X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সত্য না অসত্য, কোন পক্ষে থাকবেন?

গোলাম মোর্তোজা
১৪ অক্টোবর ২০১৬, ১০:১৬আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ১০:১৮

গোলাম মোর্তোজা রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ক বিতর্কে ‘তথ্য-উপাত্যে’র উপস্থিতি যেমন আছে, তেমনি ‘বিশ্বাস-আস্থা’ রাখার আহ্বান আছে। অনেকে আবার আছেন মাঝামাঝি অবস্থানে। দু’পক্ষের যুক্তি-তর্কে তারা বলছেন, আমরা তো বিশেষজ্ঞ নই। কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করব!
পরিষ্কার করে বলি, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়টি টেকনিক্যাল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কী প্রভাব জীবন ও পরিবেশের ওপর পড়ে, তা বোঝার জন্যে টেকনিক্যাল জ্ঞানসমৃদ্ধ বিশেষজ্ঞ হওয়াটা জরুরি নয়। আপনি বা আমি পারমাণবিক বোমা বুঝি না, বানাতেও পারি না।
কিন্তু পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা বুঝি। এই বোঝার জন্যে টেকনিক্যাল জ্ঞান বা বিশেষজ্ঞ হওয়া মোটেই জরুরি নয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পরিবেশের ক্ষতি হয় না, উপকার হয়- তা সুস্থ চিন্তার যে কোনও মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব।
এটা একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, বিশেষজ্ঞ হিসেবে যারা পরিচিত তারা কে, কী বলছেন এ বিষয়ে? অতীতে তাদের কার কর্মকাণ্ড কেমন ছিল? তাদের কারা, এখন কী করছেন, কী বলছেন?
এই প্রশ্নের নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব কঠিন নয় যে, কারা সত্য বলেন, সঠিক পথে মানে দেশ ও জনগণের পক্ষে থাকেন, ছিলেন, আছেন। আর কারা অসত্য বলেন, বিদেশি কোম্পানির পক্ষে ছিলেন, আছেন? রামপালের ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়গুলো তথ্য-প্রমাণ দিয়ে লিখেছি। এই লেখায় পুনরায় তা উল্লেখ করছি না। সত্য ও অসত্য বলা বিষয়ক কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি।
১. বাংলাদেশ গ্যাসের উপরে ভাসছে। এত গ্যাস বাংলাদেশের প্রয়োজন নেই। তৎকালীন বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন, ‘মাটির নিচে সম্পদ রেখে লাভ নেই’। তখন এদেশের কিছুসংখ্যক পরিচিত বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, বাংলাদেশের উচিত পাইপ লাইনের মাধ্যমে ভারতে গ্যাস রফতানি করা। কারণ বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আছে, ভবিষ্যতে যা পাওয়া যাবে।

আরেক পক্ষের বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ খুবই কম। নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্যেই যথেষ্ট নয়। কোনও অবস্থাতেই রফতানি করা উচিত নয়।

সরকার এবং বহুজাতিক কোম্পানির হয়ে যারা গ্যাস রফতানির পক্ষে কথা বলছিলেন, তাদের অন্যতম দু’জন বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ম. তামিম এবং অধ্যাপক ইজাজ।

গ্যাস রফতানির বিরোধিতা যারা করছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক বদরুল ইমাম প্রমুখ। প্রমাণ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি যে, বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ সীমিত।

রফতানি করার মতো গ্যাস তো নেই-ই, দেশের চাহিদা পূরণের গ্যাসও নেই।

২. তারপর এলো ফুলবাড়ীর কয়লা প্রসঙ্গ। তখনও সরকার এবং বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির পক্ষে একই ব্যক্তিরা প্রচারণা চালাতে শুরু করলেন। ম. তামিম, ড. ইজাজ এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত সালেক সুফি নামক বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, কেন ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা অপরিহার্য।

বিপক্ষে ড. বদরুল ইমাম, আনু মুহাম্মদরা বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে প্রমাণ হাজির করলেন, কোনোভাবেই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা উচিত নয়।হিসেব দিয়ে দেখালেন, পরিবেশের বিপর্যয় এবং কয়লা উত্তোলন করে যে অর্থ পাওয়া যাবে, কয়লা উত্তোলন না করলে এই জমি থেকে তার চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া যায়।

এশিয়া এনার্জির পক্ষের বিশেষজ্ঞদের কথায় ফুলবাড়ীর মানুষের ওপর সরকার জুলুম করতে শুরু করল। শুরু হলো প্রতিরোধ। গুলি করে মানুষ হত্যা করল তৎকালীন বিএনপি সরকার। তত্ত্বাবধায়ক এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও পৃষ্ঠপোষকতা পেল এশিয়া এনার্জি। এশিয়া এনার্জি (নাম পরিবর্তন করে জিসিএম) লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে, ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প দেখিয়ে। সরকার তাদের কিছু বলে না।

৩. ২০১৬ সালে এসে সরকারের উপলব্ধি হলো, বড় পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না। এতে কৃষি জমি ও জীববৈচিত্র্যের ভয়াবহ ক্ষতি হবে।

বিষয়টি লক্ষ্য করে দেখেন, ২০০৫ সাল থেকে আনু মুহাম্মদরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না, তথ্য-যুক্তি দিয়ে বলে আসছেন। ম. তামিম, ইজাজ, সালেক সুফিরা বলে আসছেন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হবে। আনু মুহাম্মদরা যা ২০০৫ সালে বুঝতে পেরেছেন, সরকার তা বুঝতে পারল ২০১৬ সালে, ১০ বছর পরে। ম. তামিম, ড. ইজাজ, সালেক সুফিরা এখন এ বিষয়ে একদম চুপ।

সরকারের এই বুঝতে পারার আগে প্রায় ৮০৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। বেশ কিছু টাকা খরচও হয়েছে। যারা ‘বিশেষজ্ঞ’ পরিচয় নিয়ে অসত্য বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করলেন, সেই সব বিশেষজ্ঞদের কি জবাবদিহীতার আওতায় আনা প্রয়োজন না?

৫. এই বিশেষজ্ঞরা এখন আবার রামপালের পক্ষে কথা বলছেন। ম. তামিম, অধ্যাপক ইজাজ, সালেক সুফিরা বলছেন, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে সুন্দরবনের কোনও ক্ষতি হবে না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবেশের ক্ষতি হয় না, এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র পৃথিবীতে আজকে পর্যন্ত একটিও নেই। আর এরা বলছেন ক্ষতি হবে না।

যে বিশেষজ্ঞরা গ্যাসের মজুদ বিষয়ে অসত্য তথ্য প্রচার করে গ্যাস রফতানির পক্ষে কথা বলেছিলেন, যারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তাদের কথা আবার দেশের মানুষকে শুনতে হচ্ছে? এই বিশেষজ্ঞদের মতামত ধারণ করছে সরকার? আর জনগণকে বলছে ‘আস্থা’ ও ‘বিশ্বাস’ রাখতে? অতীতে যারা নির্জলা অসত্য বলেছেন, দেশ ও জনগণের সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন, তাদের কথায় জনগণ ‘আস্থা’ রাখবেন? তাদের কথা জনগণ বিশ্বাস করবেন? ফুলবাড়ী থেকে উম্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে, ৯৪% পেত এশিয়া এনার্জি আর ৬% পেত বাংলাদেশ! ভয়ঙ্কর অসম দেশ বিরোধী চুক্তি অনুযায়ী কয়লা উত্তোলনের পক্ষে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞরা!!

তাদের কথা অনুযায়ী কয়লা উত্তোলন বা গ্যাস রফতানি করা হলে, বাংলাদেশের পরিণতি কী হতো? সেই বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। তাদের এই কথা বিশ্বাসযোগ্য? যে সব বিশেষজ্ঞের অতীত অসত্যে পরিপূর্ণ, তাদের কথায় ‘বিশ্বাস’ রেখে সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হবে?

যারা গ্যাসের মজুদ বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন, আপনি তাদেরকে বিশ্বাস করবেন, না যারা সত্য তথ্য দিয়ে জনগণের সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তাদেরকে বিশ্বাস করবেন? যারা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হবে, এই যুক্তি দিয়ে এশিয়া এনার্জির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদেরকে বিশ্বাস করবেন, না যারা এশিয়া এনার্জির বিপক্ষে জনগণের পক্ষে থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলেন তাদের কথা বিশ্বাস করবেন?

এখন কিন্তু সরকারও প্রমাণ পেয়েছে যে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না! অতীতে শতভাগ অসত্য যারা বলেছেন, আপনি কি রামপাল বিষয়ে তাদের বিশ্বাস করবেন, না অতীতে যারা শতভাগ সত্য বলেছিলেন, তাদের সঙ্গে থাকবেন? জনগণ সব সময় সত্যের পক্ষে ছিলেন, আছেন।

৬. বঙ্গবন্ধুর কথা মুখে বলার চেয়ে ধারণ করা জরুরি। ৯ আগস্ট বর্তমান সরকার জ্বালানি ‘নিরাপত্তা দিবস’ পালন করেন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেল কোম্পানির থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা কিনে নিয়েছিলেন। এটা যে কত বড় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল তা, পরবর্তীতে প্রমাণ হয়েছে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট গ্যাস উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ এসেছে এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে। বর্তমান সরকার ৯ আগস্ট জ্বালানি দিবস পালন করলেও, নীতি নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর নীতির সম্পূর্ণ উল্টো। একের পর এক স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্রগুলোও তুলে দেওয়া হয়েছে বিদেশি কোম্পানির হাতে।

৭. এত বছর পরও বঙ্গবন্ধুর অনেক কিছু নতুন করে জানা যাচ্ছে। সুন্দরবন বিষয়ে জানা গেল বঙ্গবন্ধু বক্তব্য-

‘... আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশে দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায় - তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনও উপায় আর নাই।...

- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

[১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধন করেন। সেই উপলক্ষে জনসভায় ভাষণে তিনি এই কথা বলেন।]

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকার তার আদর্শের পরিপন্থী কাজ করবেন, না ভুল স্বীকার করে সঠিক পথে ফিরে আসবেন? বিদেশি কোম্পানির পক্ষের অসত্য বলা বিশেষজ্ঞদের কথায় পরিচালিত হবেন, না ভুল সংশোধন করে সত্য বলা শিক্ষক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ধারণ করে নীতি প্রণয়ন করবেন?

যারা রামপালের বিরোধিতা করছেন, সরকারের মন্ত্রী তাদের সবাইকে বিএনপি-জামায়াত-রাজাকার বলার চেষ্টা করছেন। আমরা তো বটেই, সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বা অধ্যাপক জাফর ইকবালও তাহলে
বিএনপি-জামায়াত-রাজাকার! এরা বামদের জামায়াতের সঙ্গে মিলিয়ে ‘বামাতি’ বলে তিরস্কার করেন। ‘বামাতি’রাও রাজাকার! দেশের প্রায় সব মানুষ রামপালের বিরোধিতা করছেন। তাহলে প্রশ্ন আসে, সবাইকে রাজাকার বানিয়ে দিচ্ছেন, ভালো কথা- তো আপনারা কারা? আপনারা কি ৫%?

৮. যারা বলছেন, কোন পক্ষে থাকব বুঝতে পারছি না! এখানে পক্ষ দুটি একটি ‘সত্য পক্ষ’ আরেকটি ‘অসত্য পক্ষ’। প্রমাণ হয়েছে, একপক্ষ সব সময় ‘সত্য’ বলছেন। এটাও প্রমাণ হয়েছে, আরেক পক্ষ সব সময় ‘অসত্য’ বলছেন। সত্যের না অসত্যের পক্ষে থাকবেন? সিদ্ধান্ত আপনার।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
প্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ