X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কের নদী

আমীন আল রশীদ
০৯ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৪৩আপডেট : ০৯ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫১

আমীন আল রশীদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন ভারত সফরে যান, সেদিন দেশটির সংবাদপত্র দ্য হিন্দুতে তাঁর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি বন্ধুত্বকে তুলনা করেছেন নদীর সঙ্গে। মেক্সিকোর নোবেলজয়ী কবি অক্টাভিও পাজের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো এবং তা ঔদার্যে পূর্ণ।’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে তিনি বেশ সচেতনভাবেই নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন বলে ধারণা করা যায়। কেননা যেসব কারণে এ দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয়, নদী অর্থাৎ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন তার অন্যতম। যদিও এবারও প্রধানমন্ত্রীর সফরে তিস্তানির্ভর উত্তর জনপদের মানুষের ভাগ্যের শিঁকে ছেড়েনি। বরং তিস্তার পানি ঘুরপাক খাচ্ছে সেই পুরনো আশ্বাসের বৃত্তেই। তবে এবারের আশ্বাসটা বেশ জোরালো। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে বললেন, ‘শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির পক্ষেই তিস্তা সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কোনও কিছু বলা বা লেখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এ দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক যতটা না কূটনীতির, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। আপনার বক্তব্য ভারতের পক্ষে গেলে আপনি ‘ভারতের দালাল’ আর ভারতের বিপক্ষে গেলে বা বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতি আর সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অটল থেকে ভারতের ‘দাদাগিরি’র বিপক্ষে বললেই আপনি ‘ভারতবিরোধী’। আবার যদি আপনাকে ভারতবিরোধী বলে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে আপনি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ন্যূনতম যুক্ত না হলেও বিশেষ কোনও দলের বলে চিহ্নিত করার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরাও যখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ইস্যুতে কিছু বলেন বা লেখেন, আমরা পাঠকরা খেয়াল করি যে, তারা সেখানে খুবই কৌশলী থাকেন।

যেকোনও দেশের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ভর করে তাদের পারস্পরিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জনগণের মনোজগত, সরকারপ্রধানদের পারসেপশন বা পূর্বধারণা ইত্যাদি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যে প্রকৃতি ছিল, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এ সেই একই প্রকৃতি ছিল না। আবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগে যে প্রকৃতি ছিল, ১৫ আগস্টের পর সেই চিত্র একেবারেই বদলে যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ড যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আদর্শিক।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর মূলত সম্পর্ক দৃঢ় করেন সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে। তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পারদ নিচে নামতে থাকে। বহু বছর ধরে সেই অবস্থায় ছিল এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারতবিরোধিতার মাত্রা এতটাই তীব্র হতে থাকে যে, ধীরে ধীরে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, ভারত আসলে বাংলাদেশের বন্ধু নয়। এই ধারণা ও অবিশ্বাস তৈরির পেছনে প্রধানত ভূমিকা রেখেছে সীমান্তহত্যা, ফারাক্কা বাঁধ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, অসম বাণিজ্য ইত্যাদি।

সেই জায়গা থেকে দুদেশের সম্পর্ক নতুন করে জোড়া লাগানো অর্থাৎ বন্ধুত্বের নদীতে নতুন করে জোয়ারের পানি আসতে ঢের সময় লাগে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই কৃতিত্বের প্রায় পুরোটাই শেখ হাসিনার। এখানে অনেকে রাজনীতি খোঁজেন এবং সেটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই রাজনীতির ফলে যদি বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হয় এবং যদি ভারতের মতো একটা বিশাল রাষ্ট্র শত্রুভাবাপন্ন থেকে বন্ধুতে পরিণত হয়, সেটি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যই জরুরি। কেননা, বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ অপেক্ষাকৃত ছোট রাষ্ট্রের জন্য খুব বেশি সুবিধার হয় না। কিন্তু ভালো সম্পর্ক থাকলে সময়ে-অসময়ে তাকে কাছে পাওয়া যায়। বড় বিপদ হলে সেই প্রতিবেশীই আগে সাড়া দেয়। তাছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হবু সদস্য ভারতের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে বাংলাদেশের খুব বেশি অর্জনও হবে না।

২.

প্রতিবেশী মানেই বন্ধু নয়। আবার বন্ধু হলেও সবার সাথে বন্ধুত্বের ধরন অভিন্ন হয় না। পাকিস্তানও ভারতের প্রতিবেশী। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান বন্ধু নয়। চীন ও মিয়ানমারের সাথে ভারতের শত্রুতা নেই। কিন্তু এ দুই রাষ্ট্র সেভাবে ভারতের বন্ধু নয়, যেমন বন্ধু বাংলাদেশের। নেপাল ও ভূটানও ভারতের প্রতিবেশী। কিন্তু এ দুটি রাষ্ট্র যতটা না ভারতের প্রতিবেশী বা বন্ধু, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘অনুগত’ (নেপাল ও ভূটানের জনগণ মাফ করবেন)।

সেই সমীকরণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অম্লমধুর। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের সহায়তা এবং তৎকালীন সরকারের অবদান বাংলাদেশকে সারাজীবন স্মরণে রাখতে হবে। ৮ এপ্রিল বিকেলে নয়াদিল্লির মানেকশ সেন্টারে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীত সাত ভারতীয় সেনার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শেষেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের এই সেনাদের আত্মদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্মরণ করবে বাংলাদেশের মানুষ।’

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর ‍দৃঢ়তায় ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তাদের সব সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার যে বদান্যতা আর অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, সেটিও বন্ধুত্বেরই নিদর্শন। কিন্তু বন্ধুত্বের এই নদী প্রবাহমান থাকেনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে।

কিন্তু এটাও ঠিক যে, সম্পর্ক কখনও একতরফা হয় না। ভারত এখন আর কেবল নিজের রাষ্ট্র নিয়ে ভাবে না। বরং তার ভাবনায় এখন পুরো এশিয়া এবং সেখানে তার সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন-পাকিস্তান-মিয়ানমার। কিন্তু ভবিষ্যতের ‘সম্ভাব্য ব্যাটল গ্রাউন্ড’ যে বঙ্গোপসাগর, তার তীরবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা ভারতের জন্যও জরুরি। অতএব বোঝাপড়াটা এখানেই যে, ভারত আমার কাছ থেকে যা নেবে বা নিতে চায়, তার বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি? সামরিক সহায়তার নামে সে আমাকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিলেও সেই অস্ত্র কি আমাদের ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে? সেই অস্ত্রের মান কী হবে? বাংলাদেশ যেহেতু সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে চীনের কাছ থেকে, সুতরাং ভারত চাইবেই সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমাতে। সেই কূটনীতি ও প্রতিরক্ষানীতির খেলায় বাংলাদেশ কতটা প্রজ্ঞা আর দূরদরর্শিতার পরিচয় দিতে পারবে, চ্যালেঞ্জটা সেখানেই।

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ বাঁধার আশঙ্কা কম। বাংলাদেশের যে পররাষ্ট্র নীতি, তাতে মিয়ানমারের সাথেও যুদ্ধ লাগবে বলে মনে হয় না। কিন্তু নানা কারণেই বাংলাদেশের জন্য আগামীতে হুমকি হতে পারে এই মিয়ানমার যার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর এবং যে চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশ সবচেয় বেশি অস্ত্র কেনে। সুতরাং এই সমীকরণেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হতে হবে আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাস। আবার বিশাল ভূখণ্ড আর বিপুল জনগোষ্ঠীর ভারতেরও প্রয়োজন তার সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো বিশেষত যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তৎপর, সেখানে সার্বক্ষণিক নজরদারি। সুতরাং এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে তার ভালো সম্পর্ক রাখার কোনও বিকল্প নেই। অতএব দেখা যাচ্ছে, প্রতিরক্ষার প্রশ্নে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই পরস্পর নির্ভরশীল। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নদী বয়ে যাবে এবং অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনই শুধু নয়, পানি ব্যবস্থাপনায়ও একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতা হবে-এই বিশ্বাস রাখতে চাই নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনার প্রতি। কারণ বন্ধুত্বের প্রথম শর্তই হলো আস্থা ও বিশ্বাস। ‘দাদাগিরি’ দিয়ে ভয় অর্জন করা যায়, ভালোবাসা নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ