X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাকি সব পুরুষের!

হারুন উর রশীদ
৩০ মার্চ ২০১৭, ১১:৫২আপডেট : ৩০ মার্চ ২০১৭, ১২:৪২

হারুন উর রশীদ মন্ত্রিসভা একটি আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। আর তাতে বলা হয়েছে গণপরিবহণে নারীদের জন্য নির্ধারিত আসন কেউ দখল করে রাখলে তাকে জেল জরিমানার শিকার হতে হবে। এই জেল জরিমানার বিধান ঠিক কিনা অথবা দণ্ডের পরিমাণ বেশি হলো কিনা সেটা নিয়ে এখনও আমি কোনও বিতর্ক দেখিনি। দেখেছি প্রশ্ন। আর প্রশ্নটি হলো নারী যদি পুরুষের আসনে বসে তাহলে তার কী শাস্তি হবে?
এই প্রশ্নের পেছনে একটি যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন প্রশ্ন কর্তারা। আর তা হলো গণপরিবহণে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের বাইরের সব আসন পুরুষের! এই ধারণা আমি শিক্ষিত, প্রগতিবাদী এবং সংস্কৃতিবান পুরুষের মধ্যেও দেখেছি। তাদের সবার ধারণা নারী শুধু সংরক্ষিত আসনেই বসতে পারবেন। অন্য আসনে নয়। ওই আসনগুলো সব পুরুষের। আর এই ধারণা বা চিন্তা থেকেই তারা প্রশ্ন করছেন, জানতে চাইছেন পুরুষ আসনে নারী বসলে কোনও শাস্তি হবে কিনা।
তাদের চিন্তার এই সারল্য(?) আমাকে মুগ্ধ করেনি। বিস্মিত করেছে। আর তাদের এই প্রশ্নকে আমি সরল চিন্তা বললেও কেউ যদি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা বলেন তাহলেও দোষের কিছু হবে বলে আমার কাছে মনে হয় না।
সেটা বিশ্লেষণের আগে আমি তাদের একটা প্রশ্ন করতে চাই। গণপরিবহণে পুরুষের জন্য কি কোনও সংরক্ষিত আসনের বিধান আছে? নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বাইরের আসনগুলো কি শুধুই পুরুষের?
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত:

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’ নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই আইনের একটি অংশ হলো, ‘গণপরিবহণে নারী, শিশু, বয়জ্যেষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে তাদের বসতে না দিয়ে অন্য কেউ ওই আসনে বসলে তিনি এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

বলা হয়েছে, ‘সারাদেশে গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান থাকলেও এর সুফল সংশ্লিষ্টরা পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে গণপরিবহনে নারী, শিশু, বয়জ্যেষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের আসন নিশ্চিত রাখতে 'সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’-এর খসড়ায় কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে সরকার। 

প্রস্তাতি আইন যেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে-

১. গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের আসন সংরক্ষিত থাকলেও তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

২. সংরক্ষিত আসনে তাদের বসতে না দিলে জেল জরিমানা। সংরক্ষিত আসনে অন্যরা বসলেই জেল জরিমানা নয়, দখল করে রাখলে জেল জরিমানা হবে।

৩. এই সংরক্ষণ শুধু নারীর জন্য নয়, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্যও।

গণপরিবহনে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখার বিধান আছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাস্তবে নারীরা সংরক্ষিত আসনে বসার সুযোগ তেমন পান না। আমরা প্রায়ই অভিযোগ শুনি পাবলিক বাসে নারীদের উঠেতেই দেওয়া হয় না। হেলপার গেট থেকেই বলে দেন ‘মহিলা সিট খালি নাই’। পুরুষ যাত্রীরা সিট দখল করে আর উঠতে চায় না বলেই কি বাসের হেলপার এরকম কথা বলেন!

এটা আমার কথা নয়। বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম দেখলেই তা স্পষ্ট হবে।

১. সংরক্ষিত শুধু লেখায়, বসতে গেলেই বিপত্তি।

২. গণপরিবহনে নারীর দুর্ভোগের শেষ নেই।

৩. নারীর পথের হেনস্থার শেষ কবে?

৪. গণপরিবহনে বিড়ম্বনায় নারীরা, আসন সংরক্ষণের শর্ত লঙ্ঘিত।

৫. পুরুষ যাত্রী ও হেলপাররা মিলে হয়রানী করে নারীদের।

এরকম শিরোনামের উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যাবে। আর নারীদের জন্য যে আসন কিছু গণপরিবহনে লেখায় সংরক্ষণ করা হয় তা গাড়ির সামনে ইঞ্জিন কাভারের পাশে তপ্ত আসন। উপায় না থাকলে গরমে কেউ বসতে চান না।

আসন সংরক্ষণের বিধান

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গণপরিবহণে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়। সেসময় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা গোলাম কাদের গণপরিবহনে নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের জন্য বিআরটিএকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে সিদ্ধান্ত হয় বড় বাসে ৯টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে।

আর বলা হয়, সংরক্ষিত আসন চালকের পেছনের দিকের সারিতে থাকতে হবে। চালকের পাশের লম্বা আসন (ইঞ্জিন কাভারের পাশে) কিংবা দরজার পাশে নয়। সংরক্ষিত আসন লিখে দিতে বলা হয়। আসন সংরক্ষণের এই শর্তকে গণপরিবহনের রুট পারমিটের শর্ত হিসেবে তখন অন্তভূক্ত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ গণপরিবহন এটা মানে না। না মানার অপরাধে কোনও গণপরিবহণের রুট পারমিট বাতিল হয়েছে বলে আমরা এখনও শুনিনি।

তাদের প্রতিক্রিয়া

সংরক্ষিত আসন কেউ দখল করে রাখলে জেল জরিমানার বিধান নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে সোমবার খবর প্রকাশ হলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। আর সেই খবরে ফেসবুক ব্যবহারকারী পুরুষদের একাংশ কী ধরনের মন্তব্য করেছেন তা একবার দেখি।

১. বাবা, ভাই বা স্বামীর সঙ্গে নারীরা এখন থেকে আর পুরুষ সিটে বসতে পারবেন না। 

২. পুরুষ সিটে মহিলা বসলে কি করবো আমরা?

৩. এর চেয়ে কত আর্জেন্ট ঘটনা আছে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

৪. মহিলারা পুরুষ আসনে বসলে তাদের কি শাস্তির দেওয়া হবে?

৫. পুরুষ আসনে নারী বসলে কয় বছরের কারাদণ্ড/কত লক্ষ টাকা জরিমানা?

৫. ম্যালেরিয়া রোগীকে চুলকানির মলম দেওয়ার মতো অবস্থা আর কী!

৬. নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বাদে আর সবতো পুরুষের আসন।

শেষের মন্তব্যটির অসারতার বিষয়টি নিয়েই আগে কথা বলি। কোনও কোনও পুরুষ মনে করছেন যে, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছাড়া বাকি সব আসন পুরষদের। তাদের চিন্তার এই ধরন দেখে আমার মনে হয়েছে তারা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন। সে কারণে স্বাভাবিক বুদ্ধি প্রয়োগেও ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ গণপরিবহনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও পুরুষদের জন্য কোনও সংরক্ষিত আসন নাই। এর মানে হলো- নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বাইরে যে আসনগুলো আছে তা সাধারণ বা কমন আসন। ওই সব আসনে নারী-পুরুষ সবাই বসতে পারবেন। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। সুতরাং ওই আসনগুলো পুরুষের আসন দাবি করাকে অজ্ঞতা না মূর্খতা কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না। আর এই ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে কেউ কেউ নারীদেরও জেল জরিমানা দাবি করে বসে আছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে যে মন্তব্যগুলো এখানে প্রকাশ করেছি তাদের নাম দেইনি সঙ্গত কারণেই। কিন্তু তাদের মধ্যে উচ্চ ডিগ্রিধারী লোকজনও আছেন। এরমধ্য দিয়ে নারীদের ব্যাপারে আমাদের সমাজের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি আবারও স্পষ্ট হলো। পুরুষদের একটি অংশ এখনও যে নারীকে মানুষ ভাবতে পারে না তা বোঝা গেল। তারা নারীদের গণপরিহনে উঠতে দিতে চায় না। পারলে নারীমুক্ত গণপরিবহণ দাবি করে বসত। কেউ কেউ সেকথা ঘুরিয়ে বলেছেনও। তারা বলেছেন, ‘এত ঝামেলা করার কী দরকার? নারীদের বাস আলাদা করে দিলেইতো হয়।’ তারা নারীকে দেখছে ঝামেলা হিসেবে!

নারীদের আসনে বসা নিয়ে জেল জরিমানার খবর প্রকাশে সংবাদ মাধ্যমের খবরের শিরোনামেও একধরনের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বাসে নারীদের সিটে পুরুষ বসলেই জেল জরিমানা।’ আসলে আইনটি তা নয়। আইনটি হলো, নারীদের সংরক্ষিত আসন দখল করে রাখলে জেল জরিমানা হবে। যারা ওই শিরোনামটি করেছেন তারা দখল করে রাখা আর ফাঁকা থাকলে বসার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেননি? না ইচ্ছে করে নারীবিরোধী উসকানি দিয়েছেন! আর আসন সংরক্ষনতো শুধু নারীরর জন্য নয়। নারী, শিশু, বয়জ্যেষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য।

এখানে আরও অনেক বিষয় আছে। যা নিয়ে কথা বলা যায়। তা হলো নারীদের জন্য আলাদা বাস। বিআরটিসির ১২ বাস আছে নারীদের জন্য। সেটা কি বাড়ানো প্রয়োজন। না আলাদা বাসের প্রয়োজন নেই- সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু সেই বিতর্ক শুরু করলে লেখা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তাই আজ বাদ দিলাম।

তবে যে কথা না বলেই পারছি না তা হলো সংরক্ষিত আসন দখল করলে এক মাসের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড নিয়ে। এটা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কেউ কেউ বলছেন এই জেল জরিমানার পরিমাণ কি একটু বেশি হয়ে গেলো না? কেউ মনে করেন শুধু জরিমানার বিধান রাখাই যথেষ্ট। আমি এ বিতর্কে না গিয়ে বলতে চাই, একবার ভাবুনতো গণপরিবহণে নারীদের সংরক্ষিত আসনের সুবিধা নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত জেল জরিমানার আইন করতে হচ্ছে! এটা পুরুষদের জন্য কতটা লজ্জার! আমরা তাদের এই সাধারণ প্রাপ্যটুকুও স্বেচ্ছায় দিতে চাই না। তাহলে নারীর জন্য পুরুষ তার অধিকার ছেড়ে দেবে, সেই দিন কবে আসবে?

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ