X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় মৃত্যু ও আমরা

বিথী হক
২৬ জুলাই ২০১৭, ১৬:৪৭আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৭, ১৭:০১

বিথী হক ব্যবসা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে সে তুলনায় ‘চেতনার ব্যবসা’ করা অনেক সহজ। মানুষের আবেগ আর স্পর্শকাতর জায়গাকে পুঁজি করে ব্যবসা করতে পারলে তরতর করে ওপরে উঠবার সিঁড়ি তৈরি হয়, মানুষ চিনতে জানতে পারে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো সংশ্লিষ্ট ওপরওয়ালাদের দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ। আমরা অনেক কিছুই জানি না এবং না জানার মধ্য দিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করি। দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র জাতীয়তাবাদের ভেতরকার প্রাথমিক পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা না থাকলে তখন কে পতাকা বিছিয়ে নামাজ পড়লো, কে কার ছবি আঁকলো, কে কোন গল্প লিখলো এবং সেসব গল্পে কোথায় ধর্ম অবমাননা হলো, কোথায় জাতির ইতিহাস বিকৃত হলো, কোথায় কার মানসম্মান নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হলো এরকম একইসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক এবং আপাত বিষয় নিয়ে মাথাব্যাথা শুরু হয়। যে মাথাব্যাথা প্যারাসিটামল ও পেইনকিলার দিয়ে নিরাময়যোগ্য নয়। দৌড়াতে হয় থানা থেকে আদালত। যে চেতনার বেসাতি করতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু।
বা্ংলাদেশে ‘চেতনার ব্যবসায়ীরা’ তিনটা বিষয়কে টার্গেট করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু, ধর্ম-জাতীয়তাবাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে কার কেমন অনুভূতি হয় আমি জানি না। কিন্তু একটা ৭১, একটা ২৫ মার্চের কালো রাত, একটা ১৪ ডিসেম্বরই যথেষ্ট পাকিস্তানকে ঘৃণা করার জন্য। বইয়ে পড়া অসংখ্য বুটের লাথি থেকে গর্ভবতী মায়ের পেটে একটা বুটের লাথিই যথেষ্ট ওদের অস্বাভাবিক, নোংরা আর বর্বর অমানুষ হিসেবে দেখতে। একজন মুজিবের জেল-হাজত, কোনও দেশের স্বাধীন-সার্বভৌম হয়ে ওঠার স্বপ্নের চোখে ছানি তৈরি করে দেওয়া একটা জাতির প্রতি ঘৃণা প্রতিটি বাঙালির সহজাত হয়ে ওঠার কথা।
স্বাধীনতার স্থপতি, প্রতিটি বাচ্চা যার গল্প শুনে দেশের পরিচয় জানতে শেখে, যার নামে গাওয়া গান দিয়ে দেশের ইতিহাস জানে তাকে তো অন্তরে ধারণ করবেই। তার ছবি অন্তর থেকে ক্যানভাসে রং তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠবে, এর চেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা আর কী হতে পারে! কিন্তু না, এটা স্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, বঙ্গবন্ধু এখন আর সাধারণ মানুষের নয়; যারা লুঙ্গি পরে কোমরে গামছা বেঁধে ন’মাস ঘরবাড়ি, অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে দেশ বাঁচাতে নিজের শরীরের রক্ত দিতে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এখন চেতনার নাম।  সন্ধ্যেবেলা ধান কেটে এসে ঘাম গায়ে খড়ের গাদার ওপর বসে তাই এখন আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা যায় না পৃথিবীর নবাগত সন্তানদের কাছে। এই গল্প বলার জন্য লাইসেন্স নিয়ে, লাইন মেপে মেপে তারপর গল্প বলতে বসতে হয়। আবেগ দিয়ে, হৃদয়ে প্রতিনিয়ত ঝরতে থাকা রক্তের লাল রং, ঘাসফুল আর মেঘের কালো দিয়ে আঁকা যায় না বঙ্গবন্ধুর ছবি। বাঙালির পিতা, দেশ আজ যে মানুষটির জন্য স্বাধীন তাকে আজ সহজেই যার যার আপনার করে পাওয়া সম্ভব নয়। চোখে রঙিন স্বপ্ন মেখে তিনি যে দল গড়েছিলেন সেই দল দখল করে নিয়েছে তাকে। উপরমহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মানুষ কতখানি মরিয়া হতে পারে, একটু চোখ মেললেই হাজারে হাজারে দেখা যাবে। অলিতে-গলিতে এমন সব আইনজীবীর মতো মানুষ পাওয়া যাবে।

বঙ্গবন্ধু হওয়ার কথা সবার, যেমনটি তিনি ছিলেন স্বাধীনাতা পূর্ব ও পরবর্তী পুরো সময়টা জুড়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি তিনি এখন সকলের নন, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের। একটি দেশের স্থপতি ও জাতির পিতার দলীয়করণের মতো ঘটনাও আমরা ঘটিয়ে ফেলেছি। বাঙালির কাছে তাকে পরিণত করা হয়েছে শুধুমাত্র রাজনীতির মাঠের একজন রাজনীতিবিদ হিসেবেই। অথচ যেসব মানুষদের ওপর অত্যাচার সইতে না পেরে, শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কালের বিবর্তনে পরিবর্তীত একটি রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হয়েছে; সেসব মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে পিতৃপরিচয়। একটি রাজনৈতিক দলের পিতৃপরিচয় ছাড়া বাকি আর সকলের পিতৃপরিচয় মুছে ফেলা হয়েছে।

অপ্রকাশিত কোনও মুক্তিযোদ্ধার তার নিজের গল্প বলা বারণ, তার গল্প কোনও বইয়ে লেখা নেই যে! এই স্বাধীনতার দায়, পা হারানোর দায়, ক্রাচে ভর দিয়ে জীবনের শেষ ক'টা দিন বেঁচে থাকার দায় তার একলার, দায়িত্বও তার একলার।

যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল ৭১ এর ৭ কোটি মানুষের রক্ত গরম করে দেওয়ার আবেগ, যে স্লোগানে মানুষ ঘর ভুলে দৌড়ে গেছে কুষ্টিয়ায়, মালদহ সীমান্তে সেই স্লোগান এখন মানুষ গলায় আনতে ভয় পায়। হয়ে গেছে এই স্লোগানেরও দলীয়করণ। এখন কথায় কথায় তাই মানুষ রাজনীতির গন্ধ খোঁজে। দখল নেওয়া দল ছাড়া অন্য দলের মানুষরা বঙ্গবন্ধুকে না চাইতেই পর করে দিয়েছে, পর করে দিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ এখন মানুষের বেঁচে থাকা, নাগরিক সুবিধা নির্ভর করে কে কোন পন্থী তার ওপরে। নিষ্পাপ শিশুরা বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকলে সেটা হয়ে যায় অবমাননা, ছবি আঁকার অধিকার, লাইসেন্স যে আর সাধারণ মানুষের নেই। শিশুগুলো কী দুর্ভাগ্য নিয়েই না জন্মেছিল!

এভাবে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব আর পরিচিতিকে যতবেশি দলের ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যতবেশি সিন্দুকের ভেতর বন্ধ করে তালা দিয়ে চাবি পুকুরের নিচে পাখির প্রাণে রাখা হবে ততবেশি অমর্যাদা করা হবে জাতির পিতাকে। অসম্মান করা হবে তাঁর অবদানকে। এর চেয়ে বঙ্গবন্ধুকে যদি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ১৭ কোটি মানুষের ড্রয়িংরুমের ফ্রেমে আটকে থাকার জন্য, শিশুদের আনাড়ি হাতের ক্যানভাসে আর লেখক-কবিদের কলম-কিবোর্ডে, তাহলেই শতাব্দীর পর শতাব্দী অনড় অটুট থাকবে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় দৃষ্টি আর শক্ত মুষ্টির স্থিরচিত্র। জীবন্ত হয়ে থাকবে ৭ মার্চের ভাষণ। মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নন। যতদিন একজনও বাঙালি বেঁচে থাকবেন ততদিন তিনি বিস্মৃতির আড়ালে যাবেন না, যেতে পারেন না। যুগে যুগে তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ছিলেন। তিনি বাঁচলে সকলের হয়েই বাঁচবেন।

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ