X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাকফায়ার...

শুভ কিবরিয়া
১০ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৩০আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৩১

Shuvo Kibria বন্দুকে গুলি আছে। পছন্দসই টার্গেটও আছে। যখন মন চাইবে তখন ট্রিগার টিপে টার্গেট খতম করা যাবে। এই ভাবনা সব সময় বন্দুকওয়ালাদের থাকে। এই সাহসে ভর করেই বন্দুকওয়ালারা ট্রিগারহ্যাপি নীতি নেন যাদের বন্দুক নাই তাদের প্রতি। সম্ভবত সকল স্বৈরশাসকদের পতন হয় এই ভাবনা থেকেই। তারা ভেবে রাখেন শত্রুপক্ষ আর যাই হোক গুলির মুখে দাঁড়াবে না। হয়তো এই ভাবনা খুব ভুলও না। গুলির মুখে ক’জনই বা দাঁড়াতে পারে! তবে অন্য ঘটনাও বিপাকে ফেলে। সেটা হচ্ছে বন্দুক অনেক সময় ব্যাকফায়ারও করে। এই ব্যাকফায়ার বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেয়। আঘাতটা তাই শত্রুর বদলে নিজের বুকেই আসে। বড় ব্যাপার হচ্ছে এই ব্যাকফায়ার অধিকাংশ সময় বলে কয়ে আসে না।
আচানক আসে এবং অনেক কিছুকেই ওলটপালট করে দেয়। রাজনীতিতে এই ব্যাকফায়ার খুব পরিচিত ঘটনা। বাংলাদেশে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ স্বৈরাচার এরশাদের ক্ষমতাধর মন্ত্রীরা যখন গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে আওয়াজ তুলেছেন দুই নারীর মিলনে কিছুই হয় না তখন পর্দার অন্তরালে ঘুরে যাচ্ছে বন্দুকের নল। যে সামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বন্দুকের নল বুকে ঠেকিয়ে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়েছে সেই ‘সামরিক আমলাতন্ত্র’ ততক্ষণে এরশাদকে ‘না’ বলে দিয়েছে। বেসামরিক মন্ত্রীরা তা টের পান নাই বলে তাদের দাপাদাপি তখনও চলছে। বন্দুকের ব্যাকফায়ার ততক্ষণে এরশাদের মসনদের বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। তারপরে ইতিহাস আমাদের অজানা নয়।
হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের কথা তুললাম কেননা এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতির এর পরের অনেক ব্যাকফায়ারের সাক্ষাৎ অনুঘটক। ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপি যে নির্বাচন করতে পারলো না তার বড় কারণ ছিল এরশাদের নির্বাচনে আসতে না পারা। এরশাদ বিগড়ে গেলো বলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ আন্দোলনে বড় সাথী পেলো। বিএনপি তখন ক্ষমতায় ছিল। তাদের কাছে তখন সবই সম্ভব। ধরাকে তারা শুধু সরা জ্ঞানই করছে না, ধরাই তখন তাদের হাতের মুঠোয় বলে তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস। যা ইচ্ছা তাই তারা করতে পারে বলে তাদের ধারণা। ক্ষমতায় থাকলে যা হয় সেই পুরনো রোগে বিএনপি তখন অন্ধ। তাদের ধারণা সামনের ১৫ বছরও তারা ক্ষমতায় থাকবে। প্রশাসন, টাকা, জণগণ সব তাদের। তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে এই বুকের পাটা কার আছে? কিন্তু না, সেই অবৈধ আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত টেকেনি। ব্যাকফায়ার হয়ে বিখ্যাত ১/১১ এসেছে। তার পরে ঘটনা আমাদের কারও অজানা নাই।
দুই.

রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে অনেক সময় ‘দুষ্টুমি’তে পরিণত করে। নিজে হাতে কিছু না করলেও রাজনীতিবিদরা তাবেদারদের হাত দিয়ে এমনসব জিনিস করায়, তাতে ভাবে সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো। তাদের  সব দুষ্টু উদ্দেশ্য সফল হলো। এই ভাবনাটাও ব্যাকফায়ার করে। করতেই হবে। এখন যেমন আমরা পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন নিয়ে আওয়াজ তুলছি। সরকার নিরুত্তাপ এবং নির্মোহ। পাঠ্যবইয়ে এবার সরকার নানান পরিবর্তন এনেছে। পাঠ্যবইয়ে লেখকের লেখা বদলে ফেলেছে। প্রয়োজনমতো কবিতার শব্দ বদলে দিয়েছে, লাইন বদলে দিয়েছে, কবিতার লাইন ফেলেও দিয়েছে। সরকার প্রধানকে খুশি করতে দেশের মালিকানা ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার স্লোগান পাঠ্যবইয়ের কাভারে লিখে রেখেছে। আঘাত (Hurt) - কে হৃদয়( Heart) বানিয়ে ছেড়েছে। সেসব বর্ণনার বিস্তারে এখন না যাই।

শুধু এটুকু বলি এইসব পরিবর্তন কোনও সুশাসিত নিয়ম মেনে হয় নাই। এইসব পরিবর্তনের সপক্ষে যে সব যুক্তি এখন কর্তাব্যক্তিরা দিচ্ছেন তার একটাও সু-যুক্তি নয়। এসব পরিবর্তন করার আগে যে রুটিন ওয়ার্ক লাগে, যে যোগ্য ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা লাগে, দায়িত্বরতদের কোয়ালিটি টাইম লাগে তার কোনও কিছুই এখানে ছিল না। শুধু তাই নয় এসব পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের মননে কী পরিবর্তন আনবে তার কোনও মূল্যায়নও হয় নাই। বড় দুঃখের কথা এইসব কাজে যে যোগ্য ও দায়িত্বশীল মনিটরিং লাগে তারও বড় অভাব ছিল। ফলে এখন যা হওয়ার কথা তাই হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের টেক্সটের এই সার্জারি বা স্টেনটিং চেষ্টা দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় হৈচৈ শুরু হয়েছে। তার সূত্র ধরে এখন বাংলাদেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও নড়ে চড়ে বসেছে। ফলে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা টেক্সটবুক বোর্ডের কর্তাদের হাত দিয়ে যে উদ্দেশ্যেই বইয়ের টেক্সটে এই পরিবর্তন আনুন না কেন, তা এখন বড়ভাবেই ব্যাকফায়ার করেছে।

তিন.

পাঠ্যবইয়ের এই কাহিনী নতুন নয়। পাকিস্তান আমলেও এরকম চেষ্টা বহুবার হয়েছে। সরকার বাহাদুরের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ চেষ্টায় দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা এরকম যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন তা সরকারকে খুশি করেছে বটে কিন্তু আখেরে তা সরকারের বুকে বড় ব্যাকফায়ার হিসাবেই ফিরে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তান টেক্সট বুক বোর্ডের বাংলা পাঠ্য বইয়ে নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্ ’ কবিতাটি স্থান পেয়েছিল। কবিতার একটা লাইন ছিল এরকম- ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’। তখন পাঠ্যবইয়ে ‘মহাশ্মশান’ শব্দটি কেটে সেখানে লেখা হয়েছিল ‘গোরস্থান’। কিন্তু এইসব প্রচেষ্টা বড় আকারে ব্যাকফায়ার করেছে। শেষাবধি পাকিস্তানি শাসকরাও দুইযুগের বেশি সময়ের মধ্যেই বিতাড়িত হয়েছে। যদিও এর জন্য রক্তে ভাসতে হয়েছে এই ভূখণ্ডের মানুষকে।

কাজেই অযাচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে কোনও মন্দ চেষ্টাই অকল্যাণ বয়ে আনে। আমরা এসব উদাহরণ আমাদের নিত্য দিনের অভিজ্ঞতায় পাই। রাষ্ট্রের জীবনে পাই। ব্যক্তির জীবনেও পাই। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেই না। ক্ষমতা আমাদের অন্ধ করে দেয়। অযোগ্যতা আমাদের বধির করে তোলে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকও এরকম অন্ধ ক্ষমতাদম্ভে শক্তি দেখাতে যেয়ে ব্যাকফায়ারের শিকার হয়েছেন। শ্রাবণ প্রকাশনীর স্টল বইমেলায় নিষিদ্ধ করার বেআইনি সিদ্ধান্ত নিয়ে তা শুধু ফেরত নিতেই বাধ্য হননি যথেষ্ট নাকানি চুবানিও খেতে হয়েছে তাকে। তার মতো প্রশাসন অভিজ্ঞ মানুষের এইরকম ভুল করার কথা নয়। কিন্তু শুধু ক্ষমতার জোরেই তিনি সব ন্যায্যতা ভুলে বসেছেন। আর তাতেই তিনি শিকার হয়েছেন ব্যাকফায়ারের।

চার.

এইসব উদাহরণ টানলাম কারণ আমরা এখন এক সরকারি উন্নয়ন জোয়ারের ভাবনার মধ্যে আছি। কার জন্য উন্নয়ন, কেন উন্নয়ন, কিসের বিনিময়ে উন্নয়ন, সেই হিসাব না তুলেই বড় বড় প্রকল্প নিচ্ছি। সরকার ভাবছে আমাদের চিন্তাই চূড়ান্ত। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নের একটা বড় অংশের ভিত্তি হচ্ছে দায়মুক্তির আইন। এই দায়মুক্তির আইন দিয়ে যে উন্নয়নের জোয়ার আমরা তুলছি তাতে জণগণের সম্মতি আছে কী না তা ভাববার সময়ও এখন আমাদের নেই। এই উন্নয়ন জোয়ারে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাক তাতে আমাদের ভাবনা নেই। এই উন্নয়ন আমাদের চেরনোবিলের মতো পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ফেলবে কী না সেই ভাবনা চুলোয় যাক। আমরা শুধু চাই উন্নয়ন।

বাংলাদেশে এখন এমন অনেক উন্নয়ন মডেল গৃহীত হয়েছে যার সূচনা কারি ছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান। শুধু তাই নয় আমরা সংখ্যাকে গুণের ওপরে জায়গা দিচ্ছি। আমরা ভাবছি কেবলমাত্র সংখ্যায় বাড়লেই উন্নয়ন হলো, গুণগত মানের কোনও দরকার নেই। আমাদের শিক্ষা, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের আবাসন ব্যবস্থা সর্বত্রই এই চিন্তা মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।

পাঁচ.

আমাদের রাজনৈতিক চিন্তায়, উন্নয়ন ভাবনায় আমরা সংখ্যাগত উন্নতির কথাই কেবল ভাবছি, গুণগত মানের কথা এড়িয়ে যাচ্ছি।

এই চিন্তাপ্রসূত কর্মকাণ্ড বড় ধরনের ব্যাকফায়ার করতে পারে। যে রাজনীতি এবং উন্নয়নভাবনা গুণগত মানকে গুরুত্ব দেয় না, মানুষের অনুভবকে ধারণ করে না,  সেই ভাবনাপ্রসূত কাজ মানুষকে সুখি করতে পারে না। অধিকসংখ্যক মানুষের দুঃখের বিনিময়ে তা গুটিকতক ক্ষমতাবান মানুষের ভোগের উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়। এই উন্নয়ন এবং এই রাজনীতি সুদিনের বদলে দুর্দিনে ব্যাকফায়ার করে। তাতে মানুষের দুর্ভোগই বাড়ে কেবল।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশ কাঁটাতারে ঝুলছে: গয়েশ্বর চন্দ্র
বাংলাদেশ কাঁটাতারে ঝুলছে: গয়েশ্বর চন্দ্র
চাঁদপুরে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যায় অভিযুক্ত স্বামী যশোরে গ্রেফতার
চাঁদপুরে স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যায় অভিযুক্ত স্বামী যশোরে গ্রেফতার
নির্বাচনি প্রচারে অন্তর্বর্তী জামিন পেলেন কেজরিওয়াল
নির্বাচনি প্রচারে অন্তর্বর্তী জামিন পেলেন কেজরিওয়াল
‘এভাবে আচমকা গোল হয়ে যাবে, চিন্তাও করিনি’
‘এভাবে আচমকা গোল হয়ে যাবে, চিন্তাও করিনি’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ