X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রসফায়ার-গুম-অপহরণ বলে কিছু আছে?

গোলাম মোর্তোজা
০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৪২আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৪৫

গোলাম মোর্তোজা ক্ষমতায় আসার আগে এবং ক্ষমতার প্রথম দিকে শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান ছিল, ক্রসফায়ারের বিপক্ষে। প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীরা তখন বলেছেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ্য করা হবে না।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রীরা বলতে শুরু করেছেন, ‘ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই।’ মন্ত্রীরা আরও বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আক্রান্ত হলে তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ‘গুম বলে আমাদের কোনও কিছু জানা নেই।’
এসব বক্তব্যে সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন স্পষ্ট।
প্রবাদ ‘অন্যের জন্যে খাল কাটলে, সেই খালে নিজের পড়তে হয়।’ প্রতিটি প্রবাদই জীবন অভিজ্ঞতার অংশ, কোনও লেখক-কবির কল্পনা নয়।
বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ২০০২ সাল থেকে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে তৎকালীন বিডিআরকে দিয়ে যে ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল, ২০০৪ সাল থেকে র‌্যাবের হাতে তা ভিন্নমাত্রা পায়। সেই সময় ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতো মূলত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-ক্যাডার -সন্ত্রাসীরা। বাম নেতা-কর্মী-ক্যাডাররাও নিয়মিত ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। অনেক বিএনপি নেতা বা মনোভাবাপন্নরাও ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পুরো সময়কালে জামায়াত-শিবিরের কোনও সন্ত্রাসী-ক্যাডার ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি।তাদের সন্ত্রাসীরা পুলিশ-র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পরও ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি।

বর্তমান সরকারের বিগত কয়েক বছরে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা, শিবিরের অনেক ক্যাডার ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে জামায়াত ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা আওয়ামী লীগ এমনকি বিএনপিকেও দমনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিল ‘ক্রসফায়ার’ পদ্ধতি। ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি তখন জামায়াতের এই কৌশলের কাছে অসহায় ছিল।

সম্প্রতি যুবলীগের ৩ নেতা-কর্মী অপহরণ-হত্যার পর ক্রসফায়ার বিষয়টি আবার একটু ভিন্নভাবে আলোচনায় এসেছে। সেই প্রেক্ষিতে গুম অপহরণ-ক্রসফায়ার হত্যা প্রসঙ্গে কিছু কথা।

১. নাটোর সদর উপজেলার তোকিয়া বাজার থেকে শনিবার রাতে র‌্যাব পরিচয়ে ৩ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ৩ জনই স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাস্তানি-চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। এই ৩ যুবলীগ কর্মীর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় সোমবার, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে।

আওয়ামী লীগের ভেতরে বিশেষ করে নাটোর অঞ্চলের নেতা-কর্মীদের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এই ঘটনায়। নাটোরের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেছেন, ‘এগুলো আমরা সহ্য করতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।’ নাটোরের অন্য তিন এমপিও বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন।

লক্ষণীয়, তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে র‌্যাব পরিচয়ে। র‌্যাব বলেছে, এই ঘটনার সঙ্গে আমরা জড়িত নই। অতীতে যতগুলো অপহরণের ঘটনার সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশ-ডিবির নাম এসেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা বলেছেন, ‘আমরা জড়িত নই, আমাদের জানা নেই’। পরিচিত ইলিয়াস আলী বা চৌধুরী আলম থেকে গ্রামের নিরীহ সাধারণ যুবক পর্যন্ত, একই রকমের অভিযোগ একই রকমের অস্বীকার। কারও লাশ পাওয়া গেছে, কারও লাশও পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিনকে পাওয়া গেছে মেঘালয়ে। অনেক প্রশ্ন সামনে এলেও উত্তর মেলেনি। রেজওয়ানা হাসানের স্বামী দেশি-বিদেশি চাপে ফিরে এলেও, জানা যায়নি কারা অপহরণ করেছিল।

২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে অভিযোগ আসলেই, অবশ্যই তাদেরকে ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা যায় না। উচিতও নয়। কিন্তু তারা একটি অপহরণের পর যখন ‘আমরা জড়িত নই’ বলে চুপচাপ বসে থাকেন, তখন প্রশ্ন দেখা দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতেই পারেন, ‘চুপচাপ’ বসে থাকার অভিযোগ সঠিক নয়। দেশের মানুষও তাই বিশ্বাস করতে চান। কিন্তু ঘটনাক্রম কি তা বলে? অপহরণের একের পর এক ঘটনা ঘটছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে। তদন্ত বা অনুসন্ধান করে বের করা যায়নি, কারা এই ঘটনা ঘটালো বা নিয়মিত ঘটিয়ে যাচ্ছে। কোনও অপহৃত ফিরে আসলে তা চাপা দেওয়া হয়, তদন্ত করা হয় না।

‘আমরা জড়িত নই’এই বক্তব্য খুব বড়ভাবে ধাক্কা খায় নারায়ণগঞ্জে ৭ অপহরণ - হত্যার ঘটনায়। র‌্যাবের বিরুদ্ধে আসা এতো দিনের অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মেলে। আদালতের রায় না হলেও, র‌্যাব সদস্যদের গ্রেফতার-তদন্ত-তাদের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে র‌্যাবের অপহরণ-হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে র‌্যাবের সম্পৃক্ততা এবং অর্থের বিনিময়ে র‌্যাব অপহরণ হত্যা করে বলে জানা যায়।

সব র‌্যাব এমন অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নিশ্চয়ই তা নয়। এমন মন্তব্য অবশ্যই করা যায় না। আবার এত বড় অভিযোগের সত্যতা মেলার পর ‘জড়িত নই’ এই বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতাও থাকে না।

নাটোরের এই ৩ যুবলীগ নেতা-কর্মী হত্যায় এমপি নেতারাও স্পষ্ট করে না বললেও র‌্যাবের দিকেই ঈঙ্গিত করছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিকার চেয়েছেন।

৩. প্রশ্ন হলো, কারও জন্যে আইন কারও জন্যে আইন না- এই নীতি কি বাস্তবায়ন করা যায়? নিজেদের দলের হলে ‘সহ্য করা যায় না’ অন্য দলের হলে ‘সহ্য করা’ যায়? সন্তান বাবার ছবি নিয়ে, স্ত্রী স্বামীর ছবি নিয়ে, বাবা-মা ছেলের ছবি নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসেন। সন্ধান চান তুলে নিয়ে যাওয়া বাবা-সন্তান-স্বামীর। আজ পর্যন্ত কোনও এমপি-মন্ত্রী তো বললেন না ‘সহ্য করা যায় না’।

একটি কথা সব সময় বলি। আবারও বলছি।

বিচ্ছিন্নভাবে কোনও কিছুর উন্নয়ন করা যায় না। তা আইনশৃঙ্খলা দুর্নীতি বা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বা প্রধানমন্ত্রীর জীবনের নিরাপত্তা যাই হোক না কেন।

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক উন্নয়ন বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন- একটি সামগ্রিক বিষয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা না গেলে, কোনও ক্ষেত্রেই দেশ স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ বিমানের উন্নয়ন ঘটানোর পরিকল্পনা না নিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রীর উড়োজাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সিলেটের একটি ফ্লাইট ভুল করে কলকাতায় যেতে পারে না। যায় সচেতনভাবে। ‘ভুল করে’ প্রলেপ দিয়ে ঘটনা চাপা দেওয়া হয়। বড় কোনও চোরাচালান বা এমন কিছু যা আন্তর্জাতিক রুটে করা একটু কঠিন, অভ্যন্তরীণ রুটে সহজ এমন কোনও সমীকরণেই সম্ভবত এমন ‘ভুল’ ঘটনা ঘটে।

রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই এমন ভুলের ঘটনা ঘটছে। এতদিন অন্য দলের নেতা-কর্মীরা গুম-খুন হচ্ছিলেন, আপনারা নিরব থেকেছেন। চাপা উল্লাস করেছেন। এখন নিজের দলের নেতা-কর্মীরা গুম-অপহরণ খুন হচ্ছেন। ‘সহ্য করতে’ পারছেন না।

৪. পৃথিবীর ইতিহাস বলে, সেই একনায়ককেই মানুষ মনে রাখেন যিনি নিজে সৎ এবং সঙ্গী-সাথী-মন্ত্রীদের সততার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য করেন। বাধ্য করেন আদর্শ এবং আইনের শাসনের প্রয়োগ ঘটিয়ে। ফিদেল কাস্ত্রোর মতো বিপ্লবী যা করেছেন আদর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত করে। সিঙ্গাপুরের লিকুয়ান ইউ তা করেছেন কঠোর আইন প্রয়োগ করে। দুর্নীতির অভিযোগের তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিরুদ্ধেও নির্দয় ব্যবস্থা নিয়েছেন।

‘উন্নয়ন’ মানুষের মনে দাগ কাটে না, যদিও না মানুষের জীবন নিরাপদ থাকে। রাস্তা-ফ্লাইওভার-ব্রিজ মানুষের জন্যই। তার আগে মানুষের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার।

তাছাড়া রাস্তা, ফ্লাইভার বা ব্রিজ ‘উন্নয়ন’র প্রতীক নয়। তাহলে মানুষ আইয়ুব খান বা এরশাদকে মনে রাখত। ‘উন্নয়ন’ সেটাই যা মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটায়। ৩০০ কোটি টাকার কাজে যখন ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়, তা আর যাই হোক ‘উন্নয়ন’ থাকে না। রিকশা চালানো মফিজ বা কৃষক রহমান রেপারিও ভাগ আছে এই ১৫০০ কোটি টাকায়।

খরচের নামে লুটপাট করা অতিরিক্ত ১২০০ কোটি টাকার মানিক তারাও।

আর্থিকভাবে তাদের নিরাপত্তা নেই, তার বা তাদের সন্তানের জীবনেরও নিরাপত্তা নেই। ব্যাংক বা আর্থিক খাত লুট হয়ে যাওয়া ‘উন্নয়ন’ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করে না।

৫. ক্রসফায়ারের ইতিহাস বহু পুরোনো। পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বাড়ি আন্দোলন দমনের জন্যে ক্রসফায়ারে হত্যার সূচনা করেছিল ১৯৭৩ সালে পুলিশ অফিসার রণজিৎ গুপ্ত। নাকশাল বাড়ি আন্দোলন নেই। মাওবাদীসহ অসংখ্য আন্দোলন রয়ে গেছে। ক্রসফায়ারের চলছে। ভারতে সমস্যার সমাধান হয়নি।

বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারের বড় ঘটনা ১৯৭৫ সালে ২ জানুয়ারি। এদিন হত্যা করা হয় পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে।

তারপর ক্রসফায়ার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে ২০০২ সাল থেকে। বিরতিহীনভাবে চলছে। বেশ কয়েকজন বড় সন্ত্রাসীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। বিচার করা হয় না, বা যায় না, এই বিবেচনায় দেশের মানুষ ক্রসফায়ারকে সমর্থনও করে বা করেছে। অর্থের বিনিময়ে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ অনেকবার আলোচনায় এসেছে। নারায়ণগঞ্জে এসে যার সত্যতা মিলেছে। শুধু রাজনৈতিক নেতা-কর্মী-ক্যাডার সন্ত্রাসী নয়, সাধারণ নিরীহ মানুষও অপহরণ, গুম বা ক্রসফায়ারের শিকার হচ্ছেন। যারা ক্রসফায়ারের উদ্ভাবন করেছে, যারা এর সুফল ভোগ করেছে বা করবে বলে চিন্তা করেছে, তারা সবাই ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে, হচ্ছে । এখন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল সক্রিয় নেই। এলাকার যত অপকর্ম তার সবই আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনই করছে। তাদের ভেতরে একাধিক গ্রুপ। নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করছে। অর্থের বিনিময়ে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ক্রসফায়ারে হত্যায় ব্যবস্থাও করছে।

‘উন্নয়ন’র মহাসড়ক রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। নাটোরের ৩ হত্যা, জাতীয় জীবনে বা নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে শিক্ষণীয় কোনো প্রভাব রাখবে, বিশ্বাস হয় না।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ