X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব যোগ দিবস ও আমরা

সালেক উদ্দিন
২১ জুন ২০১৬, ২১:৩১আপডেট : ২১ জুন ২০১৬, ২১:৩৫

সালেক উদ্দিন ২১ জুন হলো ‘বিশ্ব যোগ দিবস’। যোগ-মেডিটেশনের বহুমুখী মনোদৈহিক উপকারিতা বিবেচনা করে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে ২১ জুনকে ‘বিশ্ব যোগ দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রাচীন ভারতের বিশেষ ধরনের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন প্রথা ‘যোগ’-কে তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘যোগ’ ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি অমূল্য উপহার। পাঁচ হাজার বছরেরও আগে থেকে ভারতবর্ষে ‘যোগ’ চর্চা চলছে। ২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাবও দেন তিনিই। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের দিন হিসেবেই এই দিনটিকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সেই বছরই ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২১ জুন তারিখটিকে বিশ্ব যোগ দিবস বলে ঘোষণা করা হয়। অধিবেশনে পৃথিবীর ১৭৫টি দেশ এতে সমর্থন দেয়।
২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব যোগ দিবস’ উদযাপিত হয় মহাসমারহে। দিবসটি উদযাপনকালে মহাসচিব বান কি মুন যোগ মেডিটেশনে অংশ নিয়ে দিবসটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। ওই দিন  শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে সহস্রাধিক মানুষ এবং ভারতের দিল্লীর রাজপথে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ যোগ মেডিটেশনে অংশ নিয়েছিল। কোয়ালামপুর, স্কটল্যান্ড, লন্ডন, ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে যোগ-মেডিটেশনের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হয়।
বাংলাদেশেও দিবসটি সভা সেমিনারের ভেতর দিয়ে পালিত হয়েছিল। নির্ধারিত দিন অতিবাহিত হওয়ার পরে এ নিয়ে আর কোনও কথা শোনা যায়নি। ধারণা করা যাচ্ছে- এ বছরও এদেশে ২১ জুন তারিখে বিশ্ব যোগ দিবসের দ্বিতীয় বর্ষ উদযাপিত হবে। মোবাইলফোনে সরকারি এসএমএস আসবে ‘বিশ্ব যোগ দিবস সফল হোক’। সভা হবে, সেমিনার হবে। গুণীজনরা এ নিয়ে মহামূল্যবান ভাষণ দেবেন। তারপর বিষয়টি এক বছরের জন্য স্তিমিত হয়ে যাবে।
যোগ-মেডিটেশন হচ্ছে মনের ব্যায়াম। সচেতনভাবে দেহ-মন ও মস্তিষ্ককে শিথিল করার প্রক্রিয়া। এতে মানুষের মনোযোগ সচেতনতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি হয়। মনের জট খুলে যায়। হতাশা ও নেতিবাচকতা দূর করে মানুষকে ইতিবাচক করে গড়ে তোলে। মানুষের মনের টেনশন দূর করে। টেনশনের কারণে মানবদেহে যে শতকরা ৭৫ ভাগ রোগ হয় তা যোগ-মেডিটেশনই নিরাময় করতে পারে এবং মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে। অনিদ্রা, হৃদরোগ ডায়াবেটিস ইত্যাদি মারাত্নক রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে বা নিরাময় করে।
যোগ–মেডিটেশন সম্পর্কে আর একটু গভীরে গেলে যা বলতে হয় তা হলো, সাধারণত মানুষ যা ভাবে প্রত্যয় করে তা সে সচেতন মনে করে। সচেতন মনের প্রত্যয় স্থায়ী হয় না। সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যায়। আর যোগী বা ধ্যানীরা মেডিটেটিভ লেভেলে গিয়ে দেহের রোগমুক্তি, নিজের ও অন্যের কল্যাণের জন্যে যা প্রার্থনা করে, যে প্রত্যয় করে তা হয় অবচেতন মনে। অবচেতন মনের চিন্তা চেতনা প্রত্যয় দীর্ঘ স্থায়িত্ব লাভ করে।
শুধু তাই নয়, মেডিটেশন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়ে জীবনের সফলতা আনতে পারে। সমাজকে উপহার দিতে পারে রোগমুক্ত সুস্থপ্রত্যয়ী শৃঙ্খলপ্রিয় অসাম্প্রদায়িক মানুষ।
একটি দেশের জন্য যোগ-মেডিটেশন কার্যক্রম যে কত প্রয়োজনীয় তা উল্লেখ করতে গিয়ে ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগ ও ক্যানসারের পরেই স্ট্রেসের ফলে সৃষ্ট রোগগুলোর পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ হাজার ৪০০ জন মানুষকে নিয়মিত মেডিটেশন করানোর ফলে জনপ্রতি তাদের বাৎসরিক চিকিৎসা-ব্যয় হ্রাস পেয়েছে ৪৩ শতাংশ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যোগ-মেডিটেশনের অপরিহার্যতা বিবেচনা করে এর সুফলকে জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য নানাবিদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ২০১১ সালে যোগ মেডিটেশনের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। নাগরিকদের ওপর যোগ-মেডিটেশনের সার্বিক উপকারিতা দীর্ঘ একবছর যাবৎ পর্যবেক্ষণ শেষে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট-এর সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি দেশব্যাপী মেডিটেশন প্রশিক্ষণের জন্যে ১০ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দের প্রস্তাব পেশ করে। এর পাশাপাশি ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস মেডিটেশনকে মূলধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে সে দেশের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ চিকিৎসক রোগীদের মেডিটেশন প্রেসক্রাইব করছেন। ভারতে যোগ–মেডিটেশনকে আরও উৎসাহিত করার জন্য সে দেশের সরকার যোগ-মেডিটেশনের ওপর পূর্ব-আরোপিত সার্ভিস ট্যাক্স স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা নীতিমালায়ও স্ট্রেস-আক্রান্ত ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের নিয়মিত যোগ, মেডিটেশন, শিথিলায়ন, দমচর্চা ইত্যাদির পরামর্শ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মূলত এ কারণেই আমাদের দেশে পূর্বে মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও সাম্প্রতিক প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট অব্যাহতির সেই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো এখন থেকে যোগ–মেডিটেশন শেখা ও চর্চার কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য ভ্যাট বা অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং মেডিটেশনের মাধ্যমে দেশের মানুষ শারীরিক মানসিক নৈতিক ও আত্মিকভাবে যে উপকৃত হতে পারতো তা থেকে তারা বঞ্চিত হবে।

প্রসঙ্গক্রমে যে কথাটি মনে পড়ছে তা হলো, সাধারণত বিশ্বের উন্নত দেশগুলো কোনও বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল ভোগ করার পর আমরা সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করি। তবে মেডিটেশনের বিষয়টি ছিল উল্টো। মেডিটেশনকে চিকিৎসা সেবার অন্তর্ভুক্ত করে আমরাই প্রথমে মেডিটেশন কার্যক্রম থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম। পরে জাতিসংঘ যখন এটার গুরুত্ব অনুধাবন করে ২১ জুনকে বিশ্ব যোগ দিবস ঘোষণা করলো এবং বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন দেশবাসীর জন্য যোগ-মেডিটেশনের অপরিহার্যতার কথা বিবেচনা করে মেডিটেশন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করছে। মেডিটেশন কার্যক্রম থেকে ভ্যাট ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নিয়েছে তখন আমরাই আবার মেডিটেশনের ওপর প্রত্যাহার করে নেওয়া ভ্যাট এ বছরের বাজেটে নতুন করে আরোপের প্রস্তাব করছি।

শুধু মেডিটেশনের ওপর প্রস্তাবিত ভ্যাট প্রত্যাহারই শেষ কথা নয়। বিশ্ব যোগ দিবসে আমাদের দাবি হলো:

১। সারাদেশে যোগ–মেডিটেশন কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হোক।

২। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ–মেডিটেশন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। এতে শিশুকাল থেকেই ছাত্রছাত্রীরা রোগমুক্ত শৃঙ্খলাপ্রিয় অসাম্প্রদায়িক প্রত্যয়ী হয়ে বেড়ে ওঠবে।

৩। সাম্প্রতিক প্রস্তাবিত বাজেটে মেডিটেশন সেবার ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার এবং এই খাতে স্থায়ীভাবে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হোক। বাজেটে দেশব্যাপী জনগণকে যোগ–মেডিটেশন শিক্ষা প্রদানের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হোক।

৪। দেশে বর্তমানে যারা যোগ–মেডিটেশন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাদের এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকার জন্য পুরস্কৃত করা হোক, যাতে করে তারা এই সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আরও উদ্যোগী হতে পারে। উপহার দিতে পারে সুস্থ প্রশান্ত অসাম্প্রদায়িক প্রত্যয়ী জনশক্তি যা জাতীয় সমৃদ্ধির জন্যে এখন বড় বেশি প্রয়োজন।

৫। মেডিটেশন যেহেতু একটি পরিপূরক স্বাস্থ্য সেবা তাই ভ্যাট বা মূসক আইনের দ্বিতীয় তফসিলভুক্ত করে যোগ–মেডিটেশন কার্যক্রমকে স্বাস্থ্য সেবার মতো সমাজকল্যাণ কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

সবশেষে যে কথাটি বলতেই হয় তা হলো- এই লেখাটি ভ্যাটবিরোধী নয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ভ্যাট আদায়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই ভ্যাট আদায় করতে হবে ভ্যাটের জন্য প্রযোজ্য লাভজনক খাত থেকে, মেডিটেশনের মতো সেবামূলক কার্যক্রম থেকে নয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ