X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নরেন্দ্র মোদিরা ভারতের বিপদ ডেকে আনছেন

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০২ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৪১আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৭, ২২:৩৯

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী নতুন দিনের কথা বলে বিজেপির প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি গত লোকসভা নির্বাচনে বাজিমাত করেছিলেন। বিজেপি একাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতেছিল। মোদির মন্ত্রিসভায় অন্য দলের দু-একজন মন্ত্রী থাকলেও কোয়ালিশনের কোনও প্রয়োজন ছিল না। তিনি ছিলেন ভারতের বড় বড় শিল্পপতিদের পছন্দের প্রার্থী। বাকবিভূতিতে তার জুড়ি নেই। গত লোকসভা নির্বাচনে তিনি ভারতের সাধারণ মানুষকে যেমন উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন, তেমনি ব্যবসায়ীগোষ্ঠীকেও আশান্বিত করে তুলেছিলেন।
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনে ৭/৮ হাজার কোটি টাকা অর্থের জোগান দিয়ে তার নির্বাচনি ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এত ব্যয়বহুল লোকসভা নির্বাচন স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে আর কখনও হয়নি। ইলেকট্রনিক মিডিয়া তো কেনাই ছিল। ২২/২৩’টা চ্যানেল তো আম্বানিদের। তিনি নির্বাচনি প্রচারণায় বলেছিলেন, নির্বাচিত হওয়ার একমাসের মধ্যে বিদেশে রক্ষিত সব কালো টাকা নিয়ে এসে ভারতের সাধারণ মানষের মাঝে বিলিবণ্টন করে দেবেন।
কালো টাকার পরিমাণ তখন যা দেখানো হয়েছিল, তাতে প্রতিজন ভারতীয় ১৫ লাখ টাকা করে পায়। তার বলার জোর এত বেশি ছিল যে ভারতীয়রা টাকা পাওয়ার বিষয়ে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিলেন। ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তার সময়ে তিনি দুই কোটি লোকের চাকরি সৃষ্টি করবেন। বর্তমান দৈনিক ৩০ হাজার চাকরির প্রয়োজন, অথচ সেখানে চাকরি পাচ্ছেন সাড়ে চারশ লোক। চাকরি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছিল। চাকরি দিতে না পারলে মোদিকেও হয়তো বিদায় নিতে হবে।

অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা কড়া ভাষায় দেশের বেহাল হয়ে যাওয়া অর্থনীতির ওপর একটা জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে উপ-সম্পাদকীয় লিখে মোদির সরকারকে সমালোচনা করেছেন সম্প্রতি। তিনি বলেছেন,  অর্থমন্ত্রী জেটলি ও প্রধানমন্ত্রী মোদি উভয়ে মিলে ভারতীয় অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন। তিনি ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে বিপর্যয় বলে বর্ণনা করে অভিন্ন কর-ব্যবস্থা ও পরিসেবা (জিএসটি) প্রবর্তনকে অপরিপক্ব চিন্তার ব্যবস্থার বাস্তবায়ন বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি যা বলছেন, তা দলের অনেক নেতার মনের কথা কিন্তু তারা ভয়ে বলতে পারছেন না।

দলে এখন মোদির কথাই চূড়ান্ত। তিনি একক নেতা। যশোবন্ত সিনহা বলেছেন, তিনি এসব বিষয়ে অপরাধবোধ করছেন বলে মুখ খুলেছেন। তিনি নাকি বছরব্যাপী এসব বিষয়ে আলোচনার জন্য মোদির সাক্ষাৎ প্রার্থী ছিলেন কিন্তু মোদি তাকে সাক্ষাৎ দেননি। তিনি বলেন, মোদি সাক্ষাৎ দিলে তিনি তো তার অফিসের সামনে অনশনে যেতে পারেন না। তাই অবশেষে মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দলের শ্রমিক সংগঠন মজদুর সংঘও অনুরূপ সমালোচনা করেছে। মোদি নির্বাচনের সময় বলেছিলেন তিনি নিজেও অবৈধ খাবেন না আর কাউকে খেতেও দেবেন না। অথচ গত দু’বছর আগে বিজেপির সভাপতি অমিত শাহের ছেলে জয় শাহা পঞ্চাশ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে একটা কোম্পানি আরম্ভ করেছিল, যার বিস্তারিত জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অফিসে রয়েছে। অথচ তার বর্তমান মূলধন হচ্ছে ৮০ কোটি টাকা।

রাহুল গান্ধী এটা পত্রিকায় দেখে বলেছেন, মোদি কি জয়ের টাকার ভাগীদার না পাহারাদার। যশোবন্ত সিনহার লেখা পড়ে রাহুল টুইট করে বলেছেন, ‘ভদ্রমহিলা ও মহোদয়রা, আমি কো-পাইলট বলছি, আপনার সিটবেল্ট বেঁধে নিন, বিমানের দুই ডানাই ভেঙে মাটিতে পড়ে গেছে।’

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলের নেতাদের মাঝে যাদের বয়স ৭৫ বছর হয়ে গেছে তাদের মন্ত্রী করবেন না। এ কারণে অভিজ্ঞ এল কে আদভানি, মুরালি মনোহর যোশী, যশোবন্ত সিংহ, যশোবন্ত সিনহা, সবাই ব্রাত্য হয়ে গেছেন।

যশোবন্ত সিনহা আরও বলেছেন, দেশের রফতানি কমে গেছে আর আমদানি বেড়েছে। বেসরকারি লগ্নি ও উৎপাদন নাকি কমে গেছে। জেটলি রক্ষা পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়াতে না হয় পরিস্থিতি তাকে পাগল করে তুলতো। এখন মোদি পাঁচ বিশেষজ্ঞ নিয়ে অর্থনীতির বিষয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছেন। যশোবন্ত সিনহা বলেছেন, এখন ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা করলে কোনও সুফল আর নির্বাচনের আগে বয়ে আনবে না।

ভারতীয় ধনবাদীগোষ্ঠী নরেন্দ্র মোদির মতো একজন সাম্প্রদায়িক লোককে ক্ষমতার পীঠস্থানে বসার সুযোগ করে দিয়ে ভারতের লাভ ক্ষতি কী করেছেন, তার হিসাব যে কেউ কষবে না তা নয়। বহুত্ববাদী সমাজটাকে ভেঙে দিলে ভারতের যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে তা উপলব্ধি করার মানুষ যে ভারতীয় সমাজে নেই তাও নয়। গো-বলয়ে আরএসএস এর ক্যাডারদের দাপটে হয়তো সাময়িকভাবে বহুত্ববাদ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত পরিণতিতে তা টিকতে পারবে তা নয়। 

মনে হচ্ছে যে ভারতীয় সমাজ তার ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। কংগ্রেস ছাড়া বিজেপির বা নরেন্দ্র মোদির একচ্ছত্রবাদ রুখে দাঁড়ানোর শক্তি আর কারও নেই তাই বার বার নরেন্দ্র মোদি বলছেন কংগ্রেসকে ভারতের মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। মনে হচ্ছে যে তার সে আহ্বানে যে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের মানুষ তা বুঝতে পেরেছে এবং সে পরিকল্পনা যে শেষ পর্যন্ত ভারতকে বিধ্বস্ত করে ছাড়বে তাও তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। সুতরাং নরেন্দ্র মোদির পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় সমাজ আর অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করবে বলে মনে হয় না।

সমাজে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তির প্রয়োজন না হয় ভারতীয় সমাজ অগ্রসর হবে কিভাবে? ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বান্দুং সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করে ছিলেন ভারত শিল্পে চীনের চেয়ে বহু অগ্রসর। সে ভারত এখন কোথায়? আর চীন কোথায়? এখন ভারতের মানুষের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকা নিজের দেশের ২২ কোটি সংখ্যালঘুকে বিভিন্ন ছলচাতুরিতে নিধন করা নয়।

যোগী আদিত্য নাথ তাজমহলকে পর্যটকের গাইড বুক থেকে বাদ দিয়েছেন। আদিত্য নাথ বলছেন, তাজমহল হিন্দু সভ্যতার অংশ নয় আর কোনও কালে নাকি এ তাজমহল শিবের মন্দির ছিল। হিন্দু সভ্যতার অংশ নয় এ কথা বলে তাজমহল যদি ধ্বংস করা হয়, লালকেল্লা যদি ধ্বংস করা হয়, তোঘলকদের রাজধানী যদি ধ্বংস করা হয়, লোদীদের রাজধানী লোদী গার্ডেন যদি ধ্বংস করা হয়, ভিক্টোরিয়া পার্ক যদি ধ্বংস করা হয়, অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এ কথা বলে যদি ইলোরা, অজন্তা, হস্তিনাপুর ধ্বংস করা হয় তবে ভারতের আর কী থাকে? ভারতে পর্যটক আসবে কেন? পর্যটন শিল্পের কারণে তো ভারত কোটি কোটি ডলার আয় করে থাকে। শিবের লিঙ্গ দেখার জন্য তো পর্যটক আসবে না!

কিছুদিন আগে বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে। তাতে উত্তরাখণ্ড ও উত্তর প্রদেশের বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিলো এবং উত্তর প্রদেশে সাধু আধিপত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, উত্তরাখণ্ডেও অন্য সাধু মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে। সাধুদেরকে যদি ভারতে রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতায় বসানো হয় তবে ভারত তো মধ্যযুগে ইউরোপীয় সমাজে যেমন চার্চের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল ঠিক অনুরূপভাবে সন্ন্যাসীদের কর্তৃত্বে চলে যাবে। ভারতে তখন তো আইনের শাসন তিরোহিত হবে আর অরাজকতা দেখা দেবে। আগামীতে ভারতবাসীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করবে, না তাজমহলে শিব লিঙ্গ স্থাপনে, বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির স্থাপনের আর মথুরার মসিজদ ভাঙার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

আমেরিকার পাশে কানাডাও বড় রাষ্ট্র। কিন্তু কানাডা আমেরিকার প্রতিযোগীও নয়, সমকক্ষও নয়। ভারত কি চীনের পাশে কানাডা হয়ে থাকতে চায়? মনমোহন সিং, নরসীমা রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ভারতকে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে টেনে এনেছিলেন। তাতে ভারতের অর্থনীতি গতি পেয়েছিল। বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনিও তা অব্যাহত রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখনও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত ছিল।

ভারতীয়দের মনে আশা জেগেছিল যে তারাও চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে। কিন্তু মনমোহন সিং দ্বিতীয়বার যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন গতি অব্যাহত রাখতে পারেননি। তার কারণ ছিল দুর্বল কোয়ালিশন সরকার। তারা সবাই প্রতিযোগিতা করে দুর্নীতিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত মনমোহন অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। তামিলনাড়ুর করুণানীধির ডিএমকে কোয়ালিশনের পার্টনার ছিল কেন্দ্রে তার দলের ৬ জন মন্ত্রী। তার মেয়ের জামাইও কয়লা দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। কয়লাখনি কেলেঙ্কারিতে তিনি নাকি ১২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।

আগামী কয়দিনের মাঝে রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হচ্ছেন। সোনিয়া গান্ধী ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। শোনা যাচ্ছে কংগ্রেস নাকি আগামী লোকসভা নির্বাচনে সদ্য অবসরে যাওয়া রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীকে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী করবেন। এ সিদ্ধান্ত যদি চূড়ান্ত করতে পারে তবে ভারত হয়তো রাহুমুক্ত হবে।

মহারাষ্ট্রের বিধানসভার নির্বাচন হবে আগামী ডিসেম্বরে। গুজরাটে কিছুদিন আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়েছিলো। তাতে কংগ্রেস বিজেপির চেয়ে অনেক এগিয়েছিলো। দেখা যাক বিধানসভায় কংগ্রেস কেমন ফল লাভ করে। মোদি তো কংগ্রেসকে ভারত থেকে উচ্ছেদ করার কথা বলছেন আর গুজরাট হচ্ছে তার নিজের রাজ্য।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

এসএএস/ এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ