X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফিদেল কাস্ত্রো কি সফল বিপ্লবী?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৩৪আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৫১

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী কাস্ত্রো যখন পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন আর মায়েস্ত্রা পাহাড়ে বিপ্লবীদের নিয়ে কোনও গুহায় আশ্রয় নিতেন তখন কিউবার বিপ্লবী কবি হোসে মার্তির কবিতার এ চরণটি বার বার আওড়াতেন ‘আই-হু-লিড দো আই-হ্যাভ ডাইড’। মরণকে পণ করেছিলেন বলে তিনি নিজেকে মৃত্যুই মনে করতেন। কিউবার বিপ্লবে তিনি জয়ী হয়েছিলেন আর দীর্ঘ নব্বই বছর বেঁচেও ছিলেন।
গত ২৫ নভেম্বর ২০১৬  রাতে হাভানায় তার মৃত্যু হয়েছে। অর্ধশতাধিক বছরব্যাপী মার্কিনিদের অস্ত্র ফিদেলের দিকে তাক করা ছিল কিন্তু তার মাথা মার্কিনিরা কখনও নত করাতে পারেনি। উন্নত শির নিয়েই ফিদেল বিদায় নিলেন। লাল সালাম ফিদেল।
ক্যারিবিয়ানের ছোট দ্বীপ কিউবায় ফিদেলের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট। তার বাবা ছিলেন স্পেনীয়। তার পিতা হেল মারিয়া বউতিস্তা কাস্ত্রো ছিলেন ধনী কৃষক।
সান্তিয়াগোর ক্যাথলিক স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরে তিনি হাভানায় লেখাপড়া করেন এবং আইনে ডিগ্রি নিয়েছিলেন। আইন ব্যবসাও আরম্ভ করেছিলেন তবে আইন ব্যবসায় তিনি সফল হতে পারেননি। তিনি ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগদান করেন এবং পার্টিকে সংগঠিত করার ব্যাপারে বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কিউবান পিপলস পার্টি সর্বাঙ্গীন প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পূর্বে জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করায় নির্বাচনের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালে অস্ত্র লুটের প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অজুহাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পেয়ে তিনি মেক্সিকোতে চলে যান। তখন মেক্সিকো ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিপ্লবীদের সম্মেলনস্থল।
মেক্সিকোতে তখন অবস্থান করছিলেন চেগুয়াভারা। তার সঙ্গে পরিচয় হয় ফিদেলের। তাদের উভয়ের মাঝে বন্ধুত্ব হয়। কিউবাতে বিপ্লব সংগঠনের জন্য এবং জেনারেল বাতিস্তার সরকার উৎখাতের জন্য ফিদেল কাস্ত্রো চেগুয়াভারার সাহায্য কামনা করেছিলেন। উভয়ে ৮১ জন বিপ্লবীকে নিয়ে একটা নৌকায় করে ১৯৫৬ সালে এসে কিউবায় পৌঁছেন।
মাও সে তুং বলতেন কিউবায় আখ চাষি নিয়ে বিপ্লব হবে না আবার সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ধারণা ছিল কিউবায় কোনও সুসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি আত্ম-প্রকাশ করেনি সুতরাং কিউবার বিপ্লব সুদুর পরাহত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিউবায় বিপ্লব হলো। ১৯৫৯ সালে জেনারেল বাস্তিতা ক্ষমতাচ্যুত হলো ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন। চেগুয়াভারাকেও মন্ত্রী করেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো কিন্তু তিনি বেশিদিন মন্ত্রীত্ব করেননি। তিনি পদত্যাগ করে কঙ্গোতে চলে গিয়েছিলেন বিপ্লবের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। পরে বলিভিয়ায় এসেছিলেন।
কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রোদের আন্দোলন ছিল কিছু মধ্যবিত্ত ঘরের সংস্কারপন্থী কিছু কিউবান পেশাদারদের নিয়ে। জেনারেল বাতিস্তার বিরুদ্ধে সাধারণ ঘৃণা তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এরা কমিউনিস্ট ছিল না, ছিল জাতীয়তাবাদী, কিউবার স্বাধীনতার নায়ক জোসে মার্তির অনুসারী, নিকোর, ফিদেল, চেগুয়াভারার রমেলের মতো মার্ক্সবাদীরা অবশ্য নেতৃত্বে ছিলেন।
বহু কিউবান বিপ্লবের পরে কিউবা ছেড়ে ফ্লোরিডায় চলে যায়। তারা যেখানে নিবাস গড়ে তোলে সে এলাকাটার নাম দিয়েছিলো ছোট হাভানা। ফিদেলের মৃত্যুর পর তারা সেখানে বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করেছে।
দিনবদল রংবদলের বিপ্লব ছিল ফিদেলের কিউবার বিপ্লব। ১৯৫৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা ৫৭ বছর তারা ক্ষমতায়। যখন বিপ্লব সংগঠিত হয় তখন ক্যারিবিয়ানের এ ছোট দ্বীপটির লোক সংখ্যা ছিলো ৪৭ লাখ। এখন লোক সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। কিউবার বিপ্লব আর তারা দুই আপন সহোদর ফিদেল আর রমেল কী দিতে পেরেছেন এ হতদরিদ্র লোকগুলোকে। বেলা শেষ তার একটা পর্যালোচনা প্রয়োজন।
ফরাসি বিপ্লবের জন্য সে দেশের জনগণ, সুশীল সমাজ নেতৃবৃন্দ কারওতো ত্যাগ কম ছিল না কিন্তু ফরাসি জনগণ পেয়েছিলো কী? সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের পরবর্তীতে সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপাটকে তারা পেয়েছিলো। এক স্বৈরশাসকের পরিবর্তে আর আরেক স্বৈরশাসক। অথচ ব্রিটেনে তখন কোনও বিপ্লব ছাড়াই ম্যাগনাকাটা গৃহিত হয়েছে, পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজা রানী ব্রিটেনেও ছিল সত্য তবে ক্ষমতা ছিল না মোটেই। সব ক্ষমতার আধার ছিল পার্লামেন্ট।
কিউবার গত ৫৭ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা কী দেখি। ফিদেল ও রোমেল দুই সহোদর ক্ষমতার শীর্ষে এবং তারাই এ ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশটিতে সর্বেসর্বা।  চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে দশবছর পরপর নেতৃত্ব বদলের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কিউবায় তেমন কোনও নিয়ম নেই। ফিদেল পরিপূর্ণ বয়সে চলে গেলেন। যাদের কথা চিন্তা করে ৫৭ বছর আগে বিপ্লব করলেন তাদেরকে কী দিলেন?
তাদের জীবনে কী পরিবর্তন আনতে পারলেন? মার্কিনিদের আমোদগৃহ ছিল কিউবা, তারা আসতো কিউবায় ফূর্তি করার জন্য। সভ্রান্ত পতিতালয় ছিল হাভানায়, রাজবেশ্যারা থাকতো সেখানে। পকেট ভর্তি ডলার আনতো মার্কিনি ধনীরা। সব টাকা মনখুলে ব্যয় করতো বেশ্যালয়ে, কেসিনোতে, শরাবখানায়। জেনারেল বাতিস্তার সরকার চলতো সে টাকায়। সে আয়ের আধুনিক নাম পর্যটনের আয়।
১৯৬১ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলো মার্কিনিদের সঙ্গে। মার্কিন সরকার অবরোধ বসালো কিউবার ওপরে। ১৯৬১ সাল থেকে পর্যটন আয় আর থাকলো না। আখ চাষ হচ্ছে কিউবার প্রধান অর্থকরী ফসল। আখ থেকে চিনি উৎপাদন হয় কিউবা বিশ্বের অন্যতম চিনি রফতানিকারক দেশ। অবরোধের ফলে চিনির বাজার হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন চিনির ক্রেতা শুধু সোভিয়েত রাশিয়া। ভূমি ব্যবস্থার পুনবিন্যাস করলো সত্য কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও প্রত্যক্ষ সুফল পাওয়া গেল না।
অথচ ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যে মার্ক্সবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পর আইন করে ভূমি সংস্কার করেছিলেন। সে সংস্কারের ফলে দুই দশকের মাঝে একটা বৃত্তশালী মধ্যবিত্তের সূচনা হয়েছিলো। খাদ্যের অভাব দূর হয়েছিলো, কৃষিতে বিপ্লব ঘটানোই ছিল পশ্চিম বাংলার মার্ক্সবাদী সরকারের একমাত্র কৃতিত্ব। অথচ কিউবায় এখনও খাদ্যের অভাব রয়েছে উল্লেখ করার মতো অবস্থায়। তার সাফল্যের মাঝে রয়েছে সাধারণের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং শিক্ষার প্রসার।
কিউবার একটা অংশ এখনও মার্কিনিদের অধীন। সেখানে তারা একটা কারাগার স্থাপন করেছে। গুয়াতেমালা বে কারাগারে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মার্কিন বিরোধীদের ধরে এনে এখানেই কারারুদ্ধ করে রাখে এবং অনেককে নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে ফেলে। কিউবার দক্ষিণ পূর্ব অংশেই এ কারাগারটার অবস্থান। মার্কিনিদের অবৈধ এ দখলের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও কখনও ফিদের উচ্চারণ করেননি।
১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছিলো সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে তাক করে। তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে সোভিয়েত রাশিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলো কিউবায়। হাভানা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির অবস্থান ৯০ মাইল দূরত্বে। এমত দূরত্বে মিসাইল স্থাপন করা বিপদজনক। তখন আমেরিকা সাভিয়েতের এ উদ্যোগকে প্রতিরোধ করে দাঁড়িয়েছিলো শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত মিসাইল ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। মিসাইল স্থাপন করতে পারলে হয়ত কিউবার কোমরও শক্ত হত। মিসাইল ক্রাইসিস- এর সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জন এফ কেনেডি আর সোভিয়েতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নিকিতা ক্রশ্বেভ। বিশ্বের বহু জীবিত মনীষীর হস্তক্ষেপে তখন বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলো।
ফিদেল বিপ্লবে সফলকাম হয়েছিলেন সত্য তবে কিউবার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সফলকাম হননি। অবশ্য তিনি ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। যদিওবা তিনি বলিভিয়ায় চেগুয়াভারার জন্য কোনও সাহায্য পাঠাননি। ফিদেলের সাহায্য না পাঠানো আর বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির অসহযোগিতাই চেগুয়াভারার অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী।
ফিদেল যদিওবা অজুহাত হিসাবে সোভিয়েতের নিষেধের কথা বলতেন, এটা আসলে ছিল বামদের হঠকারিতা। আবার অনেকে বলে থাকেন বলিভিয়ায় চেগুয়াভারা সফল হলে ফিদেলের রাজনীতিই খতম হয়ে যেত। সত্যিকার অর্থে ঊনবিংশ শতাব্দীর বলিভার আর বিংশ শতাব্দীর চেগুয়াভারাই ছিলেন ল্যাটিনের সূর্য-সন্তান। উভয়ের চরিত্রে কোনও কলুষকালিমা ছিল না।
দোষগুণ যা থাকুক এখন বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনের আর কোনও উল্লেখযোগ্য নেতা ফিদেলের পরে অবশিষ্ট থাকলো না। চীনে কমিউনিস্ট কাঠামোটা ধরে রেখেছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য। আসলে চীন কমিউনিস্ট আদর্শ থেকে বহুদূরে সরে পড়েছে। সোভিয়েততো গত শতাব্দীর নয় দশকেই নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছে। এখন লাল পতাকা নিয়ে চলার আর কোনও লোক নেই।
প্রগতিশীল উর্দু কবি আলী সরদার জাফরী খুবই সুন্দর ও মর্মান্তিক এক অন্ত্যোষ্টিগাঁথা রচনা করেছেন...
‘আলবিদা সুরখ পরচম, সুরখ পরচম  আলবিদা
আয় নিশান-এ-আযম-এ-মজলুমান এ আলম  আল-বিদা”
(বিদায় হে লালপতাকা, লাল পতাকা হে বিদায়
বিদায় হে জগতের যত নির্যাতিতের নিশান বিদায়)।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ