X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কিভাবে বিক্রি হয় বাংলার মুখ

গর্গ চট্টোপাধ্যায়
১৮ আগস্ট ২০১৭, ১৭:১৬আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০১৭, ১৭:১৮

গর্গ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ যে রাজনৈতিক অবস্থায়, যে সাংবিধানিক কাঠামোর অন্তর্গত, তারই ফলস্বরূপ তার সমাজের লক্ষ্য হিসেবে বাংলাই শেষ কথা নয়, সাফল্যের ও কল্পনার স্থান হিসেবে বাংলায় শেষ কথা নয়, যাদের মধ্যে পরিচিতি বা চর্চা লাভ করলে ১০ জনের এক জন হওয়া যায়, তাদের মধ্যে বাঙালি শেষ কথা নয়। দিল্লি কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, দিল্লি ও মুম্বাই কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ এবং এই সব কিছুর অনুসারী যে আদর্শগত কাঠামো, তার ভুক্তভোগী সকল অহিন্দি জাতি। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিও ভুক্তভোগী। সকল কিছুর সমাধান ১৯৭১ নয়। এমনকি ১৯৭১ পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি পূর্ব থেকে পশ্চিমে সংখ্যালঘুর ঢল- এর সমাধান করতে পারেনি ১৯৭১। বাস্তব এই যে, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হওয়াটা তার সমাজ শিখরে যারা বসে, তাদের কাছে শেষ কথা না। এরা সংখ্যায় নগণ্য, কিন্তু তাদের ছাপ সমাজে ক্রমবর্ধমান। কারণ, তারা সংখ্যায় কম হলেও প্রভাবে বিশাল। যে অপেক্ষাকৃত বড়লোক, যাদের মেয়ে ফর্সা, যাদের বাচ্চারা ভালো খায়-পরে, যাদের ছেলেমেয়েরা কাগজ চালায়, যাদের ছেলেরা ভালো চাকরি পায়, যাদের মেয়েরা ডাক্তার হয়, যাদের বউরা মলে খাবার খায়, যাদের স্বামীরা দুনিয়াকে "গ্লোবাল ভিলেজ" মনে করে, যারা জীবনে ধান অবস্থায় চাল দেখেনি, তারাই সমাজপতি। গণতান্ত্রিক ভাবে না, এক পরাধীন ভূমিতে ক্ষমতার কাঠামোর নিয়মে। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের এলিট আজকে কমবেশি যে আদর্শের কবলে, সেই আদর্শ কিন্তু এলিট ছাড়া বাকিদেরও ছাড়ে না। কারণ, বাকিদেরও তার দরকার আছে। নিপীড়ন ব্যবস্থার স্থায়িত্ব, স্থানীয় ক্ষমতাহীনতা- এগুলো এমন জিনিস, যা রোজ রোজ নতুন করে কায়েম করতে হয়। আরও গভীরে প্রোথিত করতে হয়। এটাই আধিপত্যবাদের নিয়ম। তাই তুলে ধরা হয় বাঙালির আদর্শ- বাঙালি হিসেবে বাঙালির আদর্শ না, বরং এই ভূখণ্ডে যে ধরনের আদর্শ দিয়ে তাদের বাঙ্গালিত্বের দাঁত-নখ ভেঙে দেওয়া যাবে, দেওয়া যাবে একসঙ্গে হীনমন্যতা ও এই 'হীন' অবস্থা কাটিয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, হয়তো বা স্বপ্নের সিঁড়ির আভাস পর্যন্ত। সেই সিঁড়ি- যা যায় বাংলার গ্রাম থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে মফস্বল টাউনে, টাউন থেকে কলকাতায়, কলকাতা থেকে বাংলার বাইরে- দিল্লি, নয়ডা, গুরগাওতে। তারপর আরও সুদূরে লন্ডনে-নিউইয়র্কে-সিঙ্গাপুরে বা হয়তো এইসব স্বপ্ন নিয়েই বাংলার মাটিতেই, আশপাশকে ঘৃণা করতে থাকা, জীবন আর কোথাও অপেক্ষা করছে এমন ভাবনায় কষ্ট পেতে থাকা, প্রতিনিয়ত পারিপার্শ্বিক বিশ্বকে অভিশাপ দিতে থাকা - হায় কোন মাটিতে, কাদের মাঝে জন্মালাম। এই হীনমন্যতাই সেই চেতনা যার উদ্রেক করে দিল্লি- বাঙালিকে এই যন্তর-মন্তর ঘরেই সে ঢোকাতে চায়। যার উলটোদিকের নল দিয়ে বেরিয়ে আসে ভাষাহীন, মাটিহীন এক জীব - সে 'ভারতীয়'। দিল্লি তার দেশ, দিল্লিতে থেকে বা না থেকে।       

কারা এরা? কেমন দেখতে এরা? এদেরকে আমি রোজ দেখি- চায়ের দোকানে, বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে, টিভি পর্দায়, খবরের কাগজে, সংবাদ মাধ্যমে। আসুন, দিল্লি ও তার মিডিয়া প্রকল্পের পেটে জন্মানো সংস্কৃতি ও পশ্চিমবঙ্গীয় নাগরিককে চিনি। কখনও এরা আমাদের ছিল। আজ এরা আমাদেরকে ওদের মতো বানাতে চায়। হয়তো বানাতে চায় না, কিন্তু বানানোর প্রক্রিয়ায় ক্রীড়ানক, কিছুটা অজান্তে, কিছুটা সজ্ঞানে। আসুন, চিনি এমন একজনকে। এখানে ব্যক্তি পরিচয় বড় নয়। বরং তা অপ্রাসঙ্গিক। 

ইংরেজি টাইমস অব ইন্ডিয়া কাগজে এক বাঙালি বংশোদ্ভূত সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বের কথা পড়ছিলাম। প্রথমে ভাবা যাক, এই কাগজ এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে একটি "সাংস্কৃতিক" ফিচার করেছে। এবং সেটা বিক্রি করেছে পশ্চিমবঙ্গে। মানে, তোমরা দেখো, ইনি সংস্কৃতি করেন। এটাকে সাফল্য বলে, এনার কাজের উদযাপন ও স্বীকৃতি করে যে নাগরিক, বাংলায় টাইমস অব ইন্ডিয়া সেই নাগরিক গড়ে তুলতে চায়। এই ধরনের বহিরাগত পুঁজির প্রভাবে স্থানীয় নাগরিক গড়ার প্রকল্পের মানে কী, কী তার প্রভাব, কোনও জাতির জীবনে (এ ক্ষেত্রে বাঙালি জাতি) এটা কি কাম্য? এই ব্যক্তিকে নিয়ে কিছু তথ্য আমি এই সংবাদপত্র থেকে জানলাম। ওনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নেই। এইটা মুখবন্ধ। ইনি "লেটস বি আউট, দ্য সান ইজ সাইনিং" নামে একটা বই বানিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, এটা ইংরেজি বই, তবে আমি জানি না। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি "ইন্ডিয়ান" ফিল্ম উৎসবে দেখানো হয়েছিল। তারপরে জানলাম তিনি নানা জায়গার বৃত্তি পেয়েছেন এবং নিউ ইয়র্ক শহরের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইসব নিয়েই স্নাতক হয়েছেন। ওনার আরেকটি বই, নাম "দ্য হাংরি"। এই বইটি ইংরেজি না হিন্দি আমি জানি না। তবে এটা নাকি একটি "ইন্ডিয়ান" বিয়েকে কেন্দ্র করে। "ইন্ডিয়ান" বিয়ের কথা শুনেই বুঝলাম এটা দিল্লির কাছের হিন্দু পাঞ্জাবি বা হিন্দুস্তানিদের বিয়ে-শাদিই হবে। খুঁজে বুঝলাম তাই। সিনেমায় মূল ৮টি চরিত্রের মধ্যে ৩ জনের পদবি আহুজা, ৩ জনের পদবি জোশী এবং অবশ্যই বইটার প্রেক্ষাপট দিল্লিকে কেন্দ্র করে। এই ব্যক্তিত্ব ছোটবেলা থেকে অভিনয় ইত্যাদিকে জড়িত। অর্থাৎ বুঝলাম, কলকাতায় যে এক শ্রেণি ইংরেজি নাটক-টাটক করে কিছু অন্য সমাজের ইংরেজি স্কুল সার্কিটের, ইনি সেসবেরই কথা বলছেন। স্কুল পাস দিয়েই ইনি নিউ ইয়র্ক চলে যান। ইনি নিউ ইয়র্ক দেখে মোহিত হন। কলকাতায় আদৌ কিছু দেখেছেন কখনও কিছুই, তা আমরা জানি না। বাংলা সিনেমা নিয়ে জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেছেন যে, উনি কৌশিক গাঙ্গুলি, শিবপ্রসাদ, কমলেশ্বর, অরিন্দম শীল, এদের কারুরই কোনও সিনেমা দেখেননি। দেখেছেন 'কিউ', যা কিনা মার্কিন দেশে প্রদর্শিত হয়েছিল। ইনি ২০০৪ এ কলকাতা ছাড়েন এবং তার পরে ২০১৩-তে প্রথমবার ফেরেন। এতদ্বসত্ত্বেও তিনি নিজের আবাস বোঝাতে সামাজিকভাবে বলেন যে, উনি ব্রুকলিন (নিউ ইয়র্ক শহরের একটি অংশ - আপনি ব্রুকলিন না জানলে আপনি আলগোছে কৌলীন্য প্রদর্শনের পরীক্ষায় ফেল - ব্রুকলিন বলার একটা ভাঁজ ও কায়দা আছে, এটা একটা সিগনাল - সাংস্কৃতিক পুঁজি দিয়ে কেনা হাইহিল জুতো) আর কলকাতার মাঝে সময় ভাগ করেন। এনার সামনের বই হলো কলকাতার একটি ভেঙে পড়তে থাকা প্রাসাদের মধ্যে ত্রিকোণ প্রেম। বহিরাগত মিডিয়া পুঁজি, বাংলার সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে দিল্লি ও তার কল্পিত ভারতীয় এলিটত্ব আপনার ভাষা, শ্রেণি ও সংস্কৃতির অক্ষ ধরে নিরন্তর আক্রমণের দিনে, ইনি অবশ্যই বাংলার একটি মুখ হিসেবে আপনার সামনে উপস্থাপিত করা হবে। কারণ এই উপস্থাপনের একটা রাজনীতি আছে। এবং এই উপস্থাপন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অন্য সকল উপস্থাপনের সম্ভাবনা। ওই স্টেজের জন্য কাড়াকাড়ি চলবে, আর কারুর সামনে স্টেজ থাকবে ফাঁকা। তারপর স্টেজ থাকবে না। থাকবে ভর্তুকি। তারপর 'দেশজ সংস্কৃতি' বলেও ভর্তুকি থাকবে না। তারপর থাকবে ধুঁকতে থাকা জীবিকা। সেই শিল্পী আর নিজেকে শিল্পী বলে না। সে ভিখারি। টাইমস অব ইন্ডিয়া তাকে নিয়েও ফিচার করতে পারে। যেন জীবন্ত ফসিলের গল্প, বিরল প্রজাতি অথবা "বাংলার বৈচিত্র্য"। কিন্তু খেলা অন্য জায়গায়। ব্রুকলিনে। আর কলকাতায় ব্রুকলিনের নিয়ত নির্মাণে। ভাঙা স্টেজ হয়ে যায় ভগ্ন দেব দেউল। পূর্ব বাংলায় ভগ্ন দেব দেউল দেখে চোখের জল ফেলেছি আমি, আবার সে রাগকে রসদ করে ঘৃণার রাজনীতি করে যাচ্ছে অনেকে। কিন্তু ভগ্ন মঞ্চ, শিল্পীর ভিকিরি হয়ে ওঠা, এটাতো কারুর আত্মপরিচিতির প্রশ্ন না। এটা ধ্বংস হয়, অনাদরে, চোখের জল ছাড়াই সে চিতায় ওঠে। তার বন্ধুদের কাঁদার সময় নেই। তার বন্ধুরা পদাতিক। খেটে খায়। খাটে আর খায়। আর ভোলে। আর বাজার সম্প্রসারিত হয়। হিন্দি সম্প্রসারিত হয়। দিল্লি কল্পনা সম্প্রসারিত হয়। ভারত সম্প্রসারিত হয়। 

বাংলা ও বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে আজ আক্রান্ত। সামনে খুব খারাপ সময় আসছে। কী তীব্র আক্রমণ যে শুরু হয়েছে, তার আমাদের ঘর না ভেসে যাওয়া অবধি আমরা বুঝতে পারবো না। মায়েরা-বোনেরা-ভাইয়েরা সে স্রোতের মুখে দাঁড়িয়ে- প্রতিরোধ চলছে, কিন্তু বাঁধ খুলে যে ওরা জল ঢোকাচ্ছে আমাদের অর্জন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে, আমাদের সমাজ ভাসিয়ে যেতে। চাপিয়ে দেওয়া মুখ প্রত্যাখ্যান সহজ নয়। সে মুখ সবখানে- ওপরে ওঠার মই-এর প্রতিটি ধাপ থেকে ঘাড় তুললে দেখা যায় তার সহাস্য মুখ। আলগোছে বলে আয়, আয়। আসলে বলে না। ছবিটিই বলে। এমন করেই ছবিটা তৈরি, যাতে ছবির মধ্যের বানাওয়াট বাস্তব ওই নড়বড়ে মই-এর পা দানি থেকে দেখায় স্বপ্নের মতো। এই চাপিয়ে দেওয়া মুখের যে পরিসর, সেখানে না জিজ্ঞেস করে ঢুকে না পড়া ছাড়া বাংলা ও বাঙালির বাঁচার কোনও গতি নেই পশ্চিমবঙ্গে। নিজেদের মুখ বাড়িয়ে, সবখানে। নিজের নিয়মে। জী বাংলার স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী নয়। বরং সে স্ক্রিপ্ট জ্বালিয়ে। যেখানে আমাদের ঢুকতে বাধা, ঢুকতে লজ্জা, সেসব জায়গায় ঢোকার এটাই সময়। জঞ্জাল না সরালে, আজ না ঢুকলে, ঢুকে দখল না নিলে, আমাদের মুখই ওরা বদলে দেবে। বদলে দিচ্ছে। সকল স্বীকৃতির মধ্যে রয়েছে অন্য কারুকে অস্বীকৃতি। স্বীকৃত কারা? অস্বীকৃত কারা? আমরা কারা?

লেখক: স্থিত মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ