X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইউনূস ও দেশের ভাবমূর্তি

চিররঞ্জন সরকার
২৯ জুলাই ২০১৭, ১৩:৫০আপডেট : ২৯ জুলাই ২০১৭, ১৩:৫৩

চিররঞ্জন সরকার দেশের রাজনীতিতে আবারও আলোচনায় নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূস। পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় সাভারের জিরাবোতে ৩৬টি দেশের দুই সহস্রাধিক প্রতিনিধির ‘সোশ্যাল বিজনেস ডের’ দুই দিনব্যাপী সম্মেলন বাতিল করেছে ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠিত ইউনূস সেন্টার। ২৮ জুলাই শুক্রবার এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
ইউনূস সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৫০০ বিদেশি অতিথিসহ ৩৬টি দেশের দুই হাজারের বেশি প্রতিনিধির এ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) সমন্বয়ক টমাস গাস এবারের অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন।
পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হকের বক্তব্যের দুই ঘণ্টার মধ্যেই অনুষ্ঠান বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ইউনূস সেন্টারের ওয়েবসাইটে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তাদের মধ্যে ধারণা বিনিময়, আলোচনা, বিতর্ক ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য- ‘সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ঠেকানো সম্ভব?’
ড. ইউনূসকে নিয়ে আমাদের দেশে অনেক সমালোচনা আছে। তিনি দেশের মানুষের বিপদের দিনে কাছে থাকেন না, দেশের কোনও ইস্যুতে তিনি কথা বলেন না-এমনি নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে শোনা যায়। কিছু কিছু ব্যাপারে তার উদাসীনতা অনেককেই পীড়া দেয়। রসরাজ দাস নামে একজন নিরীহ সংখ্যালঘু যুবকের নামে ফেসবুকে একটি বানানো ছবি আপলোডের মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গণহারে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরপরাধ জনসাধারণের ওপর হামলা চালানোর সময় ড. ইউনূস ও ইউনূস সেন্টারকে খুঁজে পাওয়া যায় না। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পল্লী আগুনে পুড়িয়ে উচ্ছেদ করার সময়, শত শত সাঁওতাল পরিবারের খোলা আকাশে রাত্রিযাপনের দুঃসহ প্রহরে ড. ইউনূসকে দেখা যায় না।
রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় যুবলীগের এক নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের চারটি গ্রামের সব বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনার সময়ও তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। মানবসৃষ্ট দুর্যাগে যখন পাহাড় ধসে শত শত মানুষের প্রাণ যায়, অকাল বন্যায় যখন হাওরের লাখ মানুষ মানবেতর জীবন কাটান তখন খুঁজে পাওয়া যায়না ড. ইউনূস কিংবা ইউনূস সেন্টারকে।
সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অন্যায়-অবিচার, দুর্গত মানুষকে তাৎক্ষণিক সাহায্য-সহযোগিতা, এসব হয়তো ড. ইউনূস কিংবা ইউনূস সেন্টারের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। তিনি ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন উন্নত দেশে সভা-সমিতি-সেমিনার ও বক্তৃতায়, মেতে থাকেন সামাজিক পুঁজি ও সামাজিক ব্যবসায় নিয়ে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সবাই সব কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন এমন কোনও কথাও নেই।
কিন্তু একটি জিনিস তো ড. ইউনূস কিংবা ইউনূস সেন্টারের কর্তাব্যক্তিদের অজানা থাকার কথা নয় যে বর্তমান সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক মোটেও স্বাভাবিক নয়, বরং চরম বৈরিতার। খোদ প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র, অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনছেন। সংসদেও তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে। তাহলে তিনি সরকারের কাছে কেমন ব্যবহার আশা করেন? তার নাম যুক্ত আছে, এমন কোনও উদ্যোগ বা আয়োজনে সরকার যে পারলে আগ-বাড়িয়ে ভণ্ডুল করে দেবে, এটা কি তিনি বোঝেন না? নাকি তিনি নিজেও ‘মুরগির ঘর খোলা রেখে শেয়ালের ঈমান পরীক্ষা’র মতো সরকারের ঈমান পরীক্ষার জন্যই এমনটা করতে চেয়েছেন?

তিনি একটি সম্মেলনের আয়োজন করবেন আর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ফুল-চন্দন নিয়ে এগিয়ে এসে তাকে সহযোগিতা করবেন-এটাই কি তার অভিপ্রায়? যদি তাই হয়, তাহলে বলতেই হয় যে, তিনি এখনও ‘বোকার’ স্বর্গে বাস করছেন। আর তিনি যদি জেনেবুঝেই এ ধরনের একটি উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে, তিনি আবারও একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত গড়লেন! তার মতো ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে এটা মোটেও কাম্য হতে পারে না।

সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একটি জেদের বশবর্তী হয়ে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শত্রুসুলভ আচরণ অব্যাহত রেখেছেন। এই মনোভাব ঠিক না বেঠিক সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু সব জেনে-বুঝেও কেন এমন একটা বড় সম্মেলনের আয়োজন করলেন? কেন মাসাধিককাল আগেই সংবাদ সম্মেলন করে এই সম্মেলনের যাবতীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হলো না? সরকারের কাছে অনুমতি চাওয়া হলো না? তাহলে তো আর পুলিশের আইজি বলতে পারতো না যে, এত অল্প সময়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা সম্ভব নয়!

গণমাধ্যমে প্রকাশি প্রতিবেদন মতে, ইউনূস সেন্টারের পক্ষ সম্মেলনের বিষয়টি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনসহ সাতটি দফতরে গত ২০ জুলাই চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠি ২০ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পৌঁছায় বলে ইউনূস সেন্টারের পাঠানো অনুলিপিতে দেখা যায়।

এখানে কিছু পরস্পরবিরোধী মতও রয়েছে। যেমন আইজিপি শহীদুল হক বলেছেন, ‘তাদের উদ্যোগ তারা সঠিকভাবে নেয়নি, আয়োজন ঠিক মত করেনি। একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন, কিন্তু ইউনূস সেন্টার অনুমতি চেয়েছিল ঢাকার এসপির কাছে। এ আয়োজনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দফতরও জানত না।’

শহীদুল হক আরও বলেছেন, ‘এসপি তো একা এত বড় আয়োজনের নিরাপত্তা দিতে পারবে না।... বিদেশি লোক আসবে, আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে না, এটা হয় নাকি? এই যে পানি সম্মেলন হচ্ছে, তার এক মাস আগে থেকে আমরা প্রস্তুত। সেটা নিয়ে তো অনেক মিটিং করা হয়েছে।’

অন্যদিকে ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা নিয়ম মেনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সব কিছু জানিয়েই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। পুলিশ- র‌্যাবসহ সবার সহযোগিতায় আয়োজনের কাজ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল। বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০০ অতিথি ঢাকায় পৌঁছেছেনও। এর মধ্যেই শেষ মুহূর্তে সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে সম্মেলনের অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

যেখানে বিশ্বের ৩৬টি দেশের ব্যক্তি বর্গ উপস্তিত থাকবেন, সেখানে –চারদিন আগে অনুমতি চাওয়া দূরভিসন্ধিমূলক কিনা, সে প্রশ্নটিও বিবেচনার দাবি রাখে। আর যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে তড়িঘড়ি করে যদি সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া হতো, আর এত বড় সম্মেলনকে ঘিরে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা বা দুর্ঘটনা (হলি আর্টিজানের মতো) ঘটে যেতো তাহলে এর দায়ভারই বা কে গ্রহণ করতো? তখন তো দায় সরকারের ঘাড়েই চাপতো! যুক্তি হিসেবে এটা উপেক্ষা করার মতো নয়।

তবে সরকার চাইলে এই সময়েই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সম্মেলনের অনুমতি প্রদান করতে পারতো-এটাও ঠিক। সরকারের পক্ষে অসম্ভব কোনও কিছুই নয়। কিন্তু প্রতিহিংসা কিংবা উচিত শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতার কারণে সরকার তা করল না। এতে করে সরকার নিজেই শুধু ছোট হলো না, যে সব দেশের প্রতিনিধিরা ইউনূস সেন্টারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের কাছেও দেশটা ছোট হলো। অথচ সরকার উদার ও মহৎ হতে পারতো। এই সম্মেলন সুন্দরভাবে হতে দিয়ে ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রতার বিপরীতে নিজের মহত্তকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারতো।

একথা ঠিক ড. ইউনূসের ভূমিকা মোটেও স্বচ্ছ নয়। পদ্মাসেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারের ঘটনায় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকেই দায়ী করা হয়। এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি তাকে দায়ী করে বলেছেন, ‘হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব‌্যাংকের অর্থায়ন আটকে দিয়েছিলেন ড.মুহাম্মদ ইউনূস।’

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হয়ে যাওয়া একাধিক ই-মেইলে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারকে প্রভাবিত করতে হিলারির কাছে বারংবার তদ্বির করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। এপির তথ্য অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা কালে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তিনবার দেখা করেছেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস এবং টেলিফোনে কয়েকবার কথা বলেছেন। এ সময় গ্রামীণ আমেরিকা, যে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মি. ইউনুস, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে এক লাখ থেকে আড়াই লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। গ্রামীণ রিসার্চ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান,যেটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও রয়েছেন মি. ইউনুস, সেই প্রতিষ্ঠান থেকেও ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছে (সূত্র: বিবিসি)।

ইউনূস সরকারকে বিপাকে ফেলতে নতুন চাল চালতেই পারেন। সে জন্য সরকারকে অনেক বেশি সতর্ক ও কৌশলী হওয়া উচিত ছিল। মনে রাখা দরকার যে, শেষ বিচারে সরকারের ওপরই সব কলঙ্ক ও দায়ভার চাপে। অনেকে বলাবলি করছেন যে, অনুমতি আগের দিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখে আসলে ড. ইউনূসকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে ড. ইউনূসই বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলতে শেষ মুহূর্তে অনুমতি চাওয়ার এই ফাঁদ পেতেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই ফাঁদে সরকার পা দিতে গেল কেন?

ড. ইউনূস ও সরকারের মধ্যে জেদাজেদি-রেষারেষির কারণে ইউনূস সেন্টার আয়োজিত এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে পারল না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো দেশের সম্মান ও ভাবমূর্তি। এর জন্য উভয় পক্ষই দায়ী। ড. ইউনূস বা ইউনূস সেন্টার না হয় সরকারকে বিপদে ফেলতে বা জব্দ করতে এমনটা করেছে, কিন্তু সরকার কোন বিবেচনায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার এমন একটি নেতিবাচক ফাঁদে পা দিল? দেশের ইজ্জত, মান-সম্মান কী কারও কাছেই ম্যাটার করে না?

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ