X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যা, রাজনীতি এবং ইসির সংলাপ

বিভুরঞ্জন সরকার
২০ আগস্ট ২০১৭, ১৩:২৯আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৭, ১৩:৩১

বিভুরঞ্জন সরকার বন্যায় দেশের একটি বড় অংশ প্লাবিত। বানভাসী লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যেই বন্যায় অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। এই সংখ্যা যে আরও বাড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আবহাওয়াবিদরা এবার দেশে বড় ধরনের বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছেন। সেরকম হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর জেলায় সাধারণত বন্যা হয় না। এবার হয়েছে এবং ব্যাপকভাবেই। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ছাড়াও দেশের মধ্য ও নিম্নাঞ্চলেও বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কতটুকু প্রস্তুত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, দেশে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ আছে, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সরকারের আশ্বাসে মানুষের কতটুকু আস্থা আছে সে প্রশ্নতো আছেই। এখন পর্যন্ত যেসব খবরাখবর পাওযা যাচ্ছে তা থেকে বলা যায় না যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছে। সরকারি ত্রাণ বণ্টনে সবসময় যেমন দুর্নীতি, অনিয়ম, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকে, এবারও তা আছে। বন্যা আরও ব্যাপক ও স্থায়ী হলে পরিস্থিতি কী হবে তা নিয়ে আগাম আশঙ্কা না ছড়িয়ে আমি শুধু এটাই বলতে চাই যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবিলায় আমাদের দেশের মানুষের রয়েছে এক অদ্ভূত শক্তি, সাহস এবং সক্ষমতা। বিশেষজ্ঞরা, বিদেশিরা আতঙ্ক ছড়ালেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তাদের বাস্তব জ্ঞান-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়, টিকে থাকে, বেঁচে থাকে। অতীতে বহুবার এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা আশা করতে পারি, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
এটা ঠিক যে, যেকোনও বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রথম দায়িত্ব সরকারের। আবার এটাও ঠিক যে সরকার একা কোনও বড় বিপদ মোকাবিলা করতে পারে না। কোনও দেশেই না। সরকারের পাশে বেসরকারি উদ্যোগও সামিল থাকতে হয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় বিপন্ন মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে দেশের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর। ব্যক্তিগত ভাবেও অনেকে এগিয়ে আসেন। আগে অনেকের সামর্থ্য কম ছিল কিন্তু আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি ছিল না। এখন অনেক মানুষেরই সামর্থ্য বেড়েছে কিন্তু ঘাটতি দেখা দিয়েছে আন্তরিকতায়। এবার বন্যায় দুর্গত মানুষদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারলে ভালো হবে। এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ না নিলে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও তা নেওয়া যেতে পারে। তবে উদ্যোগ যারই হোক না কেন, মানুষের কাছে তাকে বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন হতে হবে। সরকার ত্রাণ বণ্টনে নয়-ছয় করে যদি অন্যদের কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে তাহলেও সুফল পাওয়া যাবে না।
দুই. 
আমাদের দেশে সবকিছু নিয়েই রাজনীতি হয়। এমন কী মানুষের চরম দুর্দশা ও বিপন্নতা নিয়েও। বন্যা নিয়েতো হয়ই। এবারো বন্যা নিয়ে নানামুখি রাজনৈতিক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকার, বিরোধী দল এবং দলবাজ নাগরিকরা – সবাই এই রাজনীতির অংশীদার। সরকারের রাজনীতি হলো, দুর্যোগ মোকাবিলার সব কৃতিত্ব নিজেদের ঝুলিতে ভরার চেষ্টা চালানো। তারা পারছে না – এটা তারা স্বীকার করতে চায় না। মনে করা হয় এটা তাদের ব্যর্থতা। ক্ষয়-ক্ষতি, মানুষের প্রয়োজন – সবই সরকার কমিয়ে দেখাতে চায়।

বিরোধী দলের রাজনীতি হলো, সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা। সরকার দুর্গত মানুষের পাশে নেই, অসহায় মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে না, সরকার সমর্থকরা গরিবের ত্রাণও লুটপাট করছে এমন প্রচারণা বিরোধী দল চালিয়ে সরকারবিরোধীরা রাজনীতিতে নিজেদের একটি সুবিধাজনক অবস্থায় নিতে চায়। প্রশ্ন হলো, সরকার বা সরকারি দল বন্যা দুর্গত মানুষের পাশে নেই – বিরোধী দল কি মানুষের পাশে আছে? বিপদের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর রাজনীতি আওয়ামী লীগও যেমন করে না, তেমনি বিএনপিও করে না। বিএনপি কেন তাদের সংগঠনকে ত্রাণ তৎপরতায় যুক্ত করতে নির্দেশ দিচ্ছে না? একটি প্রবাদ আছে- আপনি আচরি ধর্ম, অপরে শিখাও। বিএনপি কেন বন্যাত্রাণে সর্বশক্তি দিয়ে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে লজ্জায় ফেলছে না?

সবকিছুতেই বিএনপি অজুহাত হাজির করে যে, সরকার তাদের তো ঘরের বের হতে দেয় না, এই অবস্থায় তারা কিভাবে বন্যা দুর্গত এলাকায় যাবে? এখানে বলার কথা হলো, বিএনপি বন্যাত্রাণ করতে গিয়ে কোথায় বাঁধা পেয়েছে? বিএনপি যদি ১০/২০ জায়গায় ত্রাণ কাজে গিয়ে বাঁধা পায় এবং সেটা মিডিয়ায় আসে তাহলে সরকার বিপাকে পড়বে। কিন্তু বিএনপি এটা না করে বন্যা ও মানুষের দুর্গতি নিয়ে রাজনীতি করবে, কষ্ট করে ত্রাণ কাজে যাবে না কারণ তাদের লক্ষ্য সরকারের সমালোচনা করা, মানুষের উপকার করা নয়।

নাগরিক সমাজের কেউ কেউ গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনা, বন্যা মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বক্তৃতা দিতে যতটা পছন্দ করেন, বাস্তব ক্ষেত্রে মাঠে গিয়ে কিছু করতে তাদের ততটাই অপছন্দ। অথচ একসময় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার চাইতে দেশ ও সমাজের জরুরি প্রয়োজনের সময় মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করতেন। দেখা যাক, ‘সুশীল’ হিসেবে পরিচিতরা এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য কী উদ্যোগ নেন।

আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষের ভারতবিরোধিতার পুরনো ব্যাধি বন্যার পানির সঙ্গে সঙ্গে বিপদসীমা অতিক্রম করতে শুরু করেছে। বন্যার জন্য, অতি বৃষ্টির জন্য, অনাবৃষ্টির জন্য অথবা আর যে সমস্যাই আমাদের এখানে দেখা দিক না কেন, সবকিছর জন্যই ভারত দায়ী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এধরনের কিছু প্রচারণা দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে এখন যেমন বন্যা হচ্ছে, তেমনি ভারতের কয়েকটি রাজ্যেও বন্যা হচ্ছে। সেখানেও অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অনেক সহায়-সম্পদ, ঘর-বাড়ির ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। আমাদের দেশে বন্যার জন্য ভারত দায়ী হলে ভারতে বন্যার জন্য দায়ী কে? চীন? তাহলে চীনের বন্যার জন্য দায় কার?

কারো ওপর দায় চাপানোর আগে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেললে কিভাবে চলবে? আমাদের দেশের কিছু সমস্যার জন্য অবশ্যই ভারত দায়ী। নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরোধ আছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টাও চলছে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের যেকোনও সমস্যার দায় ভারতের ওপর চাপাই তাহলে আলোচনার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না কি? ভারতবিরোধিতার রাজনীতি যে আমাদের কোনও উপকারে আসেনি, সে অভিজ্ঞতা কি পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়কালে আমাদের হয়নি?  অতিরিক্ত ভারতভীতি এবং মাত্রাছাড়া ভারতপ্রীতি – দু’টোই আমাদের জাতীয় স্বার্থে অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

তিন.

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তার অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। প্রথম দফায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং দ্বিতীয় দফায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়েছে। আগামী ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা। এই আলোচনা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশ বা পরামর্শগুলো থেকে কমিশন কতটুকু গ্রহণ-বর্জন করবে সেটা তাদের এখতিয়ারের বিষয়। তবে নির্বাচনের অনেক আগে থেকে নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ নিয়েই কমিশন যাত্রা শুরু করেছে। তারা সফল, না ব্যর্থ হবেন তেমন আগাম মন্তব্য এখনই করা অসমীচীন।

গত ১৬ আগস্ট কমিশনের একটি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেদিন এবং আগে-পরের আলোচনার যে খবর গণমাধ্যমে এসেছে তার ভিত্তিতে দু’একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। নির্বাচন কমিশন যাদের নিমন্ত্রণ করছেন, তাদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার মানুষই ছিলেন। এটা একটি ভালো দিক। সময়ের স্বল্পতা থাকলেও সবাই সবার মূল বক্তব্য তুলে ধরতে পেরেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে। আলোচনার পরিবেশ সৌহার্দপূর্ণ ছিল। অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মধ্যে হাস্য পরিহাসও করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্য চার কমিশনার এবং উপস্থিত কর্মকর্তারা সেসব উপভোগও করেছেন।

আলোচনা যেহেতু সিদ্ধান্তমূলক ছিল না, তাই এটা বলা যাবে না যে কোনও বিষয়ে সেখানে সবাই ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তবে নানা বিষয়ে ভিন্নমত থাকলেও একটি ব্যাপারে সবার একমত দেখা গেছে আর সেটা হলো আগামী নির্বাচনটা যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় অর্থাৎ সব দল বিশেষত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অংশগ্রহণ যেন নিশ্চিত হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং বিতর্কমুক্ত হওয়াটাও ছিল সবার প্রত্যাশা। ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনের পরামর্শও প্রায় সবাই দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও সংবিধান তাদের যে দায়িত্ব দিয়েছে তা প্রতিপালনে দৃঢ় থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

আমার কাছে মনে হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের কাছে আমাদের প্রত্যাশার মাত্রাটা একটু বেশি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধ নিষ্পত্তির যে দায়িত্ব কমিশনকে নিতে বলা হয়েছে, সেটা কার্যত তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা খুব স্পষ্ট করেই বলছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মধ্যস্থতা করা ইসির কাজ নয়’। সিইসির এই বক্তব্য কারো কারো কাছে অপছন্দ হতে পারে কিন্তু বাস্তব এটাই যে রাজনৈতিক দলের বিরোধ মীমাংসা করতে গেলে ইসিকে প্রথমেই ব্যর্থতার গ্লানি বহন করতে হবে। সাংবিধানিক ভাবে কমিশন যে ক্ষমতার ভাগীদার হয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ভোটারদের নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা দিতে পারলেই মানুষ খুশী হবে। নির্বাচন কমিশনের কাছে অকারণ অতিরিক্ত কিছু প্রত্যাশা করে তাদের বাড়তি চাপের মধ্যে ফেলে তাদের মূল কাজ - সুষ্ঠু নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটানোর কোনও মানে হয় না।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ