X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলের দাবিতে আন্দোলন, যৌক্তিক-অযৌক্তিক প্রসঙ্গ এবং কিছু গালিবাজ

গোলাম মোর্তোজা
২৪ আগস্ট ২০১৬, ১৫:০৬আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৬, ১৫:১২

গোলাম মোর্তোজা ১৮৫৮ সালে ‘ব্রাহ্ম স্কুল’ হিসেবে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, ২০০৫ সালে তা ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে’র মর্যাদা পেয়েছে। একটি পূর্ণাঙ্গ অনাবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ। ‘পূর্ণাঙ্গ’ শব্দটি লিখলেও, আসলে এটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় নয়। অনেক সংকটের সঙ্গে, জায়গা সংকট প্রকোট। একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিমাণ জায়গা থাকার কথা, তা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। অনেক প্রতিকূলতা সঙ্গী করে চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, অথচ শিক্ষার্থীদের থাকার হল নেই। ভিসি থাকেন ভাড়া বাড়িতে। শিক্ষকদেরও আবাসিক সুবিধা নেই।
এরকম অবস্থায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে হলের দাবিতে। পুরনো ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেওয়ার পর, সেই খালি জায়গায় তারা হল নির্মাণ করতে চায়। হল নির্মাণের দাবি ও প্রাসঙ্গিক আরও কিছু বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা।
১. আজকের যে পুরান ঢাকা, এটাই তো আসল ঢাকা। যা আমরা বহিরাগতরা প্রায় বসবাসের অনুপোযুক্ত করে ফেলেছি। ঢাকা শহরের আয়তন বাড়ানো হয়েছে। পুরান ঢাকার উন্নয়ন হয়নি। পুরান ঢাকার ভেতরে কেন্দ্রীয় কারাগার, এলাকার মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগের কারণ ছিল। কাশিমপুর কারাগারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই। হাজতীর সংখ্যা অত্যধিক হওয়ায়, তা সম্ভব হয়নি। তারপর কেরানিগঞ্জে ৩টি কারাগার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২টি পুরুষ, একটি মহিলা হাজতীদের জন্যে। যার একটি তৈরি হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে।
২. ১৭৮৮ সালে নির্মিত কেন্দ্রীয় কারাগারের মোট জায়গার পরিমাণ ১৭ একর। এই জায়গার মালিক কারা অধিদফতর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি করছে, হল নির্মাণের জন্যে এই জায়গা তাদের দিয়ে দেওয়া হোক।
বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট প্রকোট। যাতায়াতের সংকট তো আছেই। সেই হিসেবে তাদের হলের দাবি অযৌক্তিক নয়। তাদের হল লাগবে, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত বা বিতর্ক নেই। বিতর্ক এসেছে কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গার দাবি নিয়ে। কেন্দ্রীয় কারাগার এখান থেকে সরানোর সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কোনও পরিকল্পনা ছিল না, এখনও নেই।

৩. এরশাদের সময়ে যখন কারাগার সরানোর প্রসঙ্গ আসে, তখন এখানে হাউজিং করার কথা ভাবা হয়েছিল। সে ভাবনা গুরুত্ব পায়নি। এখন এই জায়গা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

ক. বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতার স্মৃতি সংরক্ষণ জাদুঘর থাকবে।
খ. পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারের বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট করা হবে।
গ. ছোট ছোট বেশ কিছু দোকান, পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যের স্যুভেনির শপ থাকবে।
ঘ. থাকবে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা, পার্ক। যা পুরনো ঢাকার মানুষের উপকারে আসবে। পার্কিং থাকবে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ সেখানে যেতে পারবেন।
ঙ. অধিকাংশ এলাকা থাকবে খোলা চত্বর, মানুষের হাঁটা-চলার জন্যে।

৪. পুলিশ এই জায়গাটি চেয়েছিল, তাদের দেওয়া হয়নি। কারা অধিদফতর এই জায়গার এক তৃতীয়াংশ এলাকায় এখনও থাকবে। তারা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করবে, তাদের অফিস থাকবে। যে ভবনগুলো আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করেই ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, অফিস করতে হবে, নতুন ভবন নির্মাণ করতে পারবে না। থাকবে লালবাগ থানাটিও। সংরক্ষণ করা হবে পুরনো ঐতিহ্যবাহী কিছু ভবন। পুরো পরিকল্পনার সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের প্রসঙ্গ আগেও ছিল না, এখনও নেই।

৫. আশেপাশের দশ-বারোটি বাড়ি এক সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এগুলো হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি। কোনোটাই পূর্ণাঙ্গ হল নয়। কালক্রমে এই বাড়িগুলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হয়ে গেছে। দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ হাজি সেলিমদের মতো মানুষেরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষার্থীরা দীর্ঘসময় এই বাড়িগুলো দখলমুক্ত করার চেষ্টা করেনি। দু’এক বছর আগে এই বাড়িগুলো পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করেছিল শিক্ষার্থীরা। দখলকারীরা সরকার দলীয় হওয়ায়, সেই আন্দোলন খুব একটা বেগবান হয়নি।

তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এই বাড়িগুলোর কোনও বৈধ কাগজপত্রও নেই। দখলদাররা ভারতে গিয়ে বংশধরদের থেকে কোনও কোনও বাড়ির কাগজপত্র জোগাড় করে এনেছে, অনেকে জাল কাগজপত্র তৈরিও করেছে। ফলে আদালতের রায়ও দখলদারদের পক্ষে গেছে। সরকার, সরকারি দল, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন- এসব বাড়ি উদ্ধারে কখনই আন্তরিক ছিল না। বাম ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে তারা কখনও আন্তরিকভাবে সমর্থন করেননি।

৬. এখন পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের এই জায়গায় হল নির্মাণের দাবি করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছে, মার্কেট নির্মাণ না করে, শিক্ষার্থীদের জন্যে হল নির্মাণ করে দিতে হবে। মার্কেট নির্মাণের দাবি সত্যি হলে, বিরোধিতা করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে এই দাবিটি সঠিক নয়। মার্কেট নির্মাণের কোনও পরিকল্পনা নেই। এখানে আর একটি বসুন্ধরা বা যমুনা ফিউচার পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে না। এখানে যা নির্মাণ করা হবে, তা লেখায় বলেছি।

প্রশ্ন আসতে পারে, এক তৃতীয়াংশ জায়গা নিয়ে কারা অধিদফতরের থেকে যাওয়া নিয়ে। এখানে এত বড় জায়গা নিয়ে কারা অধিদফতরের ট্রেনিং সেন্টার করা, অফিস করা মোটেই খুব জরুরি নয়। কারা অধিদফতর ট্রেনিং ইনস্টিটিউট কেরানিগঞ্জের নতুন কারাগারের কাছে গিয়ে করতে পারে। এই জায়গাতে শিক্ষার্থীদের জন্যে দু’তিনটি হল করার কথা হয়ত ভাবা যেতে পারে। আমার মতে, এখানেও হল না করে পুরো এলাকা খোলা চত্বর হিসেবে রেখে দেয়াটাই উত্তম।

৭. শিক্ষার্থীদের হলের দাবিতে আন্দোলন করার অধিকার আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিতে চাওয়াটাও গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে জল কামানের ব্যবহার, পুলিশ দিয়ে পেটানো- কোনও সভ্য আচরণ নয়।

কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় হল নির্মাণ করে দিতে হবে, এই দাবির সঙ্গে একমত নই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের হল নির্মাণ করে দিতে হবে, এই দাবি আমাদেরও। সরকারকে তাদের সঙ্গে বসতে হবে, আলোচনা করে তাদের সমস্যার সমাধান দিতে হবে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে আন্দোলন দমন করাটা অত্যন্ত অন্যায়, অনৈতিক। পূর্বাচলে ৫০ একর জায়গার আবেদন করেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সরকারকে এটা খুব দ্রুতগতিতে, আন্তরিকতা নিয়ে ভেবে দেখতে হবে। যে জায়গায় এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেই জায়গায় আদৌ এত বড় শিক্ষা চলতে পারে বলে মনে হয় না। জোর করে নয়, সরকারকে সংবেদনশীতার সঙ্গে আলোচনায় বসে সমাধান দিতে হবে।

৮. হলের দাবির আন্দোলনটি করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নেতৃত্বে আছেন ছাত্র ইউনিয়নসহ আরও কিছু বাম ছাত্র সংগঠন। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘সিপি গ্যাং’ মানসিকতার ছাত্রলীগের কিছু গালিবাজ-চাঁদাবাজ। আন্দোলন বিষয়ে আমার বক্তব্যের পর এই গালিবাজরা সিপি গাং স্টাইলে চরিত্রহননের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। ছবি বিকৃতি, তথ্য বিকৃতি, শত ভাগ অসত্য-প্রপাগান্ডা চালানোর পথ বেছে নিয়েছে। আমার ফেসবুক আইডি ‘ফেক’- এই প্রপাগান্ডা চালিয়ে ফেসবুককে লিখেছে গালিবাজরা, যারা নিজেদের আন্দোলনকারী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে।

গালিবাজদের প্রপাগান্ডায় আমার আইডি দশ-বারো ঘণ্টার জন্যে অচল করে রাখে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। জায়েদুল আহসান পিন্টুর মতো খ্যাতিমান সাংবাদিকদেরও তারা গালাগালি করছে।  

এই আন্দোলন থেকে গালিবাজ-চাঁদাবাজ-সিপি গ্যাংপন্থীদের বিতাড়িত করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের যেমন আন্দোলন করার অধিকার আছে, তেমন আন্দোলনের বিরোধিতা করার অধিকারও আছে। বিরোধিতার জবাব যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেন, গালিগালাজ কেন? কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গাতে নয়, পূর্বাচল বা অন্য কোনও জায়গায় শিক্ষার্থীদের হল করে দিতে হবে- এই দাবি সবারই। কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় কয়েকটি হল করলে, কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর উপকার হবে। খোলা জায়গাসহ যা করতে চাওয়া হচ্ছে, তা করলে এক-দেড় কোটি মানুষের উপকার হবে। আমি এক-দেড় কোটি মানুষের উপকারের পক্ষে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

আরও খবর: ‘মেজর জিয়াই আমাদের বড় ভাই’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ