X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নরেন্দ্র মোদির দু'বছর

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০২ জুন ২০১৬, ১২:৩২আপডেট : ০২ জুন ২০১৬, ১৪:০০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী দেখতে দেখতে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের পাঁচ বছর মেয়াদের দুই বছর শেষ হয়ে গেল। তার জাতিকে তিনি কী দিতে পেরেছেন তার হিসাব চলছে মিডিয়ায়। গত লোকসভা নির্বাচনে ভারতের ধনবাদী গোষ্ঠীর আদরের প্রার্থী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। বিজেপিকে জেতানোর জন্য ভারতের ধনবাদী গোষ্ঠী ৫/৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিল। বিজেপি গত দুই দশকের মধ্যে ২৮৪টি আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ধনবাদী গোষ্ঠী নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করার কারণ ছিল- গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি ধনবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন রাজ্যটিতে।
বিজেপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স সরকার গঠন করলেও নরেন্দ্র মোদি কোয়ালিশনের কারও চাপের মুখে নেই, কারণ বিজেপি নিজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। সে কারণে নরেন্দ্র মোদি শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, যা কংগ্রেসের মনমোহন সরকারের সময় বেদনাদায়কভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পতিত হয়েছিল।
বিজেপি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কিন্তু রাজ্যসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। যে কারণে নরেন্দ্র মোদি ধনবাদী গোষ্ঠীর ইচ্ছাপূরণের জন্য এখনও কোনও বিল পাস করাতে পারেননি। অবশ্য সাম্প্রতি অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, তামিলনাডু, কেরালা এবং পন্ডিচেরি বিধানসভার নির্বাচনের পর রাজ্যসভায় কিছু হেরফেরও হবে, কারণ আসামের রাজ্য বিধানসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে রাজ্য সরকার গঠন করেছে এবং পশ্চিম বাংলার তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রে ইস্যুভিত্তিক বিজেপিকে সমর্থন প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে।
তামিলনাডুর আন্না-ডিএমকে বিজেপির ন্যাচারাল এলাই। রাজ্যসভার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি হয়তো এখন কিছুটা স্বস্তিবোধ করতে পারবেন। নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী সব রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদেরকে উপস্থিত থাকার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। ভারতের চিরবৈরি রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তখন সবাই মনে করেছিলেন হয়তো নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে নজির স্থাপন করবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া কারো সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সরকার ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। স্থলভূমি বেষ্টিত রাষ্ট্র নেপালের যোগাযোগের সব ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে নেপালকে খুবই কষ্টে ফেলেছিল ভারত। চীন জরুরি ভিত্তিতে বিমানে জ্বালানি তেল না পাঠালে নেপালের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়তো।
এ মাসে নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভাণ্ডারির ভারত সফরের কথা ছিল। হঠাৎ করে সে সফর বাতিল করে নেপাল তার রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির লুম্বিনি সফরও বাতিল করা হয়েছে। ভারত বরাবর নেপালের যে প্রলম্বিত সমতল এলাকা রয়েছে তাতে নেপালিদের চেয়ে ভারতীয়দের বসতি বেশি। ৭০ শতাংশ লোক বিহার থেকে আগত। এদেরকে বলা হয় মধেশি সম্প্রদায়।
নেপালের শাসনতন্ত্র রচনার সময় মধেশি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ভারত যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাতে নেপালিদের মধ্যে ভারত বিরোধী ক্ষোভ প্রবলতর হয়েছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নেপাল সরকার পরিবহনে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে পারেনি। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন এ বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ভারতীয় ও মধেশিদের আচরণে নেপালিরা খুবই ক্ষুব্ধ।
সম্ভবত ভবিষ্যৎ বিবেচনা করেই ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় নেপালের রাজা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে প্রস্তাব করেছিলেন- নেপালের দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের বিষয় ভারতের হাতে রাখার জন্য। কিন্তু নেহরু, পেটেল তাতে সম্মত হননি। এখন এসে দেখা যাচ্ছে ভারত সরকারের আচরণ প্রতিবেশীসুলভও নয় কূটনৈতিক শিষ্টাচারও তাতে নেই।
ভারত চীনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র বলে গণ্য করে থাকে। ভারতের বৈরিতার কারণে নেপাল দিনদিন চীনের নিরাপত্তা বলয়ে নিজের অবস্থান স্থিত করতে হচ্ছে। এটা ভারতের ব্যর্থতা বলা যায়। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও নেপালকে একবার তিন চার মাসব্যাপী অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। কী কংগ্রেস কী বিজেপি- উভয় দলের শাসনে নেপাল যদি বার বার অবরুদ্ধ হতে থাকে তবে তারা চীনের দিকে মুখ ফেরানো ছাড়া তাদের উপায় কি?

আরও পড়তে পারেন: মমতার বিজয় ও মিডিয়ার পরাজয়...
মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক উত্তম নয়। উভয় রাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খুবই ভালো। প্রতিবেশীকে কার সঙ্গে সম্পর্ক কী পরিমাণ রাখতে হবে তার ছবকতো কেউ ভারত থেকে নিতে চাইবে না। বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্র কতদিন সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখতে পারে বলা মুশকিল। অবশ্য নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে ছিটমহল ও সীমানা চুক্তি করেছেন খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে। কিন্তু তিস্তার পানি চুক্তি করতে পারেননি, পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরোধিতার কারণে।
আসামের নতুন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ ক্ষমতায় এসেছেন আসাম থেকে মুসলিম বিতাড়িত করবেন অসমিদের এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তিনি বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রী। মুসলিম বিতাড়নের ইস্যু নিয়ে বাড়াবাড়ি করলেতো বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হবেই। অবশ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো চাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং এ বিষয়ে তারা তাদের কথা কেন্দ্রকে অবহিতও করেছে। বর্তমানে গ্লোবাল রাজ্য-নীতির মেরুকরণের দিকে লক্ষ্য রেখে বাংলাদেশকে চীন, রাশিয়ার সঙ্গে অর্থবহ সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের দেশরক্ষা মন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি বাংলাদেশও সফর করেছেন। এ বিষয়টা ভারত কিভাবে গ্রহণ করে বলা মুশকিল। তারা বলেছে তারা এটি পর্যবেক্ষণ করছে। অবশ্য শেখ হাসিনার সরকার বহুদিন থেকে ভারত চীন, রাশিয়া ও জাপানের সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। গঙ্গার পানি চুক্তির ন্যায্য হিসেব ত্রিশ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশ পাচ্ছে না। ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বলেছেন- ভারতে এবার খরার ছোবল এত প্রবল যে ভারত হিস্যার ন্যায্যতা বিবেচনায় রাখতে পারছে না। আসলে গঙ্গা বাঁধ ছাড়া বাংলাদেশের বিকল্প কোনও পথ নেই।
পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। গান্ধীনগর থেকে দিল্লিতে এসে বুঝেছেন রাজ্য চালানো আর হিমাচল বিস্তৃত ভারত চালানোর মধ্যে কত ফারাক। তিনি জয় চেয়েছিলেন, দেশবাসী তাকে জয়ের নিখাদ স্বাদ পূরণ করে দিয়েছে। কিন্তু তারপর...।
নির্বাচনের প্রচারে তিনি বহু স্বপ্ন জাগরণী কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু দু'বছর অতিক্রম হলো তিনি দেশের অর্থনীতির কোনও হাল ফেরাতে পারেননি। নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, তিনি ভারতীয়দের বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফেরৎ আনবেন। আর তা গরিব মানুষের মাঝে বিলি করে দেবেন। এক পরিসংখ্যানে তখন দেখানো হয়েছিল কালো টাকা ফেরৎ এনে গরিবের মাঝে বিলি করে দিলে প্রতি গরিব লোক মাথাপিছু ১৫ লাখ টাকা করে পাবে। কী চমৎকার বয়ান! এ যাবৎ একটা কালো টাকা ফেরৎ আনতেও পারেননি, কাউকে এক টাকাও দিতে সমর্থ হননি।
নরেন্দ্র মোদির বড় ব্যর্থতা হলো তিনি সংঘ-পরিবারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। পূর্বে গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাকে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হতো না। এখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে জবাবদিহি করতে হয়। ওবামাতো তার লালকেল্লার ভাষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা উল্লেখও করেছেন। ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে বিপণন করতে চাইলেতো ভারতেরই প্রতি ক্ষেত্রের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এ কথাটা এখন নরেন্দ্র মোদি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নরেন্দ্র মোদি কৌশলী হলে তার প্রত্যাশার পূরণের পথে কোনও প্রাচীর সৃষ্টি করতে পারবে না সংঘ-পরিবার।
ভারত শাসন করা খুব সহজ নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে তা বলার চেষ্টা করবো। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে। শিখ, হিন্দু মুসলমান সকলের পাঞ্জাবি ভাষায় কথা শুনলে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু লেখার সময় শিখেরা পাঞ্জাবি ভাষা লিখে গুরুমুখী লিপিতে হিন্দুরা লিখে দেবনাগরি লিপিতে আর মুসলমানেরা লিখে উর্দু লিপিতে। কি অদ্ভুত ব্যাপার। সুতরাং এত ভেদাভেদ যেখানে বিরাজমান সেখানে বহুত্ববাদ ভিন্ন ভারতীয় সমাজটাকে টিকিয়ে রাখাই অসম্ভব। নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির নেতাদের এ সত্যটিকে উপলব্ধির মাঝে রাখতে হবে। অন্যতায় ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ