X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’ ও বাস্তবতা

গোলাম মোর্তোজা
০৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৩:৫৪আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:০৩

গোলাম মোর্তোজা ‘মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অদক্ষতা বা অনভিজ্ঞতার অভিযোগ থাকলেও, দুর্নীতির অভিযোগ নেই’-এটা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের খুব জোরালো বক্তব্য। যখন এই কথা বলা হতো, তখন মানুষের মনে জ্বলজ্বল করছিল বিএনপি-জামায়াত সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ। ‘হাওয়া ভবন’-এর দুর্নীতির সংবাদ দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করেছিল। মূলত এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েই আওয়ামী লীগ জনমানুষের আস্থা অর্জন করেছিল।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল। প্রায় ৮ বছরের এই সময়কালে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের এই বক্তব্য। এখন আর আওয়ামী লীগের কোনও নেতা-মন্ত্রীরা বলেন না যে, দুর্নীতি-অনিয়ম হচ্ছে না। এখন বলেন, ‘যেখানে যা ঘটছে, সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’
আজকের আলোচনা মূলত এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই। সামগ্রিক নয়, আর্থিক খাতের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বোঝার চেষ্টা করব, সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল বা অমিল কতটা!
১. শুরুতেই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। তিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠজন। সাবেক ডেপুটি গভর্নর। সর্বশেষ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সময়েও কৃষি ব্যাংক ধ্বংসের মুখে পড়েছে। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ এই ব্যাংকার ‘সাপ্তাহিক’-এর সিনিয়র রিপোর্টার আনিস রায়হানকে বলেছেন, ‘শতকরা এক বা দেড় ভাগ ঋণখেলাপি হলে তা স্বাভাবিক গণ্য হয়। যদি এটা ২ ভাগ গড়ায় তাহলে ব্যাপারটা আশঙ্কাজনক। ৫ ভাগ হলো পরিস্থিতিটা আতঙ্কের। আর ১০ ভাগ হলে তা ভয়ানক। এখন ১০ ভাগের সীমাও পেরিয়ে গেছে। এটাকে বলতে হবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’
দেশে এখন খেলাপি ঋণ প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১০.৬ শতাংশ। ভারতে যা ৬ শতাংশ শ্রীলঙ্কায় ৪ শতাংশের কম। বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ বা ঋণের নামে লুটপাটের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হিসাবে অবলোপন করা অতিরিক্ত মন্দ ঋণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা ধরলে, চিত্রটা ‘ভয়ঙ্কর’ বা অন্য কোনও শব্দ দিয়ে বোঝানো যায়? খেলাপি ঋণ এবং অবলোপন করা ঋণ মিলালে যা ১ লাখ কোটি টাকার ওপরের একটি সংখ্যা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১৬ বা ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে খেলাপি ৬৪ হাজার কোটি টাকার কিছু ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, অবলোপন করা ৪৪ হাজার কোটি টাকার কিছু অংশও ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর জন্যই ‘অবলোপন’ নামে চালাকি করা হয়।
প্রশ্ন হলো, ব্যাংকিং খাতের এই লুটপাট, অব্যবস্থাপনা ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে গেল কেন? দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই জেহাদ, ৮ বছরে কোথায় হারিয়ে গেল?
২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন করা হয়েছে আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারের বক্তব্য ‘যেখানে যা ঘটছে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’- এক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আমরা জানি না। কেউ জানেন?
২. এক বছরে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে, ব্যাংকিং হিসাব অনুযায়ী ৭৬ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে পাচার হয়েছে, কমপক্ষে ১ লাখ কোটি টাকা। পাচারের এই ধারা অব্যাহত আছে। কিছু দিন পর হয়ত আরও ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া যাবে। তখন এই সংখ্যাটাকে অনেক ছোট মনে হবে।
কেন পাচার হচ্ছে, কে বা কারা পাচার করছে, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ? ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, কোনও নেতা-মন্ত্রীর বক্তব্যও শোনা যায়নি পাচারের বিরুদ্ধে। কারণ কী? দেশ পরিচালনা করছেন, আর দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনও কথা বলছেন না কেন?
৩. ‘হয় ব্যাংকটিকে বন্ধ করে দিতে হবে অথবা এটি পরিচালনার বন্দোবস্ত করতে হবে। ব্যাংকটিকে ভালোভাবে পরিচালনার জন্যেই আমরা ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বন্ড চেয়েছি।’ কথাগুলো বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ। ‘ভালো এবং লাভজনক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল বেসিক ব্যাংক। ২০০৯ সাল থেকে অধঃপতন শুরু হয়। শেখ হাসিনা সরকার এই সময় চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন আবদুল হাই বাচ্চুকে। বাচ্চুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই সময়ে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া হয়, নানা জালিয়াতির মাধ্যমে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘ব্যাংকটিতে (বেসিক ব্যাংক) হরিলুট হয়েছে। আর এর পেছনে ছিল ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। এখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আর কোনও সমস্যা হবে না।’ ‘যেখানে যা ঘটছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’, ‘ব্যবস্থা নিতে সমস্যা হবে না’- কিন্তু কেউ কি শুনেছেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি তাকে বরখাস্তও করা হয়নি, সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকের অর্থে বিত্তবান হয়ে ‘সম্মানে’র সঙ্গেই আছেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু।
৪. জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য হলমার্কের তানভিরসহ কয়েকজনকে জেলে রাখা হয়েছে। বিচার চলছে। টাকা উদ্ধারের প্রায় কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তানভিরের মূল শক্তি সেই ‘উপদেষ্টা’র প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণরূপে আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে। এর নাম ব্যবস্থা নেওয়া?
সোনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখায় কী ঘটেছে অনুমান করতে পারেন? শাখা ব্যবস্থাপক গ্রাহকের থেকে, ব্যাংকের জমা থেকে টাকা চুরি করেছে। ২০১৫ সালে ১৭ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ৫৫ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা।
২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক ইউকের প্রধান নির্বাহী ছিলেন আতাউর রহমান প্রধান। তার সময়েই এসব অপকর্মের সিংহভাগ হয়েছে। এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চান? তাকে পদন্নতি দিয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছে!
‘যেখানে যা ঘটছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’-তাই না?
৫. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট থেকে নাম জানা গিয়েছিল শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির খলনায়কদের। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। ‘উপদেষ্টা’ স্বপদেই বহাল আছেন।
৬. বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা চুরি হয়ে গেল। সম্মানের সঙ্গে গভর্নর পদত্যাগ করে চলে গেলেন। ফিলিপাইনের আন্তরিক তৎপরতায় কিছু অর্থ হয়ত ফেরত পাওয়া যাবে। চোর ধরা বা টাকা উদ্ধারে বাংলাদেশের তৎপরতা বড় আকারের প্রশ্নবিদ্ধ। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে না, কূ-যুক্তি দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরের প্রভাবশালী, যারা চুরির সঙ্গে কোনও না কোনোভাবে সম্পৃক্ত- তাদের বাঁচানোর জন্যেই নাকি রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে না। বিদেশি আইটি কনসালটেন্টদেরও সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এই রিজার্ভ চুরির সঙ্গে। মূলত তাদের বাঁচানোর জন্যই ফরাসউদ্দিনের তদন্ত রিপোর্ট আটকে রাখা হয়েছে। টাকাও উদ্ধার হবে না, চোরদের নামও জানা যাবে না- মুখে বলবেন ‘ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’, আর মানুষ তা বিশ্বাস করবে?
৭. প্রকাশিত খবরের সামান্য কিছু লিখলাম। অপ্রকাশিত আরও বহু ঘটনা রয়ে গেছে। এই যে লাখ-লাখ কোটি টাকা লুটপাট, পাচার হয়ে গেল, এর মালিক জনগণ। সরকার জনগণের টাকার রক্ষক। এই টাকার ভাগ একজন কৃষকের যতটা, একজন মন্ত্রী বা আমলার ভাগও ততটা। লুটপাটের পেছনে তো কৃষকের কোনও দায় নেই। তার টাকা কেন লুটপাট হয়ে যাবে?
প্রবাসের যে কর্মী অমানবিক পরিশ্রম করে অর্থ দেশে পাঠান, তা দিয়ে তো দেশের উপকার হওয়ার কথা। কয়েকজন ব্যক্তি কেন সেই টাকা লুটপাট করে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ কানাডার ‘বেগম পাড়া’ গড়ে তুলবে?
এই সময়ে দেশ তো বিএনপি পরিচালনা করেনি। বিএনপির নেতাকর্মীদের হাওয়া ভবনের দুর্নীতির কথা মানুষ জেনেছিল, বিশ্বাস করেছিল। নির্বাচনে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে মানুষ যে আপন করে নিল, তার কী প্রতিদান দিলেন?
বঙ্গবন্ধু হত্যার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার? হ্যাঁ, খুব ভালো প্রশংসনীয় কাজ। হত্যার বিচার করেছেন বলে, জনগণের অর্থ লুটপাট বিচারের আওতামুক্ত রাখবেন?
বলা হবে, প্রবৃদ্ধির কথা, মানুষের উন্নতির কথা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা। হ্যাঁ, অনেক কিছুই হয়েছে। তার জন্য কতটা কৃতিত্ব সরকারের? সরকারের কোনও কৃতিত্ব নেই, তা নয়। তবে এই কৃতিত্বের মূলত দাবিদার সাধারণ মানুষ এবং বেসরকারি খাত। সরকার উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করেছে।
জনগণের অর্থ চুরি ডাকাতি হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারেনি। চোর ধরতে পারেনি বা ধরেনি। এত বড় বড় লুটপাটের ঘটনা না ঘটলে, যা উন্নতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি উন্নতি হতো। প্রকৃত উন্নয়ন হতো সেটাই।
‘উন্নয়ন’-এর যত গল্প সরকার প্রচার করে, চুরি বা অপচয় বা জালিয়াতি তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ‘ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’- বলবেন আর মানুষ তা বিশ্বাস করবে? মানুষ কি এত বোকা!

 লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ