X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডিম থেরাপি’

আহসান কবির
১৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:১৯আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:২১

আহসান কবির ভয়ঙ্কর এক আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার অবস্থা খারাপ। এমন সময়ে মানবাধিকার কর্মীরা এসেছে পরিদর্শনে। কর্মীরা ওই আসামির কাছে জানতে চাইলো– ‘কী অবস্থা আপনার? সব কিছু ঠিকঠাক? আসামি উত্তর দিলো- এরা ডিম খুব ভালোবাসে। সবাইকে দুইবেলা ডিম দেয়!’ সত্যমিথ্যা জানি না, এদেশে একটা কথা প্রচলিত আছে এমন- ‘সবাই ডিম কেনে খেতে আর পুলিশ ডিম কেনে দিতে!’ জানি না কার কার এমন পুলিশের গরম ডিম নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। প্রিয় পাঠক, তেভাগা আন্দোলন তথা নাচোলের রাণীখ্যাত ইলা মিত্র সহ আরো অনেক রাজবন্দীর জীবনী পড়ে দেখতে পারেন। কারো কারো জেল ও গ্রেফতারি ঘটনা থেকে ডিমের বিবিধ ব্যবহার জানতে পারবেন! ‘শাহবাগী’ খ্যাত ইমরান এইচ সরকার কিছুদিন আগে একবার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে তাকে উদ্দেশ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারা হয়েছিল। এই ডিম পচা ছিল কিনা জানা যায়নি। তবে শত বছর ধরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতিবাদের ধরনের একটি হচ্ছে পচা ডিম ছুঁড়ে মারা!  নাটক, সিনেমা, যাত্রা কিংবা গানের অনুষ্ঠান ভালো না লাগলেও পচা ডিম ছুঁড়ে মারা হতো। জনসভা পণ্ড করতেও নাকি পচা ডিমের বিকল্প নেই। ভাঙা এবং পচা ডিম নাকি গোপনে গোপনে বেকারিতে বিক্রি হয় যা দিয়ে বিস্কুট আর কেক বানানোর কাজে লাগে। ছিনতাই এর কাজেও ইদানিং ডিম ব্যবহৃত হচ্ছে। গাড়ির সামনের কাঁচে ডিম ছুঁড়ে গাড়ি থামানো হয়, ছিনতাই করার পর ভুক্তভোগীরা নাকি সেই গাড়ি নিয়ে সহসা যেতেও পারেন না। পরিষ্কার করাও একটা মহাঝামেলার ব্যাপার তখন। গাড়ির কাঁচে পচা ডিম মাখা হলে ভেতর থেকে কাঁচভেদ করে কিছু দেখাও যায় না!

২০১৭ সালের অক্টোবরে যদি বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর ছেলেবেলা থাকতো তাহলে তিনি নির্ঘাৎ তিনটাকা দিয়ে ডিম কিনতে ঢাকার ফার্মগেটের কাছে খামারবাড়িতে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতেন! কারণ ছোটকালে তাকে অর্ধেক করে ডিম খেতে দেওয়া হতো এবং হুমায়ূন আহমেদ ভাবতেন পুরো ডিম সম্ভবত একবারে খেতে নেই, অর্ধেক করেই খেতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ এর মতো ওপার বাংলার সুবোধ সরকারের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে ডাক্তার ও ডিম নিয়ে। সুবোধ সরকার তার সন্তানের শরীর খারাপ নিয়ে দারুন চিন্তিত ছিলেন। প্রথম ডাক্তার তাকে বলেছিল ডিম খুব সুন্দর করে ফাটিয়ে তারপর কড়া করে ভেজে ছেলেকে খাওয়াতে হবে। দ্বিতীয় ডাক্তার বলেছিলেন সেদ্ধ করে খাওয়ার কথা। আরেক ডাক্তার বলেছিল আধা কাঁচা করে ভাজলেও চলবে। শেষে ডাক্তারদের নিয়ে অবশ্য সুবোধ সরকার একটা কড়া মন্তব্য করেছিলেন। সুবোধ সরকারের কবিতার মূলকথা ঠিকমতো মনে না থাকলেও ডাক্তারদের নিয়ে তার মন্তব্য বিলকূল মনে আছে। সেটা আজ না বলে ডিম নিয়েই বলি!

জেনে রাখা ভালো যে ১৯৯৬ সালের অক্টোবর থেকে সারাবিশ্বে ‘ডিমদিবস’ পালন শুরু হয়। পৃথিবীর ৬০ টি দেশে অক্টোবরের দ্বিতীয় শুক্রবার এই দিবস পালিত হয়। ২০১৭ সালের ডিম দিবসে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল ও প্রাণীসম্পদ অধিদফতর ফার্মগেট খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে মাত্র তিন টাকায় ডিম বিক্রির ঘোষণা দেয়। সারা ঢাকা শহর যেন এদিন ভেঙে পরে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে। এক লাখ ডিমের অধিকাংশই নাকি কয়েক মিনিটেই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় হুড়োহুড়ি, পুলিশের লাঠিচার্জ এবং শেষমেষ ডিম বিক্রি বন্ধের ঘোষণা আসে। বিক্রির জন্য স্টলে রাখা কিছু ডিম ভেঙে পড়ে, ডিম না পাওয়া মানুষ খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ফিরে আসে। স্লোগানের ভাষা-ডিম নিয়া ‘ডিমাডিমি’ চলবে না, চলবে না। ডিম নিয়া ‘ডিমাডিমির’ বিচার চাই, করতে হবে! যারা ডিম কিনতে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে ভোর রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের ব্যঙ্গ করে অনেকে সেই পুরনো কৌতুকটা ফেসবুকে আপ করেছেন- এক মুরগি গেছে দোকানে ডিম কিনতে। দোকানিকে সে বললো- দুই হালি ডিম দেন। দোকানি অবাক ভাব কাটিয়ে বললো– আরে তুইতো মুরগি। চাইলেই ডিম পেরে নিতে পারিস। তুই কেন ডিম কিনতে এসেছিস? মুরগি উত্তর দিলো- ইস সামান্য দুই হালি ডিমের জন্য আমার সুন্দর ফিগারটারে নষ্ট করুম?

তবে ডিমের প্রতি কিছু অবিচার করা করা হয়েছে আগেই। এক সময় বলা হতো ডিম নাকি রক্তের খারাপ কোলস্টেরল বাড়ায়। হৃদযন্ত্রের সমস্যা হলে নাকি ডিম খাওয়া নিষেধ। কেউ কেউ (হয়তো সুবোধ সরকারের ডাক্তাররা) বলেন ডিমের সাদা অংশ খেতে কোনও অসুবিধা নেই। এখন অনেকেই বলছেন ডিমে খারাপ কোলস্টেরল নেই বললেই চলে। দিনে অন্তত দুটো ডিম খাওয়া যেতে পারে। আগে বলা হতো পরীক্ষার আগে ডিম খাওয়া ঠিক না। ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিলে নাকি পরীক্ষায় ডিম পাওয়া যায়! বলা হতো ডিমের খোসায় ব্যাকটেরিয়া থাকে, ধোবার পরেও সেটা যায় না। বলা হতো বেশি বেশি ডিম খেলে নাকি রোগবালাই বিশেষ করে মানুষের হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়। এখন আর ডিমের প্রতি তেমন অবিচার করা হয় না। উল্টো বলা হয়ে থাকে ডিম হচ্ছে গরিবের প্রোটিন। ডিম নিয়ে দার্শনিক মতবাদ এমন–ডিমের কাছে ধনী গরিব ধার্মিক অধার্মিক সব সমান। ডিম সবার জন্যই সমান পুষ্টিকর!

রোমানরা প্রাচীনকাল থেকেই ডিমকে সমান চোখে দেখতো। ধনী-গরিব সবাই ডিম দিয়ে ভাগ্য গণনা করাতো। মানুষের আদি গৃহপালিত পশু পাখির তালিকায় আছে কুকুর এবং মুরগি। পৃথিবীর আদিমতম বিতর্কের একটি বিষয় হচ্ছে ডিম আগে না মুরগি আগে? বাইবেলের মতে মুরগিই আগে! ডিম নিয়ে রূপকথা কম নেই। সোনার ডিম পাড়া হাসের গল্প অনেকেরই জানা। অতি লোভে সোনার ডিম পাড়া হাসের বুক কেটে যখন ডিম পাওয়া যায় না তখন হাস মালিকের মাতম কারো মনে করুণারও উদ্রেক করে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিম ছিল যাদের সেই ডাইনোসরই হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। জানি না কত বড় ডিম পাড়তো তারা। এই যুগে সবচেয়ে বড় ডিম পাড়ে উটপাখিরা।

যারা মুরগি পালন করেন তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাত আটমাস পর থেকে একটা মুরগি ডিম দিতে শুরু করে এবং আঠারো মাসে এরা ২৭০ থেকে ৩৬০ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। চীনের লোকরা সবচেয়ে বেশি ডিম খায় আর জার্মানির ভলেফনব্যুটেল শহরের একটা মুরগি সবচেয়ে বড় ডিম পেড়েছিল যার ওজন ছিল ২০৯ গ্রাম। তবে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে ডিম খাওয়াতে কেউই পিছিয়ে নেই। হাওয়ার্ড হেমলার ও সোনিয়া থমাসের নাম আছে গ্রিনেজ রেকর্ডে। হেমলার ৩০ মিনিটে ৪২৭ টি ডিম ভাজি করতে পেরেছিলেন আর সোনিয়া ৬ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে ৮৫টি ডিম খেয়েছিলেন!

ডিমের সবচেয়ে ভালো দিক নাকি এই যে ডিমে কোনও কার্বন বা চিনিময় উপাদান নেই। ডিম সাদা হবে নাকি লাল হবে তা নির্ভর করে মুরগির খাদ্যাভাসের ওপর। চাইলেও আপনি কালো বা সোনালি ডিম পাবেন না। সেসব ডিম নাকি রূপকথাতেই পাওয়া যায়! ক্রিকেটেও ডিম আছে অন্যভাবে। আগে কোনও ক্রিকেটার জিরো রানে আউট হলে বলা হতো ডাকস এগ মেরেছে। এখন বলা হয় ডাক মেরেছে। সবচেয়ে বেশি ‘আন্ডারানে’ আউট হওয়ার রেকর্ড নাকি শহীদ আফ্রিদী ও মুরালীধরনের। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের নাকি একই টেস্টের দুই ম্যাচে ডাক মারার রেকর্ড রয়েছে (ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী। ক্রিকেট পরিসংখ্যানের খেলা বলে ভুল হতেই পারে)

বিশেষ দ্রষ্টব্য: কাজী নজরুল ইসলামের নাকি চুল নিয়ে গর্ব ছিল। তিনি নাকি চুলে নিয়মিত ডিম দিতেন! আর দ্য বার্ডস খ্যাত অমর পরিচালক আলফ্রেড হিচকক ৮১ বছরের জীবনে কখনও ডিম খাননি। ছিদ্রবিহীন ডিম তার কাছে ছিল চরম অপছন্দের। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ ডিমের কুসুম তার কাছে ছিল বিরক্তিকর! ডিম নিয়ে বিরক্তিকর দুটো কৌতুক বলে লেখাটা শেষ করি।

এক. তিন টাকা দিয়ে ডিম কিনতে কেন এতো লোক কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে গিয়েছিল তার কারণ খুঁজতে তিন দেশ থেকে ছয়জন বিশেষজ্ঞ এলেন বাংলাদেশে। তারা উঠলেন পাঁচতারা হোটেলে। খেলেন ডিম দিয়ে রান্না করা খাবার। কিন্তু খাবারের বিল দেখে তাদের হার্টফেল হওয়ার জোগাড়। বিশেষজ্ঞদের একজন হোটেলের ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলেন-তোমাদের দেশে ডিম কি এতো দুর্লভ? সহজে পাওয়া যায় না? ম্যানেজারের সরস উত্তর–ডিম সহজে পাওয়া যায় কিন্তু বিশেষজ্ঞ সহজে পাওয়া যায় না!

দুই. মোরগ ও মুরগি রোমান্টিক হয়ে উঠেছে। মোরগ ধাওয়া করলো মুরগিকে। মুরগি ধরা দেবে তাই ভাবছিল বেশি জোরে দৌড়াচ্ছি না তো? দৌড়ের সময়ে ভাবতে ভাবতেই গাড়ির নিচে পড়ে মুরগিটা মারা গেলো। গাড়ির ড্রাইভার করুন চোখে মোরগের দিকে তাকালে মোরগটা বলে উঠলো–এই যুগে এমন মুরগি পাওয়া কঠিন। জান দিছে মাগার ইজ্জত দেয় নাই!

 

লেখক: রম্যলেখক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ