X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়া অগণতান্ত্রিক, অন্যায়

প্রভাষ আমিন
০৭ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:৫৫আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:১০

প্রভাষ আমিন ২২-২৩ অক্টোবর মহা ধুমধামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিল। এ কাউন্সিল থেকে শেখ হাসিনা উন্নয়নের রূপরেখা দিয়েছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে শেখ হাসিনা বিরোধী দলের বিপক্ষে একটি লাইনও বলেননি। না এলেও কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপারসন ও মহাসচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সব মিলিয়ে দারুণ একটা ইতিবাচক আবহ ছিল রাজনীতিতে।
সম্মেলনের দুদিন অচল ছিল ঢাকার একটি বড় অংশ। সম্মেলন উপলক্ষে অক্টোবরজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। অবশ্য এখন গোটা দেশই আওয়ামী লীগের দখলে। সে তুলনায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তেমন কিছু না। বিএনপি অনেক আগে থেকেই বলছিল তারা ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে ৭ বা ৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি অনুমতি পায়নি। কেন পায়নি? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতই একটি নিবন্ধিত, বৈধ, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়, বিএনপি এখন রাজপথে। আওয়ামী লীগ যদি তাদের কাউন্সিলের জন্য প্রায় মাসজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দখল করে রাখতে পারে, বিএনপি একদিনের জন্য অনুমতি পাবে না কেন? প্রতিবাদে যদি বিএনপি হরতাল ডাকে আমরা সমালোচনা করবো, গাড়িতে আগুন দিলে আমরা রুখে দাঁড়াবো। কিন্তু সরকার যদি বিএনপিকে তাদের সবচেয়ে বড় দিবসে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতেও না দেয়, তাহলে বিএনপি করবেটা কী?
আওয়ামী লীগ বিএনপি দুটি আলাদা রাজনৈতিক দল। তাদের আদর্শও আলাদা। যেমন ৭ নভেম্বর নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। গণতন্ত্রে ভিন্নমত তো থাকবেই। সেই ভিন্নমতও প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। ৭ নভেম্বর পালন নিয়ে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে আমারও যোজন যোজন ফারাক। কিন্তু আমি চাই তারা তাদের কথা স্বাধীনভাবে বলার সুযোগ পাক।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই আলোচিত, বিতর্কিত, গুরত্বপূর্ণ এবং জট লাগানো দিন। দিনটি একেকজন একেকভাবে পালন করে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই কার বিপ্লব, কে পালন করে; কার হাসি কে হাসে? বিএনপি দিনটি পালন করে 'জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস' হিসেবে। কিন্তু ৭৫'র ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তখন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দী। এমনকি জিয়াউর রহমান তখন কাগজে কলমে কেউই ছিলেন না। ২৪ আগস্ট মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেও ৩ নভেম্বর ক্যু করে সেনা প্রধান হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজ বাসায় বন্দী হন জিয়া। জান বাঁচাতে জিয়া তখন পদত্যাগ করে পূর্ণ পেনশন দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। ৭ নভেম্বর বিপ্লব হোক, প্রতিবিপ্লব হোক, ব্যর্থ বিপ্লব হোক, হঠকারিতা হোক- করেছে জাসদ। ৭ নভেম্বর তো বিএনপির সাফল্যের দিন নয়, জাসদের ব্যর্থতার দিন, সেটাই ঘটা করে পালন করে বিএনপি। যে সৈনিক জিয়াকে নিয়ে উল্লাস করেছে তারা তো ছিল কর্নেল তাহের-এর অনুগত। রাস্তায় যে জনগণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করে, তারা তো জাসদের কর্মী।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি সেদিন জাসদের বিপ্লব সফল হতো; যদি জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরে সঙ্গে বেইমানি না করতেন, যদি জিয়া তাহেরের স্ক্রিপ্ট ফলো করতেন; তাহলে আজ বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রটা কেমন হতো? আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতো জাসদ, যেমনটা ছিল ৭৫এর আগে, বিএনপির হয়ত জন্মই হতো না। রাজনীতিতে সত্যি শেষ কথা বলে কিছু নেই।

৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ক্যু করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তিনি আর্মি ক্যু করতে চেয়েছিলেন সিভিলিয়ান স্টাইলে। আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার সুযোগে কালক্ষেপণ হয়। বিভ্রান্তি ছড়ায়, গুজব ছড়ায়, ক্যুর শুরুতেই পলায়নপর খুনি চক্র কারাগারে হত্যা করে জাতীয় চারনেতাকে। এই ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে নামে জাসদ, আরও স্পষ্ট করে বললে কর্নেল তাহের। তিনি জিয়াউর রহমানের মাথায় লবন রেখে বরই খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের সৈনিকদের উস্কানি দিতে যতটা পটু ছিলেন, জনসমাগম করতে ততটা নয়। জনগণ জাসদের পক্ষে ছিল না বলেই তাহেরের চেয়ে বেশি চালাক জিয়া বরইটি নিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলেন। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে জিয়া ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অবশ্যই। কারণ তাহের তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা করে ক্যান্টনমেন্টে গোপন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তার বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল 'সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই'। এ ধরনের হঠকারী তৎপরতা সবসময়ই অপরাধ।

জাসদের বিপ্লব সফল হলে কী হতো তা বলা মুশকিল। জাসদ আগে কী অপকর্ম করেছে, পরে কী করতে পারতো, সে আলাদা তর্ক। তবে অফিসারদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লব ভালো কিছু বয়ে না আনারই কথা। আর সিরাজুল আলম খান যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আফিম খাইয়ে ধ্বংস করেছেন একটি মেধাবী প্রজন্মকে, ৭ নভেম্বর কি তার চূড়ান্ত পরিণতি? জাসদের লোকজন কি তা বিশ্বাস করেন? সিরাজুল আলম খানের কি সায় ছিল ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবে? একটা রাজনৈতিক দল মাত্র তিনবছরে কিছু খ্যাপাটে সৈনিকের ওপর ভর করে মধ্যরাতে গুলি ফুটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলবে? ৭ নভেম্বর কি জাসদের বিপ্লব, নাকি স্বপ্নবান কর্নেল তাহেরের ইউটোপিয়ান বিপ্লব বিলাস? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর পাওয়া দায়।

৭ নভেম্বরই জাসদের প্রথম হঠকারিতা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, এমপি হত্যা, থানা লুট, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি ৭ নভেম্বর।

৭ নভেম্বর নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচনা হয় সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়টি নিয়েই। ৭ নভেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিন শ্রেষ্ঠ বীরকে। খালেদ মোশাররফ তো ছিলেন বীরদের বীর। কর্নেল হুদা আর কর্নেল হায়দারের বীরত্বও মুক্তিযুদ্ধের রূপকথার অংশ। খুনি চক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে প্রাণ দেওয়া খালেদ মোশাররফ আজ যেন ভুলে যাওয়া নাম। শেখ হাসিনা ইতিহাসের অনেক দায় মিটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, জেলহত্যা মামলার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। এখন সময় খালেদ-হুদা-হায়দার হত্যার বিচার করার। ইতিহাসের দায় মেটাতে হবে সবাইকেই।
অপরাধের বিচার করতে হবে। তবে রাজনীতির মোকাবিলা করতে হবে রাজনীতি দিয়েই, ক্ষমতায় থাকার সূত্রে পাওয়া প্রশাসনিক গায়ের জোরে নয়। আনুষ্ঠানিক জন্মদিন না হলেও বিএনপির আদর্শিক জন্ম, জিয়ার উত্থান ৭ নভেম্বরেই। তাই দিবসটি পালনে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়া অগণতান্ত্রিক, অন্যায়।

লেখক: অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ