আসা যাক। ধর্ম নিয়ে যে উস্কানিমূলক কথাবার্তা এই  সংসদ সদস্য বলেছেন, তাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে বাঁধেনি, সেটা আমাদের সাত জনমের ভাগ্য। প্রথম থেকেই তার কথাবার্তা অসংলগ্ন।

এক. মহান সেলিম ওসমান প্রথমে বলেছিলেন পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার পরে লোকজন তাকে ঘিরে ধরে এবং এক দফা পেটায়। এরপর তিনি এসে তাকে কানে ধরে ওঠবস করিয়ে তার জীবন বাঁচান। পরে আবার সেলিম ওসমান বলেন শ্যামল কান্তি স্বেচ্ছায় তার কান ধরে ওঠবস করেছিলেন!

ঘটনার আগের দিন শ্যামল কান্তিকে বহিষ্কার করার চিঠি রেডি রাখা, মসজিদের মাইকের মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ানো ও মানুষকে ডাকা এবং শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে পেটানোর পর  দীর্ঘ সময় এলাকার মানুষ (সেলিম ওসমানের অনুসারীদের দ্বারা) ও পুলিশ দিয়ে শ্যামলকান্তিকে বন্দি করে রাখার সময়েও আর কোনও উত্তেজনা ঘটেনি। সেলিম সাহেব এসে তাকে কানে ধরান। ধর্মের এমন কুৎসিত ব্যবহার অন্য কেউ করলে তার কী পরিণতি হতো, সেটা কল্পনাও করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে ওসমান পরিবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ভালোবাসা পান। অথচ বঙ্গবন্ধুকে অনেক বেশি ভালোবেসেও কাদের সিদ্দিকী আজ ক্ষমতাসীনদের কাছে একরকম শত্রু, তার ভাই লতিফ সিদ্দিকী ধর্ম সংক্রান্ত কিছু কথাবার্তা বলার কারণে মন্ত্রিত্ব হারানোর পর জেলও খেটেছেন! হায়! ব্যক্তিভেদে ভালোবাসাও বিভাজিত হয়!

দুই. সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান আইন প্রণেতা হতে পারেন, সরাসরি আইন প্রয়োগ করতে পারেন না। আইন আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। সংসদ সদস্য যখন বলছেন- শ্যামল কান্তি ধর্ম অবমাননা করেছেন, সেই একই সময়ে সরকারি তদন্ত কমিটি বলছে- শ্যামল কান্তি ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করেছেন, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে স্বপদে বহাল করা হয়েছে, পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের পরিচালনা পর্ষদকে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও সেলিম সাহেব বলছেন তিনি ক্ষমা চাইবেন না, প্রয়োজনে তিনি ইসলামের জন্য ফাঁসিতে ঝুলবেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে থাকা লোকজন নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দিয়েছে। তার মতো এমন সেন্টিমেন্ট নিয়ে তার রাজনৈতিক গুরু এদেশের সেরা লম্পট ও দুর্নীতিবাজদের একজন খ্যাত স্বৈরাচার এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিলেন। এরশাদ হেফাজতের  আন্দোলনের সময়ে তেতুল হুজুরদের পানি খাইয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। এই হেফাজতই এখন সেলিম ওসমানের জন্য মাঠে নেমেছে। তারজন্য ইসলামি সঙ্গীতও বানানো হচ্ছে!!

আরও পড়তে পারেন: জমে উঠেছে দিনাজপুরের লিচু বাজার, দামও নাগালে

তিন. জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ ও সংস্কৃতি এক নয়। সেলিম সাহেব জাতীয় পার্টির এমপি। ১৯৮৮ সালে নাসিম সাহেব যেভাবে এমপি হয়েছিলেন একই কায়দায় ২০১৪’র জানুয়ারিতেও তিনি নির্বাচিত হন। এরপর এক উপ-নির্বাচনে সেলিম ওসমান মনোনয়ন পেলে সেখানে কী রকম ভোট হয়েছিল তা দেশবাসী সবাই জানে। উপ-নির্বাচনে এএসপি বসির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই সেলিম সাহেবের রোষানলে পড়েছিলেন! নারায়ণগঞ্জের এক সাংবাদিকের সঙ্গে সেলিম সাহেবের কথোপকথনের যে অডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, তা শুনলে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়, সেসব কথাবার্তা ছাপাও যায় না। সেই তিনি ইসলামের জন্য ফাঁসিতে ঝুলতে চান, মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন তেতুল হুজুরের দল হেফাজতে ইসলামিকে! ধরাকে তারা তিনভাই (নাসিম, শামীম ও সেলিম) সরাজ্ঞান করতে পারেন। নারায়ণগঞ্জটাকে তারা পকেটের ভেতর ঢুকিয়ে বীরদর্পে হেঁটে বেড়াতে পারেন! প্রধাণমন্ত্রীর ভালোবাসাই কী তাদের এই ধৃষ্টতার বড় কারণ?

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী সারাদেশ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। শিক্ষক শ্যামল কান্তির এই অপমানকে এদেশের মানুষ নিজেদের অসম্মান বলেই ভেবে নিয়েছে। যারা আপনার ভালোবাসা কিংবা সহানুভূতিকে মানুষকে ছোট করার কাজে ব্যবহার করে, অপমান অপদস্থ করার কাজে ব্যবহার করে, ধর্মকে হীন-উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায় আশা করি আপনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

লেখক: রম্যলেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ