X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে আদর্শ গরম পানিতে পোড়ে না...

ড. জোবাইদা নাসরীন
৩১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:৪৮আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০০:০৬

জোবাইদা নাসরীন এক.
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ ও চুক্তি বাতিলের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আহুত হরতালে টিয়ার শেল ছুড়েছে পুলিশ। হরতালের দিন অর্থাৎ শাহবাগে জলকামান আনা হয়। প্রয়োগ হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। হয়েছে লাঠিপেটা। ২০ জন আহত হয়েছেন। এগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক লেখা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হযেছে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলন নতুন নয়। বহু বছর ধরে তারা নৈতিক এবং বাংলাদেশ রক্ষার আন্দোলন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় রামপাল চুক্তি বাতিল সহ সাত দফার দাবিতে ছিল সেদিনের হরতাল। কী আছে এই সাত দফায়? কেন পুলিশের এই আক্রমণ? তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবিগুলো হলো- তেল, গ্যাস ও কয়লাসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে, এজন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। দুর্নীতি নির্ভর ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। দায়মুক্তি আইন বাতিল করা ও খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ করার আইন পাস করতে হবে।
রামপাল ও বাংলাদেশ ওরিয়েন বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সুন্দরবন বিনাশী সকল প্রকল্প বাতিল করতে হবে, বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডের প্রকল্প থেকে সুন্দরবন মুক্ত করতে হবে। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করে সেখানে গ্যাস, বর্জ্য, সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা। ফুলবাড়ী চুক্তি পুনবাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের আবাদি জমি, পানিসম্পদ, জনবসতি, পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়ে খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিতে হবে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বন্দর নিয়ে সরকারের আমলে যে সকল স্বার্থবিরোধী চুক্তি হয়েছে সেগুলো প্রকাশ করতে হবে। তাদের ওপর একই কৌশলে দমন নিপীড়নের চিত্রও নতুন নয়। মনে আছে ২০১১ সালে জুন মাসেও এই রকমভাবে একটি হরতালে একই কায়দায় নির্যাতন, ধর-পাকড় এবং একসঙ্গে অনেকককে গ্রেফতার করে রমনা এবং শাহবাগ থানায় আটকে রাখা হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। এর আগে ২০০৯ সালেও তেল-গ্যাস রফতানির প্রতিবাদে একটি মিছিলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করেছিল। আমরা দেখেছিলাম সেই লাঠিপেটায় লুটিয়ে পড়েছিলেন শিক্ষক আনু মুহাম্মদ। তার পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেদিনও নবগঠিত সরকার বলেছেন- ‘তদন্ত হবে, বাড়াবাড়ি হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। গত ২৫ জানুয়ারির ঘটনায়ও সরকার সেই জল কামান, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে কয়েকজন পুলিশকে ক্লোজড করা হয়েছে। আবার চলছে তদন্ত। এ যেন এক নিত্য রুটিন। সরকারি তদন্তের এক নিত্য সংস্কৃতি।

দুই.

সরকারের নৈতিক আন্দোলন দমন পীড়ন এবং এরপর সেই দমন পীড়নের কারণ ব্যাখ্যা নিয়ে যদু মধু খেলা কাহিনি অতি পুরাতন কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী। আমরা দেখেছি ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের আন্দোলনে পেপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই ঘটনায় সেকান্দার আলী নামে একজিন স্কুল শিক্ষক মারা গেলেন। বাংলাদেশে শিক্ষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই অংশ এবং এটি শিক্ষা আন্দোলনেরই লড়াই। কিন্তু সেই শিক্ষা আন্দোলন রুখতেই দেশে প্রথম বারের মতো ব্যবহার করা হয়েছিল পেপার স্প্রে। যেসকল শিক্ষকরা প্রয়োজনের চেয়ে কখনও উঁচু গলায় কথা বলেন না, দাবি নিয়ে পথে নামেন না তাদের জন্য পেপার স্প্রে?

যেসকল মানুষ হরতালে ভাংচুর করে না, সন্ত্রাস করে না, তাদের জন্য জল কামান, টিয়ার গ্যাস? এখন কথা হলো কোন ধরনের আন্দোলন সরকার দমায়, দমাতে চায় এবং কিভাবে দমায়?

যে সব আন্দোলন সরকার নিপীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে সেই আন্দোলনকারীদের সংখ্যা সব সময় অতি বেশি নয়। কিন্তু নিপীড়নের ব্যবস্থাপনা হয় ভয়ংকর। কারণ সরকার জানে আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় দুশো পাঁচশো হলেও এদের নৈতিক জোর বেশি, শপথের শক্তি বেশি এদের জনসংযোগ বেশি। এদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, চেতনার কা-কা রব নয়, টি শার্ট শাড়িতে রঙ করা চেতনা নয়, মাইকে চেতনার ফেনা তোলা নয়, এরা বোধে, অনুভূতিতে, আদর্শে আর বুক পেতে রক্ষা করতে চায় এদেশের প্রত্যেকটি কণাকেও। এ দেশের মাটি থেকে একটি কণাও কেউ যেন না নিতে পারে। তাই এই নিত্য হামলা, নিত্য প্রতিরোধ।

তিন.

আন্দোলন দমানোর পাশাপাশি সত্যিকারভাবেই দুশ্চিন্তার জায়গা অনেকগুলো। সরকারের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছে? তা না হলে এই ধরনের ঘটনাগুলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সরকার কিভাবে জানেন না? তাদের অগোচরে কে বা কারা সব সময় একটি নির্দিষ্ট কয়েকটি আন্দোলনের বিপক্ষে এই ধরনের ঘটনা ঘটাতেই থাকে? এবং সরকার প্রতিবারেই একই ধরনের অভিনয় করেন। প্রথমবার যখন তারা টের পেলেন তাদের অগোচরে অনেক কিছু ঘটে, তাহলে পরবর্তীতে তারা কেন সেই বিষয়ে সজাগ ছিলেন? আর যদি সরকারের নির্দেশেই এই পুলিশবাহিনী এই রকম ঘটনা ঘটায় তাহলে এটি বুঝতে বাকি নেই দুশো লোকের নৈতিক শক্তি কতখানি। সরকারের দৃষ্টি এই দুশো পাঁচশো লোক দুই বা পাঁচ কোটি হয়তো হয়ে যাবে অচিরেই। হয়তো তাই। আসছে সময় এরই দ্বিগুণ, তিনগুণ কিংবা একশো গুণ হবে। তখনও কি সরকার শুধু কিছু পুলিশকে ক্লোজড করে আর তদন্ত কমিটির রুটিন ঘরে টিক দিয়ে বলবেন, ‘আমিতো এই সবের কিছুই জানি না, আমরাতো এই সবের কিছুই বুঝিনা’। কিন্তু বার বার এটিই ঘটবে, জল কামান আসে, আসে টিয়ার গ্যাস, চলে লাঠি, খোঁজে আন্দোলনকারীদের পা কোমড়, যেন ওঠে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু পুলিশ জানে না বোধের ওপর ভর করেই চলে পা, শরীরের ওপর ভর করে নয়।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ