X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তবু যেন তা মধুতে মাখা

প্রভাষ আমিন
২১ মার্চ ২০১৭, ১৯:২৬আপডেট : ২১ মার্চ ২০১৭, ১৯:৩০

প্রভাষ আমিন বাংলাদেশে এখন দাবি আদায়ের একটা সহজ তরিকা আছে। ঠেকিয়ে দিন। ঠিক পিস্তল ঠেকানো না। তবে তেমনি। মানুষকে যে কোনও উপায়ে জিম্মি করে দিন। যত বেশি মানুষকে জিম্মি করতে পারবেন, কষ্ট দিতে পারবেন; দাবি আদায়ের সম্ভাবনা তত উজ্জ্বল। ড্রাইভাররা এই কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছে। ইন্টার্নি ডাক্তাররাও ড্রাইভারদের অনুসরণ করে সাফল্য পেয়েছেন। সেই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবেন, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট করার দাবিতে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের মেয়েরা অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করছে। সরকারের আশ্বাসে তাদের কর্মসূচি স্থগিত ছিল। পুরনো দাবি নিয়ে আবার নতুন করে মাঠে নামেন তারা। মাঠে নামা মানে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে রাখা। নেমেই নিপুণ দক্ষতায় নগরবাসীকে জিম্মি করে ফেলেন। তাদের দাবি এখনও পূরণ হয়নি। তবে শিক্ষামন্ত্রীসহ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। তাদের আন্দোলন যৌক্তিক না অযৌক্তিক, সেটা আলাদা বিবেচনা। তারা তাদের দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতে পারতেন, ভিসির বাসার সামনে অনশন করতে পারতেন। তা না করে তারা ড্রাইভার আর ডাক্তারদের সাফল্যের সূত্র অনুসরণ করেছেন।
তাদের আন্দোলনের তৃতীয় দিনে আমার অফিসে দুটি মিটিং ছিল। কিন্তু রাস্তায় নেমেই আটকে যাই ছাত্রী আন্দোলনের গ্যাড়াকলে। অবরোধ হচ্ছে নীলক্ষেত মোড়ে। আর অবরুদ্ধ হয়েছে গোটা ঢাকা। ঢাকার যানজটের একটা স্নোবল অ্যাফেক্ট আছে। এক জায়গায় লাগলে তা গড়াতে গড়াতে ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। আস্তে আস্তে লেগে যায় ‘আন্ধা গিট্টু’। আমার বাসা থেকে অফিস বড় জোর ২০ মিনিটের হাঁটার রাস্তা। কিন্তু ব্যাকপেইনের কারণে ইদানিং হাঁটা একটু কষ্টকর বলে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর দুটি মিটিং মিস করে শেষ পর্যন্ত খেজুর বাগান মোড় থেকে হাঁটা শুরু করি। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি চারদিকে যানজটের ‘আন্ধা গিট্টু’। অসহায় ট্রাফিক পুলিশের জন্য মায়াই লাগছিল। দেখলাম একজন অন্ধ ব্যক্তি ট্রাফিক পুলিশের কাছে জানতে চাইছে, ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতালটি কোন দিকে? ট্রাফিকের আসলে নিজেরই অন্ধ হওয়ার দশা, অন্ধের ডাকের সাড়া দেওয়ার উপায় ছিল না তার। আমি হাত ধরে অন্ধ ব্যক্তিটিকে হাসপাতালে পৌঁছে দিলাম। আমি জানি, ঢাকায় এখন সুস্থ মানুষেরই হাঁটা মুশকিল, অন্ধ মানুষের জন্য তো প্রায় অসম্ভব। হাঁটতে গেলে কখন আপনি কোন ম্যানহোলে গায়েব হয়ে যাবেন, টেরই পাবেন না। সাদা ছড়ি হাতের সেই অন্ধ মানুষটিকে হাসপাতালে পৌঁছে নিজে হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম, আমারও একটি সাদা ছড়ি দরকার ছিল। ফার্মগেট পার্ক পেরিয়েই পড়লাম অথৈ সাগরে। ইন্দিরা রোডের এক পাশের ফুটপাত কাঁটা, আরেকপাশে বাজার। অথৈ সাগর পেরুতে হলে সাঁতরাতে হবে মাঝ রাস্তা দিয়ে। ফার্মগেট ওভারব্রিজ পেরিয়ে দেখি একই দশা। ফার্মগেট থেকে কারওয়ানবাজার পর্যন্ত ফুটপাত গায়েব। হাঁটতে হলো রাস্তার ওপর দিয়ে।

শুধু ইন্দিরা রোড বা ফার্মগেট নয়, গোটা ঢাকাই এখন ক্ষতবিক্ষত। যে এলাকায় ফুটপাত ভালো, সেখানে তা মোটর সাইকেল লেন বা দোকানদারদের শোরুমের এক্সটেনশন। পত্রিকায় পড়েছি, ঢাকার অন্তত ৫০০ জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ঢাকার রাস্তায় চলতে গেলে আমার খালি খন্দকের যুদ্ধের কথা মনে হয়। ইসলামের ইতিহাসের অনেকগুলো যুদ্ধের মধ্যে কৌশলের দিক দিয়ে খন্দকের যুদ্ধ অনন্য। শত্রুপক্ষের হামলা থেকে মদিনাকে রক্ষা করতে হযরত মোহাম্মদ (স.) শহরের চারপাশে পরিখা বা খন্দক খনন করেছিলেন। ঢাকায় এখন যেন যুদ্ধাবস্থা। শহরজুড়ে চলছে নির্বিচার খনন। রাস্তা, ফুটপাত সব খোলা। ম্যানহোলে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েই হাঁটতে হয় সবাইকে। নিশ্চয়ই শহরকে আরও সুন্দর, আরও বাসযোগ্য করতেই এত আয়োজন, এত খোঁড়াখুঁড়ি। অনেকেই বলছেন, এসবই উন্নয়নের প্রসব বেদনা। কিন্তু প্রসবের জন্যও তো কিছু নিয়ম-কানুন আছে, নির্দিষ্ট সময় আছে। নিশ্চিত করতে হবে, বেদনা যতই হোক, প্রসূতি যেন বেঁচে থাকে। কিন্তু ঢাকায় চলতে গিয়ে যে আমাদের নাভিশ্বাস দশা। যেমন মগবাজার ফ্লাইওভার শেষ হওয়ার কথা ২০১২ সালে। কিন্তু কবে শেষ হবে কেউ কি আদৌ জানেন? কদিন আগে মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার চাপা পড়ে এক শ্রমিক মারা গেছেন। কিন্তু ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের জন্য মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁওয়ের বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর তিলে তিলে মরছেন। সেখানে একজন শ্রমিকের মৃত্যু নিছক প্রতীকী মনে হতে পারে। এই এলাকার অবস্থা এতটাই খারাপ আমার মতো কেউ চাইলেও গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করতে পারবেন না। কারণ সে এলাকায় হাঁটার কোনও উপায় নেই। আর একটু-আধটু বৃষ্টি হলে পুরো এলাকা পরিণত হয় নরকে। এই এলাকার মানুষ সামনের বর্ষাকাল নিয়ে এখন রীতিমত আতঙ্কে আছেন।

শুরুতেই যানজটের কথা বলেছি। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের মেয়েরা রাস্তায় থাকুক আর থাকুক যানজট ঢাকার নিত্যদিনের চিত্র। কোনোদিন বেশি, কোনোদিন কম। কিন্তু ঈদের ছুটির সময় ছাড়া ফাঁকা ঢাকা এখন কষ্ট কল্পনা। এমনকি ছুটির দিনের মধ্য রাতেও ঢাকার কোথাও কোথাও যানজট থাকে। আসলে ঢাকার সমস্যার অন্ত নেই। প্রতিদিনই কোনও না কোনও পত্রিকায় ঢাকার নানা সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট থাকে। কোথাও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। কোথাও গ্যাস নেই। রাস্তায় হাঁটতে গেলে বিকট হর্নে কানে তালা লেগে যায়। ধোয়া আর ধুলায় শ্বাস নেওয়াই দায়। সমস্যার কোনও অন্ত নেই।

গত সপ্তাহে একটা রিপোর্টে দেখলাম, বসবাসের যোগ্য তার দিক দিয়ে বিশ্বের ২৩১টি নগরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২১৪তম। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মার্সার এ তালিকা প্রকাশ করেছে। ওপরে যা বললাম, তাতে এই তালিকাকে বিশ্বাসযোগ্যই মনে হবে। কিন্তু হতে পারতো উল্টো। ঢাকা হতে পারতো বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বাসযোগ্য নগরী। চারপাশেই নদী, আর বুকজুড়ে জালের মতো খাল; এমন শহর বিশ্বেই বিরল। কিন্তু খালগুলো আমরা অনেক আগেই গিলে খেয়েছি। নদীগুলোকে গলা টিপে মারছি। সবার চোখের সামনেই ঘটছে এই অন্যায়। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পারি। কিন্তু বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী বাঁচাতে পারি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবশ্যই আমাদের অভিশাপ দেবে, অবশ্যই দেবে। আমরা যেমন দিচ্ছি আগের প্রজন্মকে। অথচ দেখুন এক টুকরো হাতিরঝিল কেমন পাল্টে দিয়েছে ঢাকার চিত্র। হাতিরঝিল আমাদের আফসোস বাড়ায় শুধু। এক হাতিরঝিলেই যদি ঢাকাকে এমন প্রাণবন্ত লাগে, সবগুলো খাল থাকলে আর নদীগুলো প্রবহমান হলে কেমন হতে পারতো। আহারে।

পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে চারশ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। যে পুরান ঢাকা থাকতে পারতো পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রে, সেই পুরান ঢাকা এখন ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বাস অযোগ্য এলাকা। শত বছরের পুরনো যে ভবনগুলো সংরক্ষিত থাকার কথা, রাতের আঁধারে সেগুলো ভেঙে বহুতল ভবন করা হচ্ছে। পুরান ঢাকা করার সময় না হয়, অত কিছু ভাবার উপায় ছিল না। কিন্তু নতুন ঢাকা যে দ্রুত বাড়ছে, তাও তো সেই পুরান ঢাকার মতো অপরিকল্পিতভাবেই। ধানমণ্ডি বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে দ্রুতই। যেভাবে সব খাল ভরাট করে, জলাভুমি ভরাট করে আমরা আবাসন করছি, তাতে ভবিষ্যতে হয়তো বর্ষাকালে ঢাকা বদলে যাবে ভেনিসে।

ঢাকাকে বাস অযোগ্য করার জন্য আমরাই দায়ী। নতুন মেয়ররা এসে নতুন ডাস্টবিন লাগালেন। অথচ আমরা ময়লা ফেললাম পাশে। আর কদিনের মধ্যেই ডাস্টবিনসহ গায়েব। ঢাকায় এখন চমৎকার সব পাবলিক টয়লেট। মেয়ররা বানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারা তো আর ব্যবহার করবেন না। আমরাই করবো। আমাদের যা স্বভাব। এই পাবলিক টয়লেটগুলো কতদিন ব্যবহারযোগ্য থাকবে, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সংশয় আছে। এ সংশয়ের দায় অবশ্য জনসংখ্যার চাপ। ঢাকার জনসংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা এরচেয়ে অনেক কম।

আমি দায়ী না আপনি দায়ী, মেয়র দায়ী না কাউন্সিলর, আগের প্রজন্ম না পরের প্রজন্ম; এইসব দায় এড়ানোর কৌশল দিয়ে কালক্ষেপণ করা যাবে; ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। কাজ করতে হবে যার যার জায়গা থেকে। আগামীকাল থেকে নয়, কাজটা শুরু করতে আজ থেকে, আসলে কাজটা করা উচিত ছিল গতকাল থেকে।

এত যে সমস্যা, তবু ভালোবাসি ঢাকা। এত শঠতা, এত যে ব্যথা; তবু যেন তা মধুতে মাখা। এই শহরের অলিতে গলিতে আমার নির্মাণের, ভাংচুরের নানান গল্প। ২৯ বছর ধরে বাস করছি প্রায় বাস অযোগ্য এই শহরে। কোনও একদিন আবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি বটে। কিন্তু এখন ৪/৫ দিন বাইরে থাকলেই ঢাকার জন্য প্রাণ হাসফাস করে। ঢাকা আসলে নেশার মতো, ভালোবাসার নেশা। ঢাকার ফুটপাতের ফুচকা এখনও সুস্বাদু। পুরান ঢাকার নানান মোগলাই খাবার এখনও জিবে জল আনে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের গগনশিরীশের সারি এখনও মন বিষন্ন করে দেয়। ঝুম বর্ষায় প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে রিকশায় ভিজতে মন এখনও আকুপাকু করে। মানিক মিয়া এভিনিউর পামের সারির মাথায় যখন উঁকি মারে পূর্ণিমার চাঁদ, ঘরে থাকাই দায়। ইট-কাঠ-কংক্রিটের এই জঙ্গলেও রমনা পার্ক, ধানমণ্ডি লেক, চন্দ্রিমা উদ্যান, বদধা গার্ডেন, বোটানিকেল গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখনও দুদণ্ড স্বস্তি দেয়।

বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই নানা উসিলায় ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বাসযোগ্য শহরে থিতু হয়েছেন। আমি কখনও চেষ্টাই করিনি। আমার খালি গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছা করে, তোমরা যেখানে খুশি চলে যাও, আমি রয়ে যাবো এই বাংলায়, এই বাস অযোগ্য ঢাকায়।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ