X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাস্কর্য

তসলিমা নাসরিন
২৯ মে ২০১৭, ১৩:৪৭আপডেট : ২৯ মে ২০১৭, ১৮:২১

তসলিমা নাসরিন তালিবানেরা যেভাবে উপড়ে ফেলেছে আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধ, আইসিসের খুনিরা যেভাবে হাতুড়ি শাবলের আঘাতে  ইরাক, সিরিয়া আর লিবিয়ার ভাস্কর্য উপড়ে ফেলেছে, সেভাবে উপড়ে  ফেলা হয়েছে বাংলাদেশের একটি ভাস্কর্য । আইসিস অবৈধভাবে কাজটি করেছে, বাংলাদেশের লোকেরা বৈধভাবে বা সরকারি ভাবে করেছে।  আইসিস গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস, বাংলাদেশের সরকার উড়িয়ে  দিয়েছে  প্রগতিশীল বাংলার ঐতিহ্য। দুই পক্ষের  কীর্তিকলাপে কোনও পার্থক্য দেখি  না। আইসিস ওহাবা মতে বিশ্বাসী। যে মত মনে করে কোথাও কোনও মূর্তি বা ভাস্কর্য থাকা চলবে না। এমনকী পীর ফকিরের মাজারও নয়। বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে যারা ভাস্কর্য  ভাঙ্গার কাজ করিয়ে নিচ্ছে, তারা প্রায় সবাই আইসিসেরই সমর্থক। বাংলাদেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ পর্যন্ত প্রচুর মূর্তি আর ভাস্কর্য ভেঙ্গেছে। শত শত বৌদ্ধ মূর্তি, হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি আর পুরাকীর্তি ছাড়াও ভেঙ্গেছে  লালন ভাস্কর্য,  মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্য, দূরন্ত শিশু ভাস্কর্য, ‘অতলান্তিকে বসতি’ ভাস্কর্য,  সিলেটের  শহীদ মিনার, ঝিনাইদহের ইস্কুলে বসানো মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য।
ভাস্কর্য ভাঙ্গার অধিকার, কট্টর মুসলমানেরা মনে করে, তাদের আছে। আদিকাল থেকেই স্বধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তারা ভিন্ন ধর্মের মূর্তি ভেঙ্গেছে, হাজার বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গেছে। শত শত বছর পার হয়েছে, কিন্তু ভাঙ্গাভাঙ্গিটা এখনও বন্ধ হয়নি। ঘৃণা এখনও হাড়ে মজ্জায়। বাংলাদেশে যত ভাস্কর্য আছে, সব ভেঙ্গে ফেলার  ইচ্ছে ধর্মান্ধ মৌলবাদি অপশক্তির।
খবর যা পাচ্ছি তা হলো--- হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটকের সামনে থেকে ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যে বুদ্ধিজীবীরা দেশ রসাতলে গেলেও  মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন, তারাও এবার ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার মতো  প্রগতিবিরোধী হীন কর্মে ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ভাস্কর্য অপসারণের  মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল কর্তৃক গঠিত সরকার কার্যত ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে। এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের প্রতীক ‘অপরাজেয় বাংলা’ ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এরাই ‘দুরন্ত শিশু’ ভাস্কর্য রাতের আঁধারে নিশ্চিহ্ন করেছিল। এরাই বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। ভাস্কর্য সরানো নিশ্চিতই সংস্কৃতিবিরোধী প্রবণতা।

ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে এখন পেছনের দিকে বা ভেতরের দিকে দাঁড় করিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার। মৌলবাদী দলের দাবি মেনে ভাস্কর্য সরিয়ে মৌলবাদী দলকে খুশি করা হলো, আবার ভাস্কর্যটিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না করে প্রগতিশীলদেরও খুশি করা হলো। কিন্তু মৌলবাদি দল অত সহজে খুশি হওয়ার পাত্র নয়।  ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে এই খবর শুনেই তারা বগল বাজিয়ে ঘোষণা দিয়েছে  যে, দেশের সব ভাস্কর্য নিশ্চিহ্ন করতে হবে। একবার যদি ওদের অন্যায় দাবি মেনে নাও, ওরা তোমার মাথায় উঠে তোমাকে ওদের ক্রীতদাস বানিয়ে ওদের বাকি অন্যায় দাবিগুলোকেও মেনে নিতে বাধ্য করবে। বুদ্ধিমানের কাজ হলো, কারও কোনও অন্যায় দাবি মেনে না নেওয়া।

মৌলবাদিরা সমাজবিরোধী, নারীবিরোধী, শিল্পসংস্কৃতিবিরোধী, সভ্যতাবিরোধী, আধুনিকতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী লোক। এই মৌলবাদিরা দেশকে পাতালে নিয়ে যেতে চাইলে পাতালে নিয়ে যাওয়ায় সাহায্য করবে কেন সরকার? আর কত নিচে নামতে হবে দেশকে? যথেষ্ট নিচে কি স্বাধীনতার পর থেকে  নামেনি? আজ কি বিশ্বাস করা যায় এই দেশটি একটি মুসলিম দেশের বলাৎকার সহ্য করবে না বলে রুখে দাঁড়িয়েছিল?

কে বলেছে আরব দেশে ভাস্কর্য নেই? বাঙালির ভাস্কর্য আরব দেশের ভাস্কর্যের চেয়ে খুব স্বাভাবিক কারণেই ভিন্ন  হবে। ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম জনসংখ্যার  দেশ। এই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে আরব দেশের সংস্কৃতির কোনও মিল নেই। ইন্দোনেশিয়া ভাস্কর্যের দেশ। তুরস্কের রাস্তা ঘাটে  ভাষ্কর্য প্রচুর, এমন কী আরব দেশেও ভাষ্কর্যের কমতি নেই। নিজের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করেও  ধর্ম রক্ষা করা যায় বা ধার্মিক হওয়া যায়। সংস্কৃতি ধর্মের বিপক্ষে বলছে না। কিন্তু ধর্ম  সংস্কৃতির বিপক্ষে বলছে। তাই বলি, ধর্মকে আরও উদার হতে হবে। যারা নিজের সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে,আর ধর্মের নামে সেই সংস্কৃতির বিনাশ করে, তারা আসলে ধার্মিক নয়, তারা অসৎ রাজনীতিক, ধর্ম তাদের ক্ষমতায় ওঠার সিঁড়ি।

আমি জানিনা, প্রগতিশীল মানুষেরা  পাশে থাকা সত্ত্বেও হাসিনার কেন প্রয়োজন হয় হেফাজতিদের মতো অসভ্য অশিক্ষিত লোকদের সঙ্গে আপোস করার? তার কি মনে হয় হেফাজতিদের সমর্থন না পেলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তার কোনও অসুবিধে হবে? পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জিও বিশ্বাস করেন মুসলিম মৌলবাদিদের তোষণ না করলে তিনি গদি হারাবেন। দুই দেশেই হাসিনা আর মমতা—দুই নারীই  সবচেয়ে বড় নারীবিরোধী অপশক্তির কাছে মাথা নোয়াচ্ছেন। আমরা দেখছি কিন্তু কিছু বলছি না। বলছি না কারণ ওরা ছাড়া ভালো কেউ আর নেই দেশ বা রাজ্য চালানোর। ওদের প্রতিপক্ষ  ওদের চেয়েও খারাপ বলে আমরা ওদের যা-ইচ্ছে-তাইকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। মেনে নিচ্ছি ওদের অসংখ্য অপকর্ম। আমার কিন্তু মনে হয়, যথেষ্ট হয়েছে, মেনে নেওয়া আর উচিত নয়। এবার সময় হয়েছে ওদের সরিয়ে দেওয়ার, ভাস্কর্যের মতো।

ভাস্কর্য ইস্যু কোনও ধর্মীয় ইস্যু নয়, এই ইস্যু আগাগোড়াই রাজনৈতিক। ধর্মান্ধগুলো এখন আর নিভৃতে ধর্ম পালনে উৎসাহী নয়, তারা রাজনীতি করে মসনদে আরোহণ করতে চায়। হাসিনার বন্ধু বা সহযোগী নয় তারা, হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদন্দ্বী তারা। তারাই ‘নারী নেতৃত্ব অনৈসলামিক’ – স্লোগান দিয়ে  হাসিনাকে একদিন  টেনে হিচঁড়ে গদি থেকে  নামাবে, যেভাবে তাদের কথা মেনে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে হাসিনা  টেনে হিচঁড়ে ভাস্কর্য নামিয়েছেন। হাসিনা কি জানেন না শত্রুকে বা প্রতিদন্দ্বীকে মাথায় ওঠাতে নেই, এতে মাথা খোয়াবার আশঙ্কা আছে? না জানলে তাকে কেউ এই সত্যটা জানাবার ব্যবস্থা করুন।

লেখক: কলামিস্ট। 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ