X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মিছে ঘুরি চিলের পিছে’

জোবাইদা নাসরীন
১৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:২১আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:২৬

জোবাইদা নাসরীন আমরা স্কুলজীবনে শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’কবিতা পড়েছিলাম। কবিতাটির প্রথম কয়েক লাইন ছিল এ রকম,
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।

তবে এখনকার মতো আমাদের কাছে এই চিল হলো টিটু রায় নামের এক অদৃশ্য ভূত। মুখে মুখে এতদিনে রটে যাওয়া খবরে সবাই জেনে গেছে টিটু রায় নামের এক হঠাৎ আবিষ্কৃত ‘হিন্দু’ ছেলে রংপুরের সাম্প্রদায়িক হামলার ভুতুড়ে কারিগর। যে নামধারী ভূতকে এলাকায় বহুদিন আগে দেখা গেছে, তিনি নিরক্ষর, কিন্তু ফেসবুক চালাতে জানেন, ‘ধর্মীয় অবমাননা’মূলক পোস্ট শেয়ার করতে জানেন।

এই আপাতত রংপরের সাম্প্রদায়িক হামলা বিষয়ে সে জেলার জেলা প্রশাসকের পর্যবেক্ষণ দিয়ে শুরু করেছি এই লেখা একটি অভিমত দিয়ে। পত্রিকার বয়ানে জানা যায় যে, এই সাম্প্রদায়িক হামলা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এক হয়ে সহিংস ঘটনা ঘটানোয় আমরা এটিকে পরিকল্পিত বলে মনে করছি।’এই মনে করার কারণও স্পষ্ট। গত কয়েক বছরে দেশের বেশ কটি সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে একই কায়দায়, একই উত্তাপে। ব্যবহার করা হয়েছে একই অস্ত্র। আর সেটি হলো–ফেসবুক পোস্ট। চিলে কান নিয়ে গেলো, সেজন্য চিলের পিছে ধাওয়ায় লেগেছে আগুন, এলাকাবাসী আর পুলিশের সংঘর্ষে দুই জন নিহত হয়েছেন। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামের হিন্দুদের বাড়িতে, আক্রমণ করা হয়েছে। এই ঘটনায় আহত হয়েছে ৫০ জন পুলিশ। দুই জনকে আটক করা হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এবং সাঁওতাল পল্লিতে যে ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, সব ঘটনায়ই বলির পাঁঠা হয়েছেন কোনও না কোনও হিন্দু। এই হামলাগুলো হয়েছে একই ঢঙে। ফেসবুক পোস্ট থেকে ছড়ানো হয়েছে উত্তেজনা। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো সরকার এখন পর্যন্ত কোনোটির বিচার করেনি। সরকার যখন জানেই এগুলো পূর্ব-পরিকল্পিত, তাহলে কেনইবা টিটু রায় নামের চিলের পিছে এত সময় নষ্ট? এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার রাজনৈতিক অর্থনীতি কী? এসব হামলার পরে কয়টি হিন্দু পরিবার দেশ ছাড়ে? এই সব হিন্দুর সম্পত্তি কোথায় যায় কিংবা সেটি দখলের লোভেই তবে কি এই ধরনের পরিকল্পিত হামলা করা হয়? কেন একই কায়দার হামলা করা হয়? সরকার কেন এই ধরনের হামলা ঠেকানো বা রুখতে ব্যর্থ হয়? এই ‘মিসিং পপুলেশন’ এর সংখ্যা সরকার কখনও প্রকাশ করে না। এই বিষয়ে অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন সময়ে প্রতিদিন গড়ে নিরুদ্দেশ হওয়া হিন্দুদের সংখ্যা সমান নয়, যেমন, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ পাকিস্তানের শেষ ৭ বছর প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৭০৫ জন হিন্দু। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৫২১ জন। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৪৩৮ জন। ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতিদিন ৭৬৭ জন হিন্দু দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আর ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৬৭৪ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এই গবেষণা থেকে আরও জানা যায় যে, গত ৪০ বছরে (১৯৬৫-২০০৬) বিভিন্ন সরকারের আমলে শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের ক্ষতির পরিমাণ ও মাত্রা ছিল বিভিন্ন ধরনের। এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৬০ শতাংশ ও মোট ভূমিচ্যুতির ৭৫ শতাংশ হয়েছে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। মোট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ২০ দশমিক ৬ শতাংশ ও মোট ভূমিচ্যুতির ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঘটেছে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, শত্রু ও অর্পিত সম্পত্তি আইনে যেসব হিন্দুধর্মাবলম্বী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ৭২ শতাংশ এবং মোট ভূমিচ্যুতির ৮৮ শতাংশই ঘটেছে সেনাশাসন-স্বৈরশাসনামলের ২১ বছরে। অর্থাৎ ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল।

ঘটনার ব্যবচ্ছেদ করলে আমরা কী দেখতে পাই? ঘটনাটি ঘটেছে দিনের বেলাতেই, সকলের চোখের সামনে। গত শুক্রবার বেলা তিনটায় রংপুর সদর উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। এই সব হামলা ঘটার পর কী হয়? রামুতে আমরা কী দেখেছি? সরকার বলেছে আরও ভালো মন্দির, বাড়িঘর বানিয়ে দেবে। কিন্তু মানুষ ভয়ে থাকতে পারছে না। এই যে ভয়ের সংস্কৃতি তার একটি অর্থনৈতিক চরিত্র আছে আর সেটি হলো মানুষকে ভয়ের মধ্যে ফেলে তার জমি দখল। এই সব হামলার পর সেই গ্রামবাসীরা ভয়ে এলাকা থেকে চলে যায়, চলে যায় ভিটেমাটি ছেড়ে। রাষ্ট্র তাদের এই চলে যাওয়া দেখে, আর সেই ভিটে মাটি দখল করে নেয় ক্ষমতাসীন দল কিংবা এলাকার দাপুটে নেতারা। অন্তত দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের চিত্র এটিই সাক্ষ্য দেয়। এসব হামলার পর হাজার হাজার ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির নামে মামলা হয়। সমানে চলে গ্রেফতারবাণিজ্য। আর এই রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণেই ধারাবাহিকভাবে ঘটছে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা। এই বিষয়ে আরেকটু এগিয়ে। একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এর সঙ্গে বাড়ছে ষড়যন্ত্র। রামু ও নাসিরনগরের ন্যায় রংপুরের ঠাকুরপাড়ার হিন্দুপল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা পূর্ব-পরিকল্পিত সব কিছুই ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি আরও বলেন, ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের জিকির তুলে মূলত এই বর্বোরোচিত হামলাকে বৈধ করার চেষ্টা চলছে। মূলত এর পেছনে রয়েছে লুটপাট ও ভোটের রাজনীতির স্বার্থ ।

এই চাপাচাপির জিকিরে লাভ কিছুই হচ্ছে না, বিচার হচ্ছে না, শুধু বাড়ছে হামলা, দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন হিন্দুরা। আমরা সকলেই জেনে গেছি, এই অদৃশ্য টিটু রায়দের পিছে দৌড়ানো বৃথা। কারা এই টিটু রায় নামের পোশাকি মুখ, সেটিই আমরা দেখতে চাই। আগের জায়গাগুলোতে জানাও গেছে, কিন্তু বিচারের সংস্কৃতি নেই, শুধু আছে ভয়ের সংস্কৃতি, ভয় দেখার সংস্কৃতি আর এর পাশেই যুক্ত থাকে জমি দখলের সংস্কৃতি। তাই এবার শেষ করি একই কবিতার শেষ লাইনগুলো দিয়ে।

মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট্ট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?

 

নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে, সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।


আমাদের লোক দেখানো শ্রমটিই আসলে শেষ। কারণ ‘সাধারণ’ মানুষই সবচেয়ে বুঝদার।

লেখক:  শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল:[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ